গঠনমূলক বাজার তৈরি করতে হবে

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড। কোম্পানিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিওও’র দায়িত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ আলী। পুঁজিবাজারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আজকের বাজারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তিনি। আলোচনার মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

পুঁজিবাজার  একটি স্বতন্ত্র বাজার। এখানে ক্যাটাগরির ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে দুই-একটা কোম্পানির বাজার  কিংবা বলতে পারি শেয়ার দর খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার দ্রুত তা সংশোধনও  হয়েছে। আর এই বাজার বাড়ার ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ এখান থেকে সুবিধা নিয়েছে। এটা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানো হয়েছে।  কোম্পানিগুলো কায়েন্টদের প্রভাবিত করে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে কি না বা সেল করেছে কি না; সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বলা হয়েছে তাদের। বাজারে এখন রিসার্চ অ্যানালিস্টদের একটা ভূমিকা দেখা যায়। তারা বিভিন্ন সময়ে বলেন, এটার দাম বাড়বে বা এটার দাম কমবে। তারা কোম্পানি থেকে ইনসাইড ইনফরমেশন নিয়ে নেন।
অনেক সময় দেখা যায় একটা কোম্পানির আর্নিং বেড়েছে অথচ দাম বাড়েনি। এক্ষেত্রে দেখা যায়, আর্নিং ডিসকোজের আগেই কোম্পানি তার শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ইনফরমেশন পাওয়ার আগেই কিছু মানুষ ওই ইনফরমেশন পেয়ে যায়। তারা এটাকে ক্যাপিটালাইজ করে বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।

বাজারে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু কোম্পানির সেল বাড়লেও আর্নিং বাড়ে না। আবার কিছু কোম্পানির সেল বাড়ে না অথচ আর্নিং ঠিকই বেড়ে যায়। অর্থাৎ মালিক বা আমাদের ভাষায় বলে বেনিফিসিয়ার ওনার্স; তাদের পারপাস সার্ভ করার জন্য ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্টকে প্রভাবিত করা হয়। এটাকে কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগকারিদের অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এ ছাড়া আমরা বাজারে যে স্বাভাবিক আচরণ আশা করি সেটা পাওয়া যায় না। বাজার দ্রুত আপ এন্ড ডাউন হওয়ার যে বিষয়টি এটা হচ্ছে নন স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট।

স্ট্রাকচার-ওয়ারি ডেভেলপমেন্ট হলে একটা কোম্পানির আর্নিং ২০ শতাংশ বাড়লে তার শেয়ার বড়জোর ১৫, ২০ বা ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। আবার দেখা যায় অনেক শেয়ার দ্বিগুণ হয়ে যায়। বলা যেতে পারে এটা আন্ডার প্রাইস সেল। কিন্তু দ্রুত তো আন্ডার প্রাইসে যাওয়া উচিত নয়।

অডিট হচ্ছে কোম্পানির  আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী অডিটিংয়ের  শুধু একটা সার্টিফিকেশন দেওয়া। সুতরাং সততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা রাখা কোম্পানির নিজের দায়িত্ব¡। অডিটরের দায়িত্ব¡ হচ্ছে মতামত দেওয়া।  কোম্পানি ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টের মতো জিনিসগুলো ডিসকোজ করছে কি না,  এ সব অডিটর বলে দেয় তার রিপোর্টে। অডিটরের এই রিপোর্ট বেইজড এন্ড ইনফরমেশন প্রিপেয়ার্ড বাই দ্য ম্যানেজমেন্ট। সুতরাং এর পুরো দায়িত্ব¡টাই হচ্ছে ম্যানেজমেন্টের । অডিটরের দায়িত্ব একদমই কম। কারণ অডিটর একটা সনদ দেয়, এটার পুরো সত্যতা যাচাই করে না। যেমন সবুজের শরীরের রোগ নির্ণয় করার জন্য কিছু টেস্ট দেয়া হলো এবং তার উপর ভিত্তি করেই ডাক্তার বললেন যে সবুজ ঠিক আছে। কিন্তু সবুজের ভিতরে তো ক্যানসারও থাকতে পারে ? তেমনি কোম্পানির ভেতরের অবস্থা মূলত চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার বা সিএফও এবং কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট, যারা ডিরেক্টর, এমডি, চেয়ারম্যান তারা ভালো জানেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ি সিএফও এবং এমডিকে এসবের জন্য দায়ী করা হয়। অডিটর হচ্ছে সেকেন্ড রেসপনসিবল।

পুঁজিবাজারে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা
ইন্টারন্যাশনাল সার্ভেইল্যান্স অ্যাক্ট প্র্যাকটিস করে সাধারণত কোম্পানির সিএফও ও এমডি কনফারেন্স করেন এবং বলেন কী কারণে আয় কমেছে বা বেড়েছে। তারা রেগুলেটর ও ইনভেস্টরদের কাছে  পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। আমাদের এখানে ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্টকে বিশ্বস্ততা এবং জবাবদিহিতার মধ্যে আনার জন্য রেগুলেটরি বডির সক্ষমতা এখনও গড়ে উঠেনি। তবে কাজ চলছে । আমাদের পুঁজিবাজারের বয়স তো অনেকদিনের নয়, তাই দক্ষ লোকবলের অভাব আছে।
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আমাদের রেগুলেটরি আইন করা উচিত। প্রত্যেকটা কোম্পানির আর্নিং প্রকাশের সময় আর্নিং কমলেও বলতে হবে কেন কমেছে এবং বাড়লেও বলতে হবে কী কারণে বেড়েছে। আমি অনেক কোম্পানি দেখেছি যারা দেখিয়েছে কোম্পানির সেল বেড়েছে কিন্তু নিট প্রফিট কমেছে।

আমাদের পুঁজিবাজারের রেগুলেটরি অথরিটিরর এখন সময় এসেছে টেকনিক্যাল সাইড ডেভেলপ করার । এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে বোর্ড অব ডিরেক্টর ডিভিডেন্ড নিয়ে যা রিকমেন্ড করবে তাই হবে, যা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারে না।  বেশ কিছু মামলায়ও দেখা গেছে এটা প্রতষ্ঠিত হয়ে গেছে। অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থাকে বোর্ড অব ডিরেক্টরের হাতে। যার ফলে করপোরেট গভর্নেন্স বা সুশাসনের অভাব দেখা যায়।

আমাদের দেশে বিনিয়োগকারিদের প্রত্যাশা শুধু বোনাস শেয়ার পাওয়া। অথচ বোনাস শেয়ার দিলে শেয়ার সাপ্লাই বেড়ে যায়। ফলে শেয়ার প্রতি আয় কমে যায় এবং শেয়ারটা দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু  মাল্টিন্যশনাল কোম্পানিগুলো বোনাস শেয়ার দেয় না। ক্যাশ-ডিভিডেন্ড দেয় ফলে মার্কেট বড় হয় । আমাদের এখানে এটা করা হয় না। কারণ ক্যাশডিভিডেন্ড দিলে অর্থ কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যাবে এবং কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরদের ট্যাক্স বেশি দিতে হবে। ফিনান্সিয়াল সচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মধ্যে না আনলে পুঁজিবাজার আসলেই  ডেভেলপ করা খুব কঠিন।

বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে
বাজার স্থিতিশীল করার জন্য সরকার যেমন কাজ করছে তেমনি আমরাও কাজ করছি। তবে বাজারকে যারা প্রভাবিত করে তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিত। আইনে আছে আমি শেয়ার কিনতে পারব। তাই বলে একদিনে যত খুশি শেয়ার ক্রয় এবং বিক্রি করে বাজারকে প্রভাবিত করাও উচিত নয়। তাই যারা এইরকম কাজের সাথে জড়িত তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। এ কাজের জন্য রেগুলেটরির নিজস্ব বাহিনী থাকা উচিত, নিজস্ব অন্য ব্যবস্থাও থাকা দরকার।
স্ট্রাকচারাল ইনভেস্টমেন্ট করা উচিত । একজন বিনিয়োগকারি যখন বাজারে আসে তখন তার পুঁজিটাকে ৩ ভাগে ভাগ করে বিনিয়োগ করা উচিত। তবে বিনিয়োগকারির পুঁজি  অনুযায়ী এটা করা যেতে পারে। বড় বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে এটা খুব কার্যকর। তারপর সেক্টর অনুযায়ী বিনিয়োগ করা যায়।

প্রসঙ্গ : ইনফরমেশন লিকেজ  
বিদেশে ইনফরমেশন লিকেজ বন্ধ করার জন্য হুইসেল ব্লোয়ার আছে। তাদের জন্য ইনসেনটিভ আছে। কিন্তু আমাদের দেশে নেই। ইনফরমেশন লিকেজ বন্ধ করার জন্য  আমাদের পুঁজিবাজারের রেগুলেটরি বডিরও নিজস্ব বাহিনী দরকার। ইনসেনটিভ ঘোষণা করা যেতে পারে হুইসেল ব্লোয়ারদের জন্য । যেমন আমাদের পুলিশসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীতে সোর্স মেইনটেইন করার ব্যবস্থা আছে।  পুঁজিবাজারে হুইসেল ব্লোয়ার থাকবে যারা ইনফরমেশন কালেক্ট করবে কারা এই কাজের সাথে জড়িত তাদের  খুঁজে বের করবে। তাহলে  হয়তো খুব দ্রুত এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।
এখন আমাদের বাজার ভালো থাকার কথা ।  বাজার ভালো থাকার বেশ কিছু কারণ রয়েছে । তবে বাজার খুব দ্রুত উঠানামা করায় আস্থার জায়গাটা সেভাবে গড়ে উঠেনি। ইথিক্যাল জায়গাটা  সবারই চর্চা করা উচিত।

ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজ
ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজের স্ট্রং রিসার্চ টিম আছে। আমাদের  বিশেষত্ব হচ্ছে  আমরা বিনিয়োগকারিদের সঠিক গাইডলাইন দেওয়ার চেষ্টা করি । আমরা ইনভেস্টরদের প্রভাবিত করি না  শেয়ার কেনা -বেচার জন্য। অন্যরা ট্রেডিং করে  টপে থাকার জন্য, বিনিয়োগকারিদের বাই-সেল করতে উৎসাহিত করে। আমরা তা করি না এবং আমরা বিনিয়োগকারীদের লোন নিতেও উৎসাহিত করি না ।  আমি মনে করি ছোট বিনিয়োগকারী যারা মার্কেট কম  বুঝে তাদের লোন নেওয়া উচিত নয়। আমরা রিসার্চ অনুযায়ী কোম্পানির ইনফরমেশন বিনিয়োগকারীদেরকে দিই। আর  সিদ্ধান্ত  যা নেওয়ার তা  বিনিয়োগকারীরা সম্পূর্ণ নিজে থেকেই  নেন।

আজকের বাজার: ডিএইচ/আরআর/০৪ মে ২০১৭