গরু পালনে ঝুকছে দেশি খামারিরা

নানা দোলাচলে স্বল্প পরিসরে গরু পালন করে বেশ লাভ হওয়ায় নতুন উদ্যোমে বৃহৎ আকারে গরু পালন শুরু করেছে দেশের অধিকাংশ খামারি। ভারতীয় গরুর ভিড়ে দেশে গরু পালন করে লাভবান হওয়া যাবে কি-না, তা নিয়ে অজানা আশঙ্কায় দিন কাটছিল গরুর খামারিদের। গরু নীতিতে ভারত সরকারের কঠোর অবস্থানের পরও ঈদের ঠিক আগে গণমাধ্যমে প্রচার হতে থাকে- ভারত গরু নীতিতে কিছুটা শিথিল করেছে। গরু আসছে পাশের রাষ্ট্র মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান থেকে। এ অবস্থায় বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হবে এটাই ভাবছিল খামারিরা। শেষ পর্যন্ত কোরবানির হাটে বানের স্রোতের মতো ভারতীয় গরু আসেনি। নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের গরুও ছিল কম। কোরবানির পশুর হাট জুড়ে ছিল দেশি গরুর আধিপত্য। ফলে, খামারিদের উৎপাদিত গরু ভালো দামে বিক্রি করতে তেমন একটা অসুবিধা হয়নি। কোরবানির হাটে গরু বিক্রির পর খামারের জন্য গরু কিনতে বিভিন্ন পশুর হাট চষে বেড়াচ্ছে তারা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন খামারিরাও। লক্ষ্য আগামী কোরবানি ঈদের আগে গরু বড় করে বাজারে বিক্রি করা। খামারি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে চাহিদা মাফিক গরু পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। তাই বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এরপরও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী কোরবানির ঈদে আরো বেশি লাভবান হওয়ার আশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গরু খামারিদের সঙ্গে কথা বলে নতুন উদ্যোমে গরু পালনের এই নানা তথ্য উঠে এসেছে।

গরু উৎপাদন কারে মোটা অংকের অর্থ পেয়ে খুশি খামারিরা। ভারত থেকে আগের মতো গরু না আসায় এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তারা। খামারিদের অনেকে মনে করেন, ভারত থেকে গরু আসা চিরতরে বন্ধ হলে গরু পালন করে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এতে দেশ অর্থনীতিকভাবে এগিয়ে যাবে দেশ। গড়ে উঠবে গরু উৎপাদনে সহায়ক নতুন-নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দুগ্ধ খামার।

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার খামারি নয়ন হোসেন দীর্ঘদিন ধরে গরু পালন করছেন। বাড়ির গোয়ালে রেখে বছরে দুই থেকে তিনটা গরু পালনের মধ্য দিয়ে দশ বছর আগে তার পথ চলা শুরু। এরপর নিজ উদ্যোগে বাড়ির পাশেই একটি গরুর খামার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১০টি দিয়ে শুরু হলেও এখন সারাবছর ৩০ থেকে ৪০টি গরু তার খামারে থাকে। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর বাজারে মাংসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ঈদের আগেই অধিকাংশ গরু বিক্রি করেন তিনি। বিক্রি করার মতো ১২টি গরু কোরবানির পশুর হাটে তুলে ভালো দাম পেয়ে খুশি আবুল হোসেন। তিনি বলেন, কেরবানির পরপরই খামারে গরু বৃদ্ধির জন্য ছোট আকারের গরু কিনতে বিভিন্ন হাটে ছুটে বেড়াচ্ছি। কয়েকদিন আগে আবাদের হাট থেকে তিনটি বাছুর গরু প্রতিটি ৩০ হাজার টাকা দামে কিনেছি। এক বছর ভালোভাবে লালন পালন করতে পারলে ওই গরু ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।

সাতক্ষীরা সদরের আগরদাঁড়ী ইউনিয়নের খামারি মতিন মিয়া বলেন, চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বাড়িতে গরু পালন করতাম। এবার ওই গরু ভালো দামে বিক্রি করেছি। গরু পালনে ভবিষ্যতে লাভবান হওয়া সম্ভব এই চিন্তা থেকে কোরিয়া প্রবাসি এক বন্ধুর সহায়তায় একটি গরুর খামার গড়ে তুলেছি। ইতিমধ্যে সাতটি গরুও কিনেছি। বিভিন্ন হাট ঘুরে আরো গরু কেনার চেষ্টা করছি। এবছর ৪০ থেকে ৫০টি গরু পালন করবো এ লক্ষ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজধানীর গাবতলী পশুর হাটে কোরবানির ঈদে গরু বিক্রি করতে ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন মিজান ব্যাপারি। নিজের খামারের ১৪টি গরু এনে প্রতিটি ভালো দামে বিক্রি করেছেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, গরু বিক্রির পর আগামী কোরবানির ঈদকে উদ্দেশ্য করে গরু কেনার জন্য বিভিন্ন হাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি। লাভ বেশি হওয়ায় নতুন আগ্রহ নিয়ে গরু উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছি। আশা করছি অন্যান্য খাতের ন্যায় গরু পালনও লাভজনক খাতে পরিণত হবে। কুষ্টিয়ার ছগির বিশ্বাস বলেন, বেশি দামে গরু বিক্রি করতে পেরে বেশ ভালো লাগছে। সেকারণে গরু পালনের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগের খামারিদের পাশাপাশি বহু নতুন মানুষ গরু পালনে আগ্রহী হয়েছে। গরু পালন বেশ লাভজনক হওয়ায় অনেকে এই পেশায় ঝুঁকছেন। ভালোভাবে ৫টি গরু পালন করতে পারলে সব বাদ দিয়ে সহজেই বছরে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিভাগের কর্মকর্তা ডাক্তার রুহুল আমিন বলেন, সাধারণ মানুষ যেভাবে গরু পালন শুরু করেছে এই ধারা অব্যহত থাকলে আগামী কয়েক বছরে দেশে গরুর অভাব হবে না। দেশের প্রতিটি প্রাণিসম্পদ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গরু পালনে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন অন্যরকম উৎসাহ কাজ করছে। উৎপাদন বাড়াতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে খামারিদের সার্বিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অজয় কুমার রায় বলেন, ভারত গরু দেওয়া বন্ধ করে আমাদের বড় ধরনের উপকার করেছে। দেশটি এ সিদ্ধান্ত আরো ১০ বছর আগে নিলে এতোদিনে আমারা গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতাম। এখন নিজেদের প্রয়োজনে গরু পালন করতে হবে। বিষয়টি সাবাই বুঝতে পেরেছে। খামারিসহ সাধারণ মানুষ গরু পালনে এগিয়ে আসছে। আমরাও নানাভাবে খামারিদের উৎসাহিত করছি। সার্বিক সহয়তা দিনে সব অঞ্চলের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিবিড়ভাবে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

আজকের বাজার: আরআর/ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭