সঠিক উদ্যোগে হতে পারে অর্থনীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত

বাজার হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পখাত

গেল কয়েক বছরে নানা কারণে দেশে ক্রমশই কমেছে চামড়া শিল্পের বাজার। কিন্তু দেশে তৈরি চামড়ার জুতা ও চামড়াজাত পন্যের সুনাম ও চাহিদা রয়েছে বিশ্ববাজার, তাই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কাটিয়ে উঠে সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে এ খাত থেকে আবারো বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব। যথাযথ উদ্দ্যোগ ও সরকারের হস্তক্ষেপে এখাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে তৈরি পোশাকের পর এই খাতই হবে জাতীয় অর্থনীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত।

বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শিল্পখাতগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের অবস্থান এখন পঞ্চম। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে দশ ভাগ আসে এ খাত থেকে। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, চীন, জাপান, হংকং, তাইওয়ান, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হয়। আমাদের দেশর চামড়ার তৈরি জুতার বেশ ভালো চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। তবে দেশে চাহিদার চেয়ে চামড়া উৎপাদন কম। নানাবিধ সমস্যা, রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অসাধু চক্রের সৃষ্ট নানা জটিলতায় গেল কয়েক বছরের ব্যবধানে চামড়া রপ্তানি কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। প্রতি অর্থবছরেই পণ্য রপ্তানি আয়ের তুলনায় পণ্য আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। যেহেতু এখাত রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখে, তাই এর বিকাশ ও উন্নয়নের প্রয়োজন।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩৮ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কম। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ডলার। ২৪ কোটি ডলারের চামড়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ২৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কমে গিয়ে রফতানি হয়েছে ১৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। চামড়াজাত পণ্য থেকে ৫৪ কোটি ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। জুতা ও অন্যান্য পণ্যের লক্ষ্যমাত্রায় ৬০ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৫৩ কোটি ডলার। এ ছাড়া, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১১৩ কোটি ডলারের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার।

এভাবে প্রতিবছরই চামড়া শিল্পখাত বাজার হারাচ্ছে। এ ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস করতে হলে আমাদের পণ্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে। আর পণ্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হলে সব সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করে এ শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে।

এক সময় মূলত ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় দেশের ৯০ শতাংশ এবং চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ছিল এ শিল্পের অবস্থান। কিন্তু গত বছরের এপ্রিল থেকে ঢাকার হাজারীবাগে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে। পরিবেশ দূষন রোধে হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত করা হয় এ শিল্প। দেশে বর্তমানে প্রায় ২০০টি ট্যানারি শিল্প কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ট্যানারি বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা ১৫৮টি। আর আধুনিক ট্যানারি রয়েছে ৬৫টি। এসব ট্যানারিতে ফিনিশড চামড়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের চামড়াজাত পন্য যেমন জুতা, স্যান্ডেল, চপ্পল, ব্রিফকেস, ব্যাগ, হাতব্যাগ, শপিংব্যাগ, ভ্রমণব্যাগ, লেডিসব্যাগ, মানিব্যাগ, চামড়ার তৈরি গদি, হাতঘড়ির ফিতা, অলংকারের বাক্স প্রভৃতি চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়ে থাকে।

দেশের ট্যানারিগুলোর মধ্যে বছরে ৫০ লাখ বর্গফুটের বেশি চামড়া উৎপাদনকারী বড় ট্যানারি রয়েছে ১১টি, ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ বর্গফুট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন মাঝারি ট্যানারি ২৬টি। আর দুই হাজারেরও বেশি কারখানা রয়েছে কুটির শিল্প পর্যায়ের। এ খাতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার।
আর বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন নামে এ শিল্পের দুটি সংগঠনও রয়েছে।
কিন্তু পরিবেশবান্ধব করার লক্ষ্যে চামড়া শিল্পকে সাভারে স্থানান্তরিত করা হলেও সেখানে নানামূখী জটিলতা রয়েই গেছে। হাজারিবাগে ২০৫ টি কারখানা থাকলেও সাভারে প্লান্ট পেয়েছে মাত্র ১৫০ টি। বাকি ৫৪ টি কারখানার মালিক কোন প্লান্ট পায়নি। এতে এসব কারখানার শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে।

নিদিষ্ট সময়ে ঋণ না পাওয়া এবং নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়াতে কারখানা স্থনান্তরের পরেও অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারেনি। এতে কয়েক হাজার কোটি টাকা রফতানি অর্ডার বাতিল হয়েছে, রফতানি অনেক কমে যায়।

ট্যানারি মালিকরা প্রতি বছর রপ্তানির জন্যে ১৫ থেকে ১৬ কোটি বর্গফুট চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। যেখানে কোরবানির সময়েই ৮ কোটি বর্গফুট চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। বাকিটা বছরের অন্য সময়ো সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে চামড়া কেনাবেচা নিয়েও বিশৃঙ্খলা চলছে। কোরবানীর সময় সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সিন্ডিকেট দাম নিজেদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। আর কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পাচারের উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশ হতে চামড়া সংগ্রহ করে এতে নিজ দেশে চামড়া বাজার হারাচ্ছে।

বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের পর্যাপ্ত সরবরাহের পূর্ণ নিশ্চয়তা রয়েছে। তাই গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া উচিৎ। ট্যানারির পরিবেশ উন্নত ও আধুনিক মেশিনপত্র স্থাপন করা দরকার। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি নিশ্চিত করা জরুরী। কাচা চামড়া, কেমিক্যাল ও খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক কমানো দরকার। চামড়ার মান বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত গবেষণারও দরকার রয়েছে। এরকম কিছু গুরুত্বপূন পদক্ষেপ ও সরকারী দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এ শিল্পের বিকাশ তরান্বিত করতে পারে।

যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিক পরাশক্তি দেশগুলোর চামড়া শিল্পে বিনিয়োগের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হচ্ছে। বিশ্ববাজারে চামড়ার ৬০ শতাংশই দখলে রাখছে চীন। ২০ শতাংশ ইতালি, ১০ শতাংশ ভারতের, মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের। আর বাকি দেশগুলো মিলে চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আর তাই এ খাতে এখনই বিকাশ সাধন না করা হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পাট শিল্প যেভাবে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে গেছে দেশে চামড়া শিল্পের অস্তিত্বও সেভাবে বিলীন হতে পারে।

সুতরাং চামড়া শিল্পের উন্নয়নে এখনই সময়োপযোগী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে চামড়া খাতের অবদান শক্তিশালী হবে।

আজকের বাজার/মিথিলা