খাঁটি খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে : রাসেল-উজ-জামান

ভেজালমুক্ত খাদ্য পরিবেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয় রওজা ফুডের। প্রথমে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হলেও এখন বেশ জনপ্রিয় এই ফুড। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল-উজ-জামান বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন আজকের বাজার ও এবিটিভির সঙ্গে। আলোচনার চুম্বক অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বাংলাদেশে ব্যবসার সার্বিক সর্ম্পকে এটুকু বলতে পারি যে ব্যবসা কতে সরকারি সহযেগিতা খুব একটা পাওয়া যায় না।
সেদিক বিবেচনা করে আমি সরকারের সার্বিক সহযোগিতার আহ্বান জানাবো।

রওজা ফুডের শুরু  যেভাবে
আমি ঢাকায় একটা ব্যাংকে চাকরি করতাম। এরপর নিজেই ব্যবসা শুরু করার কথা চিন্তা করি। এ পর্যায়ে ভাবলাম কী ব্যবসা করা যায়।  যে ব্যবসাই করতে চাই দেখি সেটা আগেই আছে কিংবা এগুলোতে প্রচুর ভেজাল কিংবা চুরি- চামারি করতে হয়! ভাবলাম ন্যাচারাল আইটেমের দিকে যাই। আমি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছি ফলে জানতাম গ্রামে কী কী পাওয়া যায়। বিশেষ করে এই যেমন মনে করেন ত্রিফলা মিকশ্চার। এখন কিছু পাওয়া যায় কিন্তু তা আগে একেবারেই পাওয়া  যেতনা। ভাবলাম যেগুলোকে  কেউ  প্রোডাক্ট বলে ভাবে না কিন্তু  সেগুলো মানুষের দরকার আমি ওগুলোকেই  প্রোডাক্ট হিসেবে বাজারে আনবো। মধু তেমনি একটা  প্রোডাক্ট। এটা  যে খাঁটি পাওয়া যায় মানুষ তা ভাবতেই পারতো না। আবার ঘি খাঁটি হয় মানুষ তা বিশ্বাসই করত না।  আমি ভাবলাম মানুষকে পিওর খাওয়াব। মধূু দিয়ে শুরু করলাম। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটা আউটলেট নিয়ে বসলাম। প্রথম বছর আউটলেটে বিক্রি হলো সাড়ে তিন মণ মধু। ওই একই আউলেটে ১০ বছর পর মধু বিক্রি হচ্ছে  সাড়ে ১২ টন। এটা হয়েছে শুধু খাঁটি জিনিসের কারণে। এরপর মার্কেটে  ঢোকার চেষ্টা করলাম। এখানেও প্রচুর বাধা। আমি আমার প্রোডাক্ট ডিমার্টমেন্টাল স্টোর  আর  খুচরা দোকানে দিতে গিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়লাম। উদাহরণ দিই, যেমন একটা দোকানে আমার রওজা সরিষার তেল আছে আবার একই দোকানে তীর সরিষার তেল আছে, সয়বিন তেলও আছে। ওই কোম্পানির প্রোডাক্ট ধরেন ১৪টা আর আমার ৩ টা।  তো তারা বলে কী ,তোমার দোকানে যদি রওজা সরিষার তেল বিক্রি করো তবে আমার ৫০ টা  প্রোডাক্ট দেওয়া বন্ধ করে দিব। দোকানিও জানে আমার প্রোডাক্ট ভালো তার পরও বাধ্য হয়ে আমারটা  বন্ধ করে  দেয়। এভাবেই বড়  কোম্পানিগুলো ছোট ও নতুন উদ্যোক্তারে এগোতে দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই আউটলেট দিতে শুরু করি। এভাবে ১০ আউটলেট আছে আমার। ধানমন্ডিতেই ৪টা। অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানীতেও আছে। মানুষ আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। একসময় কৃত্রিম খাবারে আগ্রহ ছিল গ্রাহকদের কিন্তু তারা দেখেছে এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না। তাই অর্গানিক কিংবা ন্যাচারাল খাবারে আগ্রহ বাড়ছে। আমার এখন ৭০টা আইটেম আছে।

চ্যালেঞ্জ কী
প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা।  যেমন ধরেন মধু। মধু আগে শুধু ছিল এপি’র আর এখন প্রাণেরও আছে স্কয়ারেরও আছে। বড়  দোকানে তো আমারটা বাদ দিয়ে প্রাণ আর স্কয়াররটাই রাখবে। আর তারা  রেটও বাড়িয়ে ধরে। এভাবে আমদের মত  ছোট উদ্যোক্তারা যে কম রেট দিয়ে আস্তে আস্তে ওঠবে এ অবস্থাও  নেই। আমি  দোকানদারকে নিজের টাকা দিয়ে রাখতে বললেও রাখবে না, ওই প্রাণেরট, স্কয়ারেরটাই তারা রাখতে চায়।এ ভাবে পুঁজির কাছে মার খাচ্ছি আমরা।

ভালো সাড়া পাচ্ছি
মানুষের ভালোই সাড়া পাচ্ছি। সাড়া না পেলে তো ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতে হতো। ধানমন্ডি- মোহাম্মদপুর- শ্যামলী এলাকা কেন্দ্রিক ব্যবসা আমার। ধানমন্ডিতেই ৪টা আউটলেট আছে। এসব এলাকায় ৭-৮টা আউটলেট আছে। এলাকার মানুষও চিনছে আমাদের । ২০১৭ সালে আরো ১০টা আউটলেট করার চিন্তা আছে। উত্তরা, বনানী, খিলক্ষেত এলাকায় হবে এগুলো। এখন আছে ১২টা।  প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠেছি। মানুষ ভালো জিনিসই খেতে চায়। এদিক বিবেচনা করে মনে হচ্ছে, একসময়  ভোক্তারা অন্যটা না খেয়ে আমার জিনিসই  খেতে চাইবে। দাম কোনো ব্যাপার হবে না।  ঘি বাইরে এক হাজার হলে আমারটা ২ হাজারেও কিনতে চাইবে। যেহেতু আমারটা পিওর। ব্যবসা বাড়ানোর এটাও একটা কারণ।

অন্যদের তুলনায় আমাদের পার্থক্য
আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য, আমরা যে পিওর বলি, কেন বলি? আমাদের  কোনো সাপ্লায়ার নাই। আমরা নিজেরাই পণ্য সংগ্রহ করি। যেমন মধুর ব্যবসা করতে গেলে মধু খাঁটি কি না তা বুঝতে হবে। এটা  বোঝার জন্য আমি সায়েন্স  ল্যাবরেটরি গিয়েছি, বিএসটিআইয়ে গিয়েছি, প্রশিকায় গিয়েছি, বিসিকে গিয়েছি, এপিতে তো গিয়েছিই। তারা সবাই বলেছে মধু খেয়ে  কোনোমতেই খাঁটি না ভেজাল তা  বোঝা যাবে না। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুই রকমের মধুই  তো বিভিন্ন ফুল থেকেই হচ্ছে। কৃত্রিম মধুর মধ্যে যদি প্রাকৃত্রিক মধুর উপাদান মিশিয়ে  দেওয়া য় তাহলে বোঝা যাবে না  কোনটা কী? তাহলে, একমাত্র উপায় হলো আমার সামনেই যদি মধু কাটা হয়।  যে হেতু আমার সামনেই মধু কাটা হয় তাই আমরা পিওর, শিওর হয়েই বলি। আমাদের নিজেদের  যেমন ফার্ম আছে, দরকার হলে সুন্দরবনের  ভেতরে গিয়েও আমরা মধু কাটি। পাশাপাশি আমাদের অনেক দরকার হয় আমরা বইরের ফার্ম থেকেও কিনি। এরকম ঘিয়ের বেলায়ও আমরা নিজেদের ফ্যাক্টরিতে ক্রিম কাটি প্রসেস করি। তার পর প্যাকেট করে বাজারে দিই। বাজারে মদের পণ্যের    টেস্টও দরকার হয় না। মানুষের শরীরই একটা  মেশিন, শরীরই খায়, এই মেশিনই বলে দিবে  কোনটা আসল  কোনটা নকল।

প্রসঙ্গ ভ্যাট
আমার প্রোডাক্ট সবই এগ্রো প্রোডাক্ট ফলে ঘি, মধু,সরিষার তেলে ভ্যাট হয় না। তার পরও মাঝে মাঝে অফিসের লোকজন এসে ভ্যাট চায় তখন সামলাতে হয় পরিস্থিতি। উৎপাদনের সময় ১৫ ভাগ, নিজের দোকনেই বিক্রি করার পর ৪ ভাগ, এই ১৯ ভাগ ভ্যাট দিলে ব্যবসা করব কোথায়?

নতুন প্রোডাক্টের সম্ভাবনা
আমার সেক্টরে ব্যবসার সম্ভাবনা প্রচুর কেননা এসব পণ্য প্রাকৃতিক। এর আবেদন চিরন্তন। তবে ব্যবসায় একশ’ ভাগ সততা থাকতে হবে। থাকতে হবে বিষয় সম্পর্কে ভালো জ্ঞান।

আমি নতুন একটা পণ্য বাজারে আনতে যাচ্ছি। বেলের শরবত। বাজারে অনেক কোম্পানির অনেকরকম জুস আছে। এগুলোর প্যাকেটে উল্লিখিত উপাদানের কয়টা এসবে আছে? আমার বেলের শরবত হবে লিকুইড। এটা অনেক বড় প্রকল্প। তবে চেষ্টা করছি ভালো কিছু করতে।

আমার দাবি
দাবি বলতে সরকারের কাছে আমি বলতে চাই।বিএসটিআয়ের মত আমামাদের  প্রোডাক্টগুলোর জন্যও যদি আলাদা ধরনের কোনো সার্টিফিকেশনের দিকে যাওয়া যায় তাহলে ভালো হয়। ক্রেতারাও এতে আশ্বস্ত হবেন, আমরাও স্বস্তি পাব। আমাদের কাছে ক্রেতারা জানতে চায় আমার পণ্যে বিএসটিআই কোথায়? তাদের বুঝিয়ে বলতে হয় আসলে ১৫৪টা ছাড়া অন্য পণ্যের বিএসটিআই হয় না। ধরেন, চাল, চালে কি বিএসটিআই আছে? চাল কিন্তু আমরা প্রতিদিন প্রতিবেলা খাই। মাছের বেলায়ও তাই।

নতুনদের জন্য পরামর্শ
নতুন ব্যবসায়ীদের অন্তত তিনটা জিনিস থাকতে হবে। প্রথম, উচ্চাকাক্সা থাকতে হবে, দ্বিতীয়ত,সদিচ্ছা থাকতে হবে যে আমি এটা করবোই এবং তিন নম্বর মনোবল থাকতে হবে। আমার  সেক্টরে টিকতে হলে নতুন ব্যবসায়ীকে প্রথমেই পিওর জিনিস দিয়ে ধৈর্য্য ধরে টিকে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই।  যেহেতু এটা ন্যাচারাল তাই এর সম্প্রসারণে প্রচারটা করতে হবে। আর কাস্টমারদের পণ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে। গ্রামীণ প্রযুক্তি ছাড়া আমি কোনো পণ্যের সংরক্ষণ করি না। কারণ এটিই হলো আসল প্রযুক্তি।  কোনো ধরনের মৌসুমি ফলের আচারে আমি যাই না। কারণ মৌসুমের পরে এটি আপনি কিভাবে সারাবছর সংরক্ষণ করবেন প্রিজারভেটিভ ছাড়া? মধু,ঘি এসব পুরোনো হলেও নষ্ট হয় না। আমার এখানে সারাবছরই এগুলো থাকে আর আচারের মধ্যে থাকে কেবল রসুনের আচার। কারণ রসুন সারাবছরের পণ্য।

রওজা পিওর ফুড নিয়ে  পরিকল্পনা
আমার এখন ৭০ টা পণ্য নিয়ে ব্যবসা। আউটলেট আছে ১২টা। এ বছরই আরো ১০টা হবে। আগামি ২০২০ সালের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মিলিয়ে আমি অন্তত ৩০০টি আউটলেট করতে চাই। যাতে মানুষ  খাঁটি-প্রাকৃতিক খাবার খেতে পায়। মানুষকে পিওর খাবার দেওয়া আমার কাছে শুধু ব্যবসা নয় এটা আমার কাছে একটা ইবাদতের মতো। খাওয়ানো ও ইবাদত দুটোই আমার কাছে সমান গুরুত্বের।  আমার ব্যবসার বড় প্রচার মাপধ্যম আমার গ্রাহকরাই। একজন  কাস্টমার আরো ১০জনকে নিয়ে আসতে পারেন। এ ছাড়া প্রচারের জন্য আরো আছে স্যোসাল মিডিয়া, ই-কমার্স, টেলিভিশন আর পত্রিকা, লিফলেট আছেই। সারাদেশের মানুষকে খাঁটি খাবার খাওয়ানো আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আরো অনেককেই এ ব্যবসায় এগিয়ে আসতে হবে।

রাসেল-উজ-জামান  
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
রওজা পিওর ফুডস লিমিটেড

আজকের বাজার: আরআর/ ২৪ মে ২০১৭