কৃষিতে বিপ্লব রত্ন সার

কৃষি উদ্ভাবন

ড.এফ এইচ আনসারী

কৃষি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটা বিষয়। যদি এর উন্নয়ন ঘটাতে হয় তাহলে টেকনোলজির ব্যবহারের বিকল্প নেই। আমাদের টেকনোলজির উপর নির্ভর করতে হবে। আবার জেনে রাখা ভালো টেকনোলোজি আরো সংবেদনশীল। কারণ এর সঠিক ব্যবহার না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এজন্য এটি কখন, কোথায়, কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা জানতে হবে। তাহলে আমরা কৃষির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারব। আমাদের দেশে সাধারণত আমরা বেসিক কৃষি নিয়ে কাজ করি। বীজের দরকার হলে বীজ নিই, সারের দরকার হলে সার নিই, কীটনাশক লাগলে, ছত্রাক নাশক লাগলে সেটা নিচ্ছি, প্রয়োজনে ধান কাটছি। এসবের প্রতিটার জন্য সংবেদনশীল টেকনোলজির ব্যবহার রয়েছে। এই টেকনোলজির ব্যবহার যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় তাহলে ফসলের উৎপাদন ও আয় অনেকগুণ বেড়ে যাবে। ফলে কৃষকরা খুশি থাকবে।

আমাদে কৃষির নতুন সম্ভাবনা ‘রত্ন সার’। যুগ যুগ ধরে কৃষিতে বেশি ফলনের জন্য আমরা জমিতে ইউরিয়া, ফসফেটসহ বিভিন্ন সার ব্যবহার করছি। যখন দরকার মনে হলো তখন ডিলারের কাছ থেকে সার কিনে জমিতে দেয়ার জন্য মাটির সাথে মিশিয়ে নিলাম। মেশানোর সময় একটা সমস্যা তৈরি হয়। এখানে ইউরিয়ার দানা এক রকম, ফসফেটের দানা আরেক রকম আর পটাশিয়ামের দানা তিনকোনা । তিন ধরনের সার একসাথে মেশানোর ফলে যা হবে, তা হলো, সবগুলো একসাথে না থেকে কোনোটা উপরে, কোনোটা মধ্যে আবার কোনোটা নিচে পড়ে থাকবে। তাহলে যখন আমি নিচের সার জমিতে দিব দেখা যাবে সেখানে সারের মাত্রা বেশি হয়ে গেছে। মাঝের অংশ যেখানে দিলাম দেখা গেল এর মাত্রা কমে গেছে। উপরের সার যেখানে দিব তখন এর মাত্রা আরো কমে গেল। এভাবে এক ধরনের ভারসাম্যের সমস্যা দেখা যায়। তখন একই জমিতে ভালো ফসল উৎপাদন হলেও দেখা যায় এর একপাশে বেশি ফলন হয়েছে, অন্য পশে একটু কম, বাকি দিকে আরো কম ফসল হয়েছে। সার্বিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে আমরা ফসল পেলেও এর ভারসাম্যের ব্যাপারটা লক্ষ করে দেখি না।

এসমস্যা সমাধানে রয়েছে মিশ্র সার। যা এমনভাবে ব্লেন্ডিং করা হয় যেখানে ইউরিয়া, ফসফেট, পটাশিয়াম আলাদা করে পাউডার করা হয়। তারপর সেই আলাদা পাউডারকে একসাথে ব্লেন্ডিং করে দানা বানানো হয়। আবার সেই সুষম দানাকে মেশিনের মাধ্যমে সমান পরিমাণে প্যাকেটজাত করা হয়। ফলে এই সার ব্যবহারে জমির প্রতিটা কণায় সমানভাবে ছড়িয়ে পরে। এবং পুরো জমিতে সম পরিমাণে ফসলের উৎপাদন হয়।

আরেকটা ব্যাপার আছে, বেশিরভাগ সময় ধানের জন্য যে সারের ডোজ থাকে তা আমরা সব্জিতে দেই, সব্জির জন্য যে ডোজ তা ভুট্টায় দিয়ে থাকি। কিন্তু রত্ন, এই সমমিশ্রিত সার আপনার চাহিদা মতো যে ফসলের জন্য যতটুকু দরকার আপনি ঠিক ততটুকুই দিতে পারছেন। এখানে কম বেশি হবার কোনো সুযোগই নাই। এর ফলে আমরা পরিমাণমতো সার জমিতে দিতে পারছি, সারা জমিতে সমপরিমাণ সার ছড়িয়ে দেয়া যায়, এতে গাছগুলো বৃদ্ধি হয় দ্রুত এবং ফসল অধিক উৎপাদন হয়, কৃষকরা সময়মতো ফসল বিক্রি করে লাভ তুলতে পারে। এই বৈশিষ্টের জন্যই এই সার গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এ টেকনোলজিটা বেশ পুরোনো, কিন্ত কৃষকরা জানেই না এর ব্যবহার প্রসংগে। তাদের এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কখনই দেখানো হয়নি। এখন যদি সারা দেশের ডিলারদের মাধ্যমে কোন কোম্পানি কৃষকদের মাঝে এর সুফল ও ব্যাবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পারলে কৃষকরা বেশি লাভবান হবে। যার মাধ্যমে সারা দেশে এর ব্যাপক প্রচার হবে। যদিও পুরোনো ব্যবস্থারই একটি নতুন টেকনোলজি এটাও কৃষকরা জানতে পারবে। আমি মনে করি সার্বিকভাবে এই সারের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিতে একটা অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে যাবে। একে আমরা বিপ্লবও বলতে পারি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের জন্য এই বিপ্লবটা খুবই প্রয়োজন। আর এ লক্ষ্যেই আমরা কাজটা করে যাচ্ছি।

যখন আমরা খাবার খাই তখন বলতে শোনা যায় যে এই বাড়ির ফসলের স্বাদ বেশি, ওই মাঠের ফসলের স্বাদ কম। এমন মন্তব্যের মাধ্যমে অনেক ইস্যু তৈরি হয়। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ব্যাপারটা হলো আপনি কিভাবে ফসলের চাষ করছেন, কিভাবে যত্ন নিয়েছেন, কী পরিমাণ সারের ব্যবহার করেছেন, কিভাবে এর ব্যবস্থাপনা করেছেন এসবের উপর নির্ভর করে। অনেকে বলে আমি ভালো বীজের ব্যবহার করলাম, সার দিলাম, যত্ন করলাম কিন্ত আমার ফসল ভালো হলো না। আসলে এ সবই নির্ভর করে টেকনিকের উপর। সে কতটুকু জমিতে কত পরিমান বীজ রোপণ করবে, কি পরিমান সারের ব্যাবহার করবে, কিভাবে কতটুকু হাতের মাধ্যমে ছিটিয়ে দিবে এর উপর। আর এইসব সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা এই মিশ্র সার কৃষকের জন্য নিয়ে এসেছি। যার মাধ্যমে কৃষিতে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি আমরা সেটা করতে পারব।

সারা দেশে পরীক্ষা করে কোন জমিতে কী পরিমাণে পিএইচ আছে বা নিউট্রিশন রয়েছে এর হিসেব করে জমির প্রোফাইল করা আছে। সেখানে আলাদা আলাদা জমির জন্য কী পরিমাণে কী ব্যবহার করা হবে তার ডোজ নির্ণয় করা আছে। সেই নির্দিষ্ট জমি ও ডোজের উপর নির্ভর করেই সারের ব্যবহার করতে হবে। আমর মাটি পরীক্ষা করে এখন বলতে পারি, কোন জমিতে কি লাগবে। আমরা চাইলেই সরকারের নির্ধারিত আইনের বাইরে যেতে পারব না।

অন দ্যা টপ থেকে কাজ হবে। গাছ বড় হবে, সবুজ হবে, পাতা ছাড়বে, ফুল ধরবে, ফল হবে, ফল পাঁকবে। তখন বিভিন্ন পর্যায়ে মাইক্রো নিউট্রিন্ট থাকে। আমরা কিন্ত এই সারের সাথে মাইক্রো নিউট্রিন্ট মিশিয়ে দিব। যে অঞ্চলে যে ডেফিসিয়েন্সি আছে সেটা আমরা টপ আপ করবো। যার ফলে লাভ হবে কৃষকের। এতকাল যে সার ব্যবহার করে তারা উপকার পায়নি সেখানে হঠাৎ করে কী হলো এই ভেবে তারা অবাক হবে। এই সারের ব্যবহারে তারা সুফল পাবে। কৃষকরা বেশি উৎপাদনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে। আর এটাই আমরা চাচ্ছি।

একদিকে মিশ্র সারের সুষম সম ব্যবহারের মাধ্যমে জমিতে সম-বন্টনে সারা খেতে সমান হারে ফসল উৎপাদন হবে। অন্যদিকে সারা দেশে জমির প্রয়োজন বুঝে এর ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক উপকৃত হবে। এর জন্য আমরা সারের প্যাকেট করেছি বিশেষ প্রক্রিয়ায় । এতে চাইলেই কেউ ভেজাল বের করতে পারবে না।

সবশেষে বলতে পারি যে এই মিশ্রসার ব্যাবহারের মাধ্যমে একদিকে জমির ব্যবস্থাপনা হোমোজিনিয়াস হচ্ছে, আরেকটা টপ আপ করা হচ্ছে এবং ভেজাল রোধে প্যাকেজিং প্রক্রিয়ার ভিন্নতা আনা হয়েছে।

ড.এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
এসিআই এগ্রি বিজনেস

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: এসএম জাকির হোসাইন

ক্যামেরা: আব্দুল লতিফ

ছবি: ফয়সাল ইব্রাহিম