ক্যাশলেস সোস্যাইটির দিকে যাচ্ছে ব্যাংকিং সিস্টেম

ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা যদি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চাই, তাহলে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা সম্ভব নয়। প্রযুক্তিকে নিয়েই আমাদেরকে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে ১৬ কোটি লোকের প্রায় ১০ কোটি লোকই এখন মোবাইল-ফোন ব্যবহার করে। অর্থাৎ তারা টেকনোলজির সাথে জড়িত। গ্রামের একজন কৃষক থেকে মাছ বিক্রেতা, এমনকি যাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই, তারাও দিন দিন টেকনোলজির সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবন এখন টেকনোলজি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে তাই টেকনোলজিকে নিয়েই সামনে এগোতে হবে।

নব্বইয়ের দশকে আমি যখন ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু করি, তখন টেকনোলজির ব্যবহার ছিলো না। আর কিছু সেক্টরে থাকলেও তা ছিলো খুবই সামান্য। আমরা হাতে কলমে ব্যাংকিং হিসেব করতাম। ক্লাইন্টকে সাপ্তাহিক, মাসিক কিংবা বার্ষিক যে স্ট্যেটমেন্ট তৈরি করে দিতে হতো, তাও আমরা হাতে করে দিতাম। এক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান এজন্য যে, আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার গতানুগতিক ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর। দুই পরিবেশেই আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকিং সেক্টরে প্রযুক্তির ধারাবাহিক উন্নতি আমার সময়তেই হয়েছে।

ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে আস্তে আস্তে কম্পিউটার আসলো। সিস্টেম কম্পিউটারাইজড হলো, তারপর ডিপোজিট ডিপার্টামেন্ট হলো। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা মূল ব্যাংকিং ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সফটওয়্যার পাইনি। পরে আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ কোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা পেলাম। এখন কোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা হলো অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে আমাদের যে ১৭০টি ব্রাঞ্চ রয়েছে, তার এক ব্রাঞ্চ থেকে অন্য ব্রাঞ্চে আমরা রিয়েল টাইমে লেনদেন করতে পারছি। এটা একদিনে সম্ভব হয়নি, এটা করতে অন্তত ২০ বছর সময় লেগেছে।

আস্তে আস্তে ব্যাংকিং সেক্টরে আমাদের অনেক মর্ডান টেকনোলজির সেবা আসছে। এখন আমরা ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছি। মোবাইলে একটা অ্যাপস ব্যবহার করে ক্লাইন্টরা তাদের নিজেদের একাউন্টের ব্যালেন্স দেখতে পারছে, টপ আপ করতে পারছে, ইউটিলিটি বিল দিতে পারছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে। ইদানিং আবার অনেক ব্যাংক ইলেকট্রনিক ওয়ালেট নিয়ে আসছে। একজন ক্লাইন্ট সে তার প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম এই ওয়ালেটের মাধ্যমে করতে পারবে। মনে করেন, কেউ তার ছেলের টিউশন ফি, হোস্টেলের খরচ দিবে, সেক্ষেত্রে সে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ওয়ালেটে টাকা ট্রান্সফার করতে পারবে।

আমাদের পাশ্ববর্তী দেশসহ উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে ব্যাংকিং সেবাটা এখন মানুষের দোর গোড়ায় চলে গেছে। বাংলাদেশেও এখন এটিএম বুথ আসার কারণে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে তেমন ভিড় হয় না। তারা প্রয়োজনীয় টাকা এটিএম বুথ থেকে উঠিয়ে নিতে পারছে। তাছাড়া আমদের এটিএম ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডগুলো বিভিন্ন শপিংমলে কেনাকাটার জন্যও ব্যবহার করা যাচ্ছে। তার মানে হচ্ছে, আমরাও আস্তে আস্তে ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে যাচ্ছি। আজ থেকে ২০ বছর পরে হয়তো দেখতে পারবেন যে, মানুষ আর নগদ টাকা বহন করবে না।

আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মত দেশগুলোতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন যে, তারা ডলার নিয়ে চলাফেরা করে না। তাদের কাছে ভিক্ষুককে দেওয়ার মতও ডলার থাকে না। এই জন্য সেখানে নতুন একটা অ্যাপস তৈরি হয়েছে। যার মাধ্যমে তারা ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিচ্ছে। হয়তো আমাদের দেশেরও এক সময় দেখা যেতে পারে যে, গুলিস্তানের হকাররা ক্রেডিট কার্ডের পজ নিয়ে বসে আছে, আর আমাদেরকে তাদের ক্রেডিট কার্ডে পাঞ্চ করে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করতে হচ্ছে।

প্রযুক্তি যেমন আমাদের কাজ করা সহজ করেছে, তেমনি ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় যে, সহজেই হ্যাকাররা সফটওয়্যারে মাধ্যম টাকা নিয়ে যাচ্ছে। সেটা মাথায় রেখেই টেকনোলজির সাথে আমাদের পা বাড়াতে হবে। এজন্য আমাদের জনশক্তিকে দক্ষ করে তুলতে হবে। অর্থাৎ তাদেরকে ট্রেনিং করাতে হবে। তারা যখন দক্ষ হবে তখন তারই হ্যাকারদের মোকাবেলা করতে পারবে। তাদের জন্য ট্রেনিং দেওয়া খুবই প্রয়োজন। কেননা টেকনোলজির সাথে কাজ করতে হলে তাদেরকে অনেক দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অবশ্য আজকাল আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে যেসকল ছেলে-মেয়েরা আসেছে, তার অনেক মেধাবী এবং টেকনোলজির সাথে জড়িত। আমি মনে করি, তারা যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবে। তাদের মেধা দিয়েই আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক এগিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং একটি জনপ্রিয় সেবা। আসলে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মূল ব্যাংকিং সেবার বাইরে নয়। মানুষের দোর গোড়ায় যেন ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া যায় সেজন্যই মোবাইল ব্যাংকি, এটিএম, ইলেকট্রনিক ওয়ালেটের মত সিস্টেমকে কাজে লাগানো হচ্ছে। জাতি যত শিক্ষার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের ব্যাংকিং সেবাটাও প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের রিটেইল ব্যাংকিং সেক্টরে যারা কাজ করেন তারা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব দ্রুতই লোন প্রসেসিং করে যাচ্ছে। হয়তো আমরা এখনও পরির্পূণভাবে টেকনোলজি ব্যবহার করে লোন প্রসেস বা বিনিয়োগ দিতে পারছি না। তবে একটা সময় হয়তো পরির্পূণভাবে টেকনোলজিকে ব্যবহার করে লোন প্রসেস করা হবে। তখন দেখা যাবে, কোনো গ্রাহক আমাদের ব্যাংক থেকে লোন বা বিনিয়োগ সেবা নিতে চাইলে, সে তার তথ্য একটা সফটওয়্যারের মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছে। আর সে অনুযায়ীই সে ২৪ ঘন্টার মধ্যে একটা ফিডব্যাক পেয়ে যাবে। এখন যেমন আমরা খুব দ্রুত ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দেওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত করতে পারছি যে, কাকে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিবো, আর কাকে দিবো না। ঠিক সেভাবেই আমরা আস্তে আস্তে পরির্পূণভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যমে দ্রুত লোন দিতে পারবো বলে আমি আশাবাদী।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিলো প্রায় ২৪ বছর পূর্বে। আমরা ইসলামী ব্যাংকিং করেছিলাম মানুষের সেবার লক্ষ্যে। সেই সেবা দিতে গিয়ে আমরা মানুষকে টেকনোলজি সংশ্লিষ্ট সেবাও দিচ্ছি। বর্তমানে আমাদের প্রায় ১০০টি এটিএম বুথ আছে। আমাদের লক্ষ্য দ্রুত ৩০০ এটিএম বুথ নেটওয়ার্ক তৈরি করা। যাতে আমাদের গ্রাহকরা খুব সহজে সেবা পেতে পারে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ডিপোজিট প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। আমাদের এজেন্ট ব্যাংক আছে ১১০টা। এজেন্ট ব্যাংক একটা অন্য ধরণের সেবা। এর মাধ্যমে যারা ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির বাইরে আছে তাদেরকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে। এগুলো কিন্তু টেকনোলজি ও প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত সেবা।

এখনও যারা টেকনোলজি সংশ্লিষ্ট সেবা নিতে পারছে না, তাদের জন্য আমরা পূর্বের গতানুগতিক সেবা দিয়ে যাচ্ছি। অবশ্য সেই সেবা নিতে হলে পূর্বের মত আমাদের ব্যাংকের কাউন্টারে স্বশরীরে আসতে হচ্ছে। তবে যারা স্বশরীরে এসে সেবা নিতে চাচ্ছে না, তাদের জন্য রয়েছে টেকনোলজিক্যাল সেবা। সুতরাং আমরা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকও কিন্তু এখন পিছিয়ে নেই। এসআইবিএলও সেকেন্ড জেনারেশন ব্যাংক। আমাদের যে ক’টা সেকেন্ড জেনারেশন ব্যাংক আছে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। কেউ হয়তো আমাদের থেকে পিছিয়ে আছে, কিংবা কেউ এগিয়ে আছে। কিন্তু আমরা সবাই এক তালে এগিয়ে যাচ্ছি।

আবদুল হান্নান খান
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড