চট্টগ্রাম বন্দরে লাইটারেজ সংকট: বাড়ছে জাহাজ জট

লাইটারেজ সঙ্কটের কারণে আমদানি পণ্য খালাসে বিলম্ব হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এতে বহির্নোঙরে বাড়ছে জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) জট। ফলে একদিকে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, পাশাপাশি জাহাজের ডেমারেজ চার্জ হিসেবে শত শত কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশের জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

বর্তমানে বন্দরের বহির্নোঙরে প্রায় শতাধিক জাহাজ অবস্থান করছে। বেশি রয়েছে বাল্কবাহী জাহাজগুলো। এতে বহির্বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে।

জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো সরাসরি জেটিতে বার্থিং নিতে পারে না। বন্দরের বহির্নোঙরে এসব জাহাজ থেকে পণ্য খালাস নিতে হয়। আবার কোন কোন জাহাজ বহির্নোঙরে কিছু পণ্য খালাস করে জাহাজের ড্রাফট (গভীরতা) কমিয়ে বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করে। আবার বন্দরের জেটিতে বার্থিং নেয়া জাহাজের ওভার সাইট থেকেও বিপুল পরিমাণ পণ্য খালাস করা হয়। বহির্নোঙর এবং জেটিতে অবস্থানকারী জাহাজের ওভারসাইট থেকে কেবলমাত্র লাইটারেজ জাহাজেই পণ্য খালাস করা হয়। আগে গম, কয়লা, সার, ভুট্টা, র’চিনি, সরিষাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে আসলেও বর্তমানে স্ক্যাপ, লবণ, পাথর ও চাল যুক্ত হয়েছে। ফলে লাইটারেজের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। বহির্নোঙর থেকে লাইটারেজ পণ্য খালাস নিয়ন্ত্রণ করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

এদিকে বিগত কয়েক বছরে নতুন লাইটারেজ তৈরির অনুমোদন দিচ্ছে না নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। একদিকে আমদানি বেড়েছে, কিন্তু লাইটারেজ তৈরির অনুমোদন না পাওয়ার কারণে বাল্ক জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বিলম্বিত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বাল্ক জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে একচেটিয়া ব্যবসা করতে এবং পণ্য খালাস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে নতুন লাইটারেজ তৈরিতে প্রতিবন্ধক তৈরি করে আসছে ডব্লিউটিসি।

ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৯ লাখ ১৮ হাজার ১৭০ টন বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ৭৩৪টি লাইটারেজ দেশের ৩৬টি ঘাটে অবস্থান করছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামের কাছাকাছি লোকাল গন্তব্যে সর্বোচ্চ ১৪৭টি লাইটারেজ, সিটি গ্রুপের ঘাটে ৮৪টি, নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন কোম্পানির ঘাটে রয়েছে ৭৬টি, নগরবাড়িতে ৭৬টি, বাঘাবাড়ি ৬৯টি, নোয়াপাড়ায় ৫৪টি লাইটারেজ অপেক্ষমান রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু নিয়মিত খালাস হলেও চট্টগ্রামের কাছাকাছি লোকাল গন্তব্যে স্ক্যাপ, সার, গম পাথর নিয়ে ১১০টি লাইটারেজ ৬০ দিনের বেশি সময় ধরে পানিতে ভাসছে।

কোন কোন লাইটারেজ ৮০-১০০ দিন পর্যন্ত খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, কালীগঞ্জ, কাজলা, মিরপুর এবং কাঁচপুর ঘাটে কাঁদামাটি, গম, ভুট্টা, লাইমস্টোন, সাধারণ পাথরসহ ৬০টি লাইটারেজ ৩০ দিনের অধিক সময় ধরে খালাস হচ্ছে না। এগুলোর মধ্যে ৫৫-৫৯ দিন পর্যন্ত অপেক্ষমান লাইটারেজ রয়েছে।

তবে ব্যবসায়ীরা জানান, পণ্য স্থলভাবে গুদামজাত করলে সরকারের নজরদারিতে পড়তে হয়। টনপ্রতি ৬০-৭০ টাকা গুদাম ভাড়াও গুনতে হয়। তাই লাইটারেজ জাহাজ খালাস না করে পণ্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করলে একদিকে প্রশাসনের নজরদারি থেকে রেহাই মিলছে, অন্যদিকে পণ্য গুদামজাত খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। এ কারণে তৈরি হয়েছে লাইটারেজের কৃত্রিম সংকট। আর লাইটারেজ সংকটের কারণে নিয়মিত আমদানি পণ্য খালাস করতে না পেরে বহির্নোঙ্গরে (আউটার) তৈরি হয়েছে জাহাজ জট।

এসব মাদার ভেসেল (জাহাজ) থেকে নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাসে ব্যর্থ হয়ে প্রতিদিন মাদার ভ্যাসেলপ্রতি ১০-১৫ হাজার ডলার জরিমানা দিতে বাধ্য হচ্ছে আমদানিকাররা। এভাবে ব্যবসায়ীদের অবহেলা এবং সিন্ডিকেট কারসাজির কারণে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বিদেশে।

খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত ১৮ আগস্ট খালাসের জন্য বহির্নোঙরে আসা আবুল খায়ের গ্রুপের ৬০ হাজার ৫০০ টন গমবাহী জাহাজ ‘এমভি এসেন্স অব সি ট্রাক’ সর্বশেষ ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৪ দিনেও সম্পূর্ণ খালাস হয়নি। নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন ৩ হাজার টন হিসেবে ৩১ দিনেই বাল্ক জাহাজটি খালাস হওয়ার কথা। কিন্তু ৯ নভেম্বর জাহাজটিতে ৩৫০ টন গম খালাসের অপেক্ষায় রয়ে যায়। এদিকে শুধু এই একটি জাহাজেই সাড়ে ৬ কোটি টাকার বেশি ডেমারেজ গুণতে হতে পারে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে।

অন্যদিকে মোশাররফ ব্রাদার্সের নামে আমদানিকরা ৫৮ হাজার ৬০০ টন গম নিয়ে আসা ‘এমভি সারগি’ থেকে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে খালাস শুরু হয়। সর্বশেষ ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৭৩ দিনে খালাস হয়েছে মাত্র ৩৮ হাজার ৩৫০ টন। এখনো খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে ২০ হাজার ২৫০ টন গম। একইভাবে চট্টগ্রামের আরেক খ্যাতনামা আমদানিকারক টিকে গ্রুপের ৫০ হাজার ৮৫০ টন গম নিয়ে আসা ‘এমভি এনা’ থেকে গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৯ দিনে খালাস হয়েছে মাত্র ৩৮ হাজার ৯০০ টন গম। বর্তমানে আরো ১১ হাজার ৯৫০ টন গম খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক আমদানিকারক অভিযোগ করে বলেন, ডব্লিউটিসির সাথে যোগসাজস করেই ব্যবসায়ীরা লাইটারেজকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। এতে করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। নিয়মিত পণ্য খালাস হয়ে বাজারে গেলে পণ্যের দাম বাড়ার আশংকা থাকে না। সরকার নিয়মিত মনিটরিং করলে লাইটারেজ সংকট একেবারে কেটে যাবে। এছাড়া বর্তমানে নতুন লাইটারেজ নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ লাইটারেজ নির্মাণের অনুমতি চাইলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নৌ-মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নতুন লাইটারেজ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এতে করে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কথা হলে দেশের খ্যাতনামা শিল্পগ্রুপ আবুল খায়ের গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আগের চেয়ে আমদানি বেড়েছে। পাথর, স্ক্র্যাপের মতো নতুন নতুন পণ্যও আমদানি হচ্ছে। কিন্তু লাইটারেজ বাড়েনি। আবার নতুন লাইটারেজ তৈরির অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না। যে কারণে সংকট দীর্ঘতর হচ্ছে। বন্দরের জাহাজের জট দিন দিন বাড়ছে। এতে একদিকে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে।

জানা গেছে, ডব্লিউটিসির অধীনে বর্তমানে ৯৬০টি লাইটারেজ রয়েছে। তন্মধ্যে মেরামত ও ডকে আছে ৯৩টি লাইটার। পাঁচ শতাধিক লাইটারেজ একমাসের বেশি সময় ধরে পণ্য খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। বুকিং সিরিয়ালে আছে ৯টি এবং ৩৮টি সেইলিং করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রয়েছে।
সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে ডব্লিউটিসির আওতাধীন কোয়াবের আহবায়ক গাজী বেলায়েত হোসেনকে ফোন করলেও তিনিও লাইটারেজ সংকটের কারণ নিয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহ-সভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী জানান, নির্ধারিত সময়ে মাদার ভেসেলগুলো খালাস করতে না পারায় আমদানিকারকদের জরিমানা গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে আউটারে (বহির্নোঙরে) জাহাজ জট তৈরি হচ্ছে। সামনে এ জট আরো বাড়তে পারে। এদিকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের জাহাজগুলো নির্ধারিত সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়তে পারেন না বলে আসতে চায় না। এতে বহির্বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, চলমান লাইটারেজ সংকট ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইটারেজ সংকট না থাকলে বন্দরে জাহাজ জটও কমে যাবে। লাইটারেজের সংকট সমাধানে আমরা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে পত্র দিয়েছি। নতুন লাইটারেজ তৈরি না হলে এ সংকট আরো দীর্ঘায়িত হবে।

তিনি আরও বলেন, নির্ধারিত সময়ে মাদার ভ্যাসেলগুলো খালাস না করার কারণে ডেমারেজ চার্জ হিসেবে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে। সংকটের কারণে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৩ নভেম্বর ২০১৭