কৃষি জমি বিক্রি ঠেকাতে হবে

 পেশার মানুষ : কৃষক

কবিগুরু লিখেছেন :
‘ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনি। স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দ গতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার
তারপরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ স্বরি,
মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান,
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোন মতে কষ্ট-কিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া।’

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলায় গায়ের ঘামে আর বুকের রক্তে সিক্ত করে যারা ধনধান্যে পুষ্পে ভরা বসুন্ধারা বানাত, সেই মেহনতি কৃষকসমাজের সাধারণ জীভনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে উদ্ধৃত কবিতাংশে। আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন। বিজাতি বিদেশি ব্রিটিশ তাড়িয়ে পাকিস্তান পেলাম, কিন্তু স্বাধীন হলাম না। বাংলাবিদ্বেষী পাকিস্তান ভাংলাম, কিন্তু মুক্তি পেলাম কই? আজও কৃষকজীবনের সাধারণ চিত্র কবিগুরুর দেখা অবস্থার মতোই। বরং তারচেয়ে করুণতর, অধিকতর শোচনীয়। এ কথা সত্য যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজনিত বিধিব্যবস্থা ও প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ-সংগঠন আজকে বহালতবিয়তে নেই। ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গ জমিদারি ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন পাসের ফলে জমির ওপর স্বীকৃত হয়েছে খোদ চাষির মালিকানা। উৎপাদনকর ক্রমোন্নয়নশীল হওয়ার পরিবর্তে বিপরীত হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাস্যকরভাবে অর্থহীন হয়ে পড়েছে কৃষিব্যবস্থা। জমি হারিয়ে চাষিরা ভূমিহীন প্রলেতারিয়েতে পরিণত হচ্ছে। সপরিবার ছিন্নমূল হয়ে ভিড় করছে শহরে এসে। আর চাষের জমি চলে যাচ্ছে মহাজন, জোতদারদের দখলে। জমি চলে যাচ্ছে অকৃষক বিত্তবান আমলা ও মুৎসুদ্দীর অধিকারে।

বিভিন্ন স্তোকবাক্যে ভুলিয়েভালিয়ে ভূমিবান কৃষকদের দ্বারা স্বার্থ উদ্ধার করে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে কৃষিজীবীদের। স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশের বুকেই আজ বাঙালি কৃষক স্বভাষী স্বজাতি শোষকের গর্বান্ধ নিষ্ঠুর জাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট, সংকুচিত অক্ষম ও অসহায়। কৃষকের সংখ্যা বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগের ওপরে। সবাই গ্রামে জন্মেছে, কিন্তু ভূমির মালিকানা হারিয়ে কেউ কেউ শহরে চলে এসেছে। কলের শ্রমিক, রেলের কুলি, রিকশা ও ঠেলাগাড়ি ওয়ালারা একদিন সবাই ভূমিবান গাঁয়ের কৃষক ছিল। আজকে শহরের বুকে মূর্তিমান চ্যালেঞ্জরূপেই ওরা গর্বোদ্ধত সভ্যতার মুখোমুখি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

বর্গা কৃষক
গিয়েছিলাম যুগীরঘোপা গ্রামে। জেলা জামালপুরের সদর থেকে দুই-আড়াই মাইল পশ্চিমে গ্রামটি। ইয়াজুদ্দীন মণ্ডল বর্গাচাষী, যার নিজ হালের অধীন ৭ এবং বর্গা ৩ মিলিয়ে মোট ১০ পাখি জমি আছে। প্রায় হাজার লোকের গাঁয়ে সেচকলের সংখ্যা একটি, ভাড়া বার্ষিক আড়াই হাজার টাকা। চার ছেলের মধ্যে ছোট একটিকে স্কুলে পড়তে দিয়েছে। হালকা-পাতলা গড়ন তার, পড়াশোনায় আগ্রহী। পড়ার খরচ চালাতে পারবে বলে সে ভরসা পায় না। জমি ৪-৫ পাখি, মাত্র দুই ফসলা। বাকি জমি এক ফসলা। বছরের খোরাক আগে পাওয়া যেত। এখন তিন-চার মাসের ঘাটতি পড়ে, ধারকর্জ করে চালাতে হয়। এরপর অসুখ-বিসুখে চিকিৎসার খরচ চাপলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়ে। ইয়াজুদ্দীনের বড় ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে। সে এখন জনা ছয়েকের সংসার চালায়। ইয়াজুদ্দীনের পরনে ছেঁড়া ময়লা লুঙ্গি, গায়ে ময়লা মোটা মার্কিন চাদর ফুটিফাটা মাটির মতো মুখ-কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখজোড়ায় গভীর আর্তি। আছে তার হাঁপানি রোগ। লেখাপড়া করেনি, বাবা-মা ওকে সংসারের কাজে আটকে রেখেছে এবং স্কুল ছিল দূরে, এখনো যেমন।

ইয়াজুদ্দীন মণ্ডল আমাকে বসতে দিয়েছিল একটা চেয়ার। সে আমার সামনেই বসেছিল একটা পিঁড়িতে। দুটিই কাষ্ঠাসন হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক মানে পার্থক্য বিরাট। আমি কিছুতেই বর্গাচাষি ইয়াজুদ্দীন মণ্ডলকে আরেকটা চেয়ারে বসতে কিংবা আমার পিঁড়িতে বসার অনুমোদন দিতে রাজি করাতে পারলাম না। সামাজিক অবস্থানগত কারণে বর্গাচাষি ভীত-সংকুচিত থাকে সব সময়। লেখাপড়া জানা মানুষ ওদের কাছে দূরের এবং উচ্চের।

জিজ্ঞেস করলামÑ শরীরে ব্যাধি নিয়ে বাঁচা খুব কষ্টকর। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন না কেন? ম্লান হাসি হাসল সে। মুখে কোনো জবাব ছিল না। জানি, চিকিৎসার খরচ মানে জমি বিক্রি, সংসারে অন্য সবার কষ্ট বৃদ্ধি, স্কুলগামী ছেলেটার ভবিষ্যৎ অন্ধকার করা। সুতরাং ধুঁকে ধুঁকে নিজেই মৃত্যুর দিকে পা বাড়িয়ে আছে।
সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। ইয়াজুদ্দীন আল্লাহর ওপর ভরসা করে জানাল ফসল ভালো হলে ভবিষ্যৎ ভালো। গত চার-পাঁচ বছরে সেই অভিজ্ঞতা তার হয়েছে; ফসল ভালো হওয়ার একটা মাত্র সম্ভাবনার কথাই সে ভাবতে পারে সেচকলের সংখ্যা বৃদ্ধি, গমের চাষ, একফসলি জমিতে দুই ফসল উৎপাদন করা। কিন্তু হতাশ কণ্ঠে জানাল, সেচকল মাত্র একটা। গমের চাষ দু-একজন পাশের গাঁয়ে শুরু করলেও এই গাঁয়ে কেউ করেনি। সারা বছর জমিতে চাষাবাদ করার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।

যুগীরঘোপা গ্রামে ১৬ পাখি জমি আছে মাত্র একজনের। সে নাকি টাকা লগ্নি করে। অর্থাৎ মহাজনী কারবার করে। ১০-১২ পাখি জমি আছে জনা তিনেকের। তাদের অবস্থা সচ্ছল না হলেও খুব খারাপ না। কিন্তু ইয়াজুদ্দীনের মতো তারাও বর্গাচাষি। তবে জমি দুই ফসলি হওয়ায় তাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। গ্রামের ৪০ শতাংশ ইয়াজুদ্দীনের মতো খুব দরিদ্র, অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করে। চাষিবউ কাজের অভাবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় কেউ কাঁথা সেলাই করিয়ে নেয় কি না, ধান ভানতে লোক লাগে কি না জানতে। সরকার ইদানীং খাদ্যের (গম) বিনিময়ে কর্ম আদায়ের যে ব্যবস্থা চালু করেছে, তার ফলে অনেক লজ্জাশীলা কৃষকবধূ ঘরের বাইরে, অর্থাৎ সামাজিক রীতিনীতির বাইরে চলে গেছে। কেউ কেউ গেছে পরিবার পরিকল্পনার নামে। ইয়াজুদ্দীন মণ্ডল সামন্ত মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে ক্ষোভে, হতাশায় ভেঙেও পড়ল। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যদের কাছে এসব দুর্দশার কথা জানাননি কেন? সে জানাল, জানিয়েও ফল পাওয়া যায়নি। তেলা মাথায় তেল দেওয়া ওদের অভ্যাস। জমি হারিয়ে যারা গাঁছাড়া হয়ে যায়, তাদের জমি কেনে কে? ইয়াজুদ্দীন জানাল, টাউনের লোকেরাই। এই গাঁয়ের আশপাশের জমিগুলোর মালিকেরা প্রায়ই টাউনের লোক, যারা হয় সরকারি চাকুরে, নয় ব্যবসায়ী। ইয়াজুদ্দীন মণ্ডল জানে না তার ভবিষ্যৎ কী হবে। সে কারও জমি কিনতে সক্ষম নয়, কিন্তু বিক্রি করতে হলে সবই এক ফুৎকারে শেষ হবে। ‘ওঠরে চাষী জগদ্বাসী’ বলে যতই ডাক দেওয়া হোক, যতই বলা হোক সব দুনিয়ার আহার জোগায় আমার দেশের চাষা; চায়ের সঙ্গে সঙ্গে চাষিজীবনের উন্নতি কিন্তু এখনো প্রত্যাশার ব্যাপার।

বিদায় নিয়ে ফেরার পথে ভাবলাম, সার, কীটনাশক ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি; সেচকলের স্বল্পতা ও জমি অকেজো ফেলে রাখার পরিণাম খুব মারাত্মক হবে। ইয়াজুদ্দীন মণ্ডলরা নির্ঘাত সর্বহারা হয়ে যাবে।
পলাশগড় মাঠের ভেতরে দেখলাম, মছের উদ্দীন নামে জনৈক রাজমিস্ত্রি একটা সেচকল বসিয়েছে তার তিন পাখি জমিতে পানি দিতে এবং পানি বিক্রি করতে। প্রতি একর জমিতে পানি সেচ বাবদ সে আদায় করছে হাজার টাকা। পুঁজিবাদী প্রথায় না হলেও মহাজনী প্রথায় মছের উদ্দীনের মুনাফা গণ্য করা হলেও বলতে হবে যে গ্রামের এই মহাজনরা বর্গাচাষির জমি গ্রাস করবে। কৃষি সেক্টর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার নিশ্চিতভাবেই কৃষিতে মহাজনী প্রতাপ বাড়িয়ে দেবে।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৯ এপ্রিল ২০১৭