গ্রামে এটিএম বুথ, বাঁচাবে কৃষকের কর্মঘণ্টা-যশোদা জীবন দেবনাথ

গ্রামে কৃষকের জন্য এটিএম বুথ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। উপজেলা শহরে গিয়ে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা ওঠানোর বিড়ম্বনা কমাতে এবার গ্রামে কৃষকের জন্য এটিএম বুথ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে রাকাব। প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক লেনদেন সহজতর করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানায় তারা। আগামী এক বছরের মধ্যেই প্রান্তিক কৃষকেরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বাড়ির পাশের এটিএম বুথ থেকে অনায়াসে টাকা তুলতে পারবেন বলেও জানিয়েছে রাকাব। এ বিষয় আজকের বাজারের সঙ্গে কথা বলেন এটিএম বুথ বিশেষজ্ঞ,দেশের ৬০ ভাগ এটিএম বুথ স্থাপনকারী ব্যবসায়ী যশোদা জীবন দেবনাথ। গ্রামে এটিএম প্রতিষ্ঠা কতটা সম্ভব,এতে সফলতা আসবে কিনা,লোডশেডিং বুথ অচল করবে কিনা,কৃষকের জন্য এটিএম ব্যবহার কতটা সহজ হবে-এমন অনেক প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন, কাজী লুৎফুল কবীর।

আজকের বাজার: রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, এক বছরের মধ্যে তাদের সব শাখার আওতায়, গ্রামে কৃষকের জন্য এটিএম বুথ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে,এটা আপনি কিভাবে দেখছেন?
যশোদা জীবন দেবনাথ: বাংলাদেশে এখনো চালু হয়নি, তবে গ্রামে এটিএম বুথ ব্যতিক্রমী কোনও বিষয় নয়। সারা বিশ্বেই এটা আছে অনেকে আগে থেকেই। পার্শ্ববর্তী ভারতেই যদি দেখেন,সেখানে কৃষকদের জন্য “কৃষক এটিএম” করা হয়েছে। আরও অনেক দেশে এ ধরনের কিছু ছোট ছোট এটিএম চালু আছে। মানুষ তা ব্যবহার করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আছে। বাংলাদেশ যদিও এখন মাত্র শুরু করছে,তারপরও বলব ডিজিটাইজেশন করতে হলে গ্রামগঞ্জের লোকজনকে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে হবে। সহজলভ্যভাবে তারা যদি ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা পায়,একেবারে দোরগোড়ায় বসে,তাহলে দেশকে পূর্ণাঙ্গভাবে ডিজিটাইজেশন করা সম্ভব হবে। কৃষকদের জন্য গ্রামে এটিএম বুথ যদি করা যায়,তাহলে এর সাফল্য অবশ্যই আসবে। আর এমন উদ্যোগ নেয়ার জন্য রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে।

আজকের বাজার: গ্রামে এখনও অনেক সুযোগ-সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত হয়নি,তাহলে প্রযুক্তি নির্ভর এটিএম কী করে সম্ভব?

যশোদা জীবন দেবনাথ: দেখুন, ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়, যেভাবে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করার কাজ এগিয়ে নিয়েছেন তাতে করে কানেকটিভিটি একেবারে গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ৪ হাজার ৪৬০টি গ্রামে ব্যান্ডউইথ কানেকটিভিটি পৌঁছে গেছে। যদিও এটা বিটিআরসি এখনও উন্মুক্ত করেনি,কিন্তু এসব জায়গায় যখন ইন্টারেনেট কানেকটিভিটি পৌঁছে যাবে,তখন গ্রামের মানুষেরাও শহরের মানুষের মতোই একই সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এটা খুবই উপযোগি হবে। তথ্যভান্ডার গ্রামে চলে যাবে। গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়বে। গ্রামের মানুষ সহজে ব্যাংকিং সুবিধা পাবে। সার্বক্ষণিক সেবা পাবে। আর তাহলে এটিএম বুথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আজকের বাজার: গ্রামে কৃষকের জন্য এটিএম বুথ কার্যক্রম কি শুধু কৃষি ব্যাংক নির্ভর রাখা উচিত নাকি অন্যান্য ব্যাংকেরও তা চালু করা উচিত?
যশোদা জীবন দেবনাথ: সব ব্যাংকেরই এই কাজে এগিয়ে আসা উচিত। শুধুমাত্র কিছু নির্ধারিত জেলা বা বিভাগীয় শহর নিয়েই যদি ব্যাংকগুলো ভাবে; তাহলে গ্রামের অবহেলিত জনগণকে সেবা দেবে কারা? রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো ব্যাংক কৃষি ভর্তুকি দিয়ে কৃষক এটিএম বুথ দেশের গ্রামে গ্রামে চালু করলে, শতভাগ মানুষ ব্যাংকিং অর্থনীতির আওতায় চলে আসবে। দেখুন, দেশের ৬০ ভাগ মানুষ এখনও ব্যাংকের গ্রাহক নন। সব্বোর্চ ৫ কোটি মানুষ ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আছে। 

শুধু রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক নয়, শহরের বাইরে দুর্গম এলাকায় সব ব্যাংকেরই ডিজিটাল ছোঁয়া পৌঁছে দেয়া উচিত। দেখুন ২০০৭ সালে যখন এটিএম কাযর্ক্রম শুরু হয়েছিল,তখন ওই ব্যাংকের একাউন্ট ছিল ৫৪ হা

জার, ছিল ১৩৬ টি শাখা। আর রাকাবের আছে ৪০টি শাখা। ১৩৬ শাখায় ওদের একাউন্ট হলো ১ কোটি ৩০ লাখ, মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট মিলিয়ে। এসবে প্রতিদিন ১০৭ টি লেনদেন হয়। অথচ এটিএম আছে ৫ হাজার। প্রায় ৫ লাখ লেনদেন হয়, এটিএম বুথের মাধ্যমে। এসব লেনদেনকারী যদি শাখায় আসতো, তাহলে চিন্তা করুন কি পরিস্থিতি হতো। এখন দেখুন,একজন ব্যস্ত মানুষ সারাদিন কাজ করে,দিনশেষে বাড়ি ফেরার পথে কার্ড দিয়ে বুথ থেকে টাকা উঠিয়ে নিলে তার কর্ম ঘন্টা কিন্তু ব্যহত হবে না। আর সে যদি কাজ ফেলে ৯টা থেকে ৪টার মধ্যে ব্যাংকে আসে,তাহলে তিনি আর কৃষি কাজে মনোযোগি হতে পারবেন না। তাই এটিএম সেবাটা যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়,তাহলে অবশ্যই কৃষকের উন্নয়ন হবে। আমি মনে করি শুধু কৃষি ব্যাংক নয়,সব বাণিজ্যিক ব্যাংকেরই এই সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করা উচিত।

আজকের বাজার: গ্রামে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ একটি বড় সমস্যা,এ অবস্থায় এটিএম বুথ সচল রাখা কি করে সম্ভব?
যশোদা জীবন দেবনাথ: বিদ্যুত সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ চলছে প্রি পেইড মিটার নিয়ে। বিদ্যুত সংস্থাগুলো প্রি পেইড কার্ড ও মিটার করতে চায়। দেখুন, উন্নত বিশ্বে বিদ্যুত যতটুকু দরকার তারা ততটুকুই কিনে নেয়। এখনও বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু বিদ্যুত অপচয় করে। তাই প্রি পেইড সিস্টেম যদি হয়,তাহলে অপচয় থেকে সে বিরত থাকবে। গ্রামেও এটা করতে হবে, সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটাতে হবে, টেকনোলজি উন্নত করতে হবে। গ্রাম পর্যায়ে এখনও মানুষ দিনের বেলাতেই লাইট জ্বালিয়ে রাখে, অথচ ব্যবহারের কেউই নেই। আর যেহেতু বিলটা পোস্ট পেইড,মাস শেষে বিল পরিশোধ হচ্ছে দেরিতে। তাতে বিল সংগ্রহ নিয়েও বেশ বিপাকে থাকে বিদ্যুত সংস্থগুলো। তাই প্রি পেইড মিটারিং সিস্টেম যদি চালু হয়,তাহলে কিন্তু অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে এবং বিদ্যুতের সঠিক ব্যবহার হবে। আর এটা করা গেলে গ্রাম পর্যায়ে এটিএম সচল রাখতে সমস্যা হবে না। এছাড়া এখন তো সোলারের মাধ্যমেও এটিম বুথ চালু রাখা সম্ভব।

আজকের বাজার: কৃষকের জন্য কি আলাদা ধরনের এটিএম আছে?
যশোদা জীবন দেবনাথ: ‘টেকনোলজি এখন ইন দ্যা ডোর’ আপনার মোবাইলে এসএমএস’র মাধ্যমে টাকা আসলো,তখন নিকটস্থ এটিএম বুথে গিয়ে পিনকোর্ড ব্যবহার করে টাকাটা মুর্হূতের মধ্যেই উঠিয়ে নিতে পারবেন, কার্ড ছাড়াই। এই টেকনোলজি এখনই বাংলাদেশে চলছে। আর সারাবিশ্বেও এটি আছে। এটিএমে টাকা উত্তোলনে কার্ডের দরকার হবে না। সবকিছুই সহজ-‘লাইফ ইজি’।

কৃষকদের জন্য বিশ্বে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের এটিএম তৈরি করছে বিভিন্ন কোম্পানি। যাতে সাশ্রয় হবে। নামী-দামি ব্যাংকগুলো যে ধরনের এটিএম ব্যবহার করছে, তার তুলনায় কম দামে এটিএম গ্রামে বসানো যেতে পারে। এছাড়া সরকার তো এটিএমের উপর প্রণোদনা দিচ্ছে,যা গ্রামে এটিএম বুথ প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগানো যেতে পারে।

আজকের বাজার: কৃষকের জন্য এটিএম ব্যবহার কতটা সহজ হবে?
যশোদা জীবন দেবনাথ: মানুষ অভ্যাসের দাস। মাত্র কদিন আগে মানুষ ব্যবহার করতো কি প্যাড ফোন। এখন দেখুন, সবাই খুব সহজেই অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করছে। ফেসবুক ব্যবহার করছে দেশের অধিকাংশ মানুষ। তাহলে মানুষ অভ্যাস করলে, সব কিছুই সহজে ব্যবহার করতে পারে। গ্রামেও মানুষ এখন ফেসবুক ব্যবহার করে,সুতরাং এটিএম তো ইজি। একজন বুথগার্ডও যদি কৃষককে দেখিয়ে দেন,তাহলে পরে সে নিজেই তা খুব সহজে ব্যবহার করতে পারবে।

আজকের বাজার:এলকে/ডিএইচ/ ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭