জাদুঘরে থাকা তলোয়ারটি সিরাজ-উদ-দৌলার নয়: ফিরোজ মাহমুদ

জাতীয় জাদুঘরের ৩৭ নম্বর প্যাভেলিয়ন। কাঁচে ঘেরাও এক কোণায় সোজা দাঁড় করানো একটি তলোয়ার। তলোয়ারের সামনে কাগজে লেখা- ফিরাঙ্গি (তরবারি), নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ব্যবহৃত, (বাংলা বিহার ও ওড়িষার শেষ স্বাধীন নবাব), মাধ্যম: লোহা ও হাঁড়, পরিমাপ: দৈর্ঘ্য-১০৭.০৩ সেন্টিমিটার, সময়কাল: আনু. আঠারো শতক, প্রাপ্তিস্থান: মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, সংগ্রহ নম্বর: ০১.০২ৃ (বলধা সংগ্রহ)।

সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ারটিতে আরবিতে খোদাই করে একটি লাইন লেখা। যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘আলী ছাড়া কোনো তারুণ্য নাই, এবং জুলফিকার ছাড়া কোনো তরবারি নাই।’

সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ার বলে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের এই পরিচিতির প্রায় বেশিরভাগ তথ্য এমনকি তলোয়ারটি সিরাজ-উদ-দৌলার এমন প্রদর্শনী সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাদুঘরে প্রদর্শিত তলোয়ারটি যে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নয় তা এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। প্রায় ৪২ বছর আগে জাতীয় জাদুঘরের একটি সর্বজন স্বীকৃত প্রকাশনাতেই প্রথম এ দাবি তোলা হয়।

এরপরও শুধু নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার প্রতি মানুষের আবেগকে পুঁজি করে যুগের পর যুগ দেশের কোটি মানুষের সামনে ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে জাদুঘর সংশ্লিষ্টরাই অভিযোগ তুলেছেন।

সে সময়ের ঢাকা মিউজিয়ামের (জাতীয় জাদুঘর) সাবেক মহাপরিচালক এনামুল হকের সম্পাদনায় ১৯৭৫ সালের ২ জুলাই জাদুঘরেরই প্রকাশনা ‘বাংলাদেশ ললিত কলা, ভলিউম-১’ এ প্রথম সিরাজ-উদ-দৌলার তরবারি নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়। ওই সময় ললিত কলায় গবেষণালব্ধ প্রবন্ধে ড. ফিরোজ মাহমুদ প্রতিষ্ঠা করেন যে, জাদুঘরে থাকা তলোয়ারটি সিরাজ-উদ-দৌলার ব্যবহৃত তলোয়ার নয়।

ফিরোজ মাহমুদের গবেষণায় বলা হয়, জাতীয় জাদুঘরে রাখা যে তলোয়ারটি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ফিরাঙ্গি তলোয়ার বলে বলা হচ্ছে তা আসল ফিরাঙ্গিই না। তলোয়ারটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গবেষকরা দেখেছেন, এর ব্লেডটি কেবল ফিরাঙ্গির যা ইউরোপীয় ব্লেড।

গবেষকরা বিশদ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন, এই ব্লেডটি পর্তুগিজ একটি ব্লেড। আর তলোয়ারটির বিল্ট বা হাতলটি হচ্ছে স্প্যানিশ। ফিরাঙ্গি তরবারি এটি কখনো হওয়ার নজির নেই।

একই সাথে গবেষকরা দেখেছেন, এ ধরনের ফিরাঙ্গি তলোয়ার কেবল ১৬০০ শতক পর্যন্ত ব্যবহৃত এবং বানানো হয়েছে যা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আরও আগে। এ থেকে গবেষকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, জাদুঘরে রাখা তলোয়ারটি নবাব সিরাজের আরও অনেক অনেক বছর আগেকার।

তলোয়ারটি জাতীয় জাদুঘরে আসার উৎস নিয়েও আছে ধুম্রজাল। অধ্যাপক ফিরোজ মাহমুদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তলোয়ারটির প্রদর্শনীতে বলেছেন, এটি মুর্শিদাবাদ থেকে সংগ্রহ করা ভলদা সংগ্রহ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার তৎকালীন জমিদার নারায়ণ চন্দ্রের পুরানো অস্ত্র এবং পুরাকৃতি সংগ্রহের এক বিশাল সম্ভার ছিল। সেখানেই ছিল বর্তমানে সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ার বলে দাবি করা ফিরাঙ্গি তরোয়ারটি। কিন্তু তিনি সেটি মুর্শিদাবাদ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন এমন কোনো তথ্য প্রমাণ জাতীয় জাদুঘরের হাতে নেই।

জমিদার নারায়ণ চন্দ্রের সংগ্রহটি ভলদা সংগ্রহ হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীতে নারায়ণ চন্দ্রের পরিবার ভলদা সংগ্রহ শালাটি ঢাকা জাদুঘরকে দান করেন। ঢাকা জাদুঘরই হয় পরে জাতীয় জাদুঘর।

গবেষক ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, জমিদার নারায়ণ চন্দ্র বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পুরাতন অস্ত্র কিনতেন। কিন্তু ফিরাঙ্গি তলোয়ারটি তিনি কতোটা সঠিক উপায়ে কিনতে পেরেছিলেন সে প্রশ্ন এখন উঠেছে গবেষণা থেকেই।

ফিরোজ মাহমুদে বলেন তিনি ১৯৬৮ সাল থেকে জাতীয় জাদুঘরে কর্মরত ছিলেন এবং ১৯৯৭ সালে অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে জাতীয় জাদুঘর, প্রতœতত্ত্ব বিভাগ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং বাংলা একাডেমিতে খণ্ডকালীন পরামর্শকের কাজ করেন।

ফিরোজ মাহমুদ বলেন, মূলত তিনটি মোটা দাগে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জাদুঘরে থাকা তলোয়ারটি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নয়।

প্রথমত:
এর ব্লেড এবং হাতল ইউরোপীয় এবং স্পেনিশ মিশ্রণ হওয়া।

দ্বিতীয়ত:
পৃথিবীর তাবৎ নবাব, রাজ-রাজড়াদের তরবারিতে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া খুদাই করা সাল উল্লেখ থাকে। কিন্তু জাদুঘরে রাখা ফিরাঙ্গিতে তা নেই।

তৃতীয়ত:
প্রত্যেক সাম্রাজ্যের একটি চিহ্ন বা লগো তাদের তরবারিতে খোদাই করা থাকে, তাও জাদুঘরের ফিরাঙ্গিতে নেই। যেখানে জাদুঘরের ৩৭ নম্বর প্যাভেলিয়নে থাকা টিপু সুলতানের ব্যবহৃত তলোয়ারে সাল ও লগো উল্লেখ আছে।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, মুর্শিদাবাদের জাদুঘরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মুরাদ নামের যে তলোয়ারটি আছে তাতে সিরাজ-উদ-দৌলার নাম খোদাই করা আছে।

এই গবেষক বলেন, নবাব, রাজা-বাদশাদের তরবারি সচরাচর যেমন শার্প বা ধারালো হয় এটি তা না। তাদের তরবারি সাধারণত দুদিক ধারালো হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ব্যবহৃত বলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে ফিরাঙ্গি নামে একটি তলোয়ার এখনো সেখানকার জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।

ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, জমিদার নারায়ণ চন্দ্রকে যে তলোয়ারটি বিক্রি করেছিলেন, সে নিজেই হয়তো সাধারণ একটি তলোয়ারে সিরাজ-উদ-দৌলার নামটি বিক্রির সু্বধিার্থে খোদাই করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এতে যে সাল এবং লগো বসাতে হয় তা তিনি বোঝেননি।

তিনি বলেন, জাদুঘরের তলোয়ারটির অবশ্যই ঐতিহাসিক মূল্য আছে। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এটি কোনোভাবেই নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ার নয়। তাই তিনি এটিকে নবাব সিরাজের নাম অংকিত তলোয়ার হিসাবে চিহ্নিত করতে চান।

এই গবেষক বলেন, সে অনুযায়ী জাদুঘরের তৎকালীন মহাপরিচালক এনামুল হককে অনুরোধ করলে তিনিও একমত হয়ে তলোয়ারটি সিরাজের নামাংকিত বলে চিহ্নিত করতে বলেন।

এমনকি বিতর্ক এড়াতে সামান্য সময় তলোয়ারটি প্রদর্শনিরও বাইরে রাখা হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালে একটি ভিন্ন প্রদর্শনীতে নেয়ার সময় আবারও সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ার বলে জাদুঘরেরই কিছু কর্মকর্তা আবারও চিহ্নিত করেন।

যোগাযোগ করলে জাদুঘরের বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া ‘বিতর্কিত’ সাবেক মহাপরিচালক এনামুল হক সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ার নিয়ে ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে তার কোনো রকম কথোপোকথনের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন।

এমনকি তিনি ফিরোজ মাহমুদের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এমন হতে পারে এটা সিরাজ-উদ-দৌলার সময়ের অনেক আগের তলোয়ার। তবে সিরাজের না তা বলা যায় না।

তার সময়ের এবং তার সম্পাদিত জার্নালে বিশ্ববরেণ্য গবেষকদের সামনে প্রবন্ধ ও গবেষণাটি স্বীকৃত হয়েছিল বলে স্মরণ করিয়ে দিলে এনামুল হক দাবি করেন, ইদানিং অনেক কথা ভুলে যান।

পরে আবারও যোগাযোগ করলে ড. ফিরোজ মাহমুদ দাবি করেন, এনামুল হকের সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই দীর্ঘ ১২ বছর তাকে চাকরিচ্যুত থাকতে হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি চাকরি ফিরে পান।

তিনি জানান, এই বিরোধের জের ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনামুল হককে জাতীয় জাদুঘরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। একারণে এনামুল হক আর ফিরোজ মাহমুদের কথার স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছেন না।

ফিরোজ মাহমুদ জানান, তার গবেষণা এখনও বিশ্বের সকল জাদুঘর বিশারদ স্বীকার করে নেন। কেবল জাতীয় জাদুঘর তা স্বীকার করে না। মানুষের আবেগকে পুঁজি করে দর্শকদের সঙ্গে ভুল ইতিহাস তুলে প্রতারণা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, তার স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা এখনো কেউ খণ্ডন করেনি। সেটি কোনও গবেষণা দিয়ে খণ্ডন করলে তিনি মেনে নেবেন। যুগের পর যুগ কোটি মানুষকে একটি ভুল ইতিহাস জানানো উচিৎ না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় ড. ফিরোজ মাহমুদের সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ারটি নিয়ে করা গবেষণা তথ্যবহুল ও সঠিক বলে উপমহাদেশের প্রখ্যাত জাদুঘর বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাস চর্চাবিদ ভিএন মুখার্জি, এস কে স্বরস্বতিসহ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জে সি হার্লে, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ড মিউজিয়ামের কিউরেটর রিচার্ড স্কেলর্টনসহ ভারতের বর্তমান জাদুঘর বিশারদ ও সিরাজ গবেষকরা স্বীকৃতি দিয়েছেন, জাদুঘরে থাকা তলোয়ারটি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ব্যবহৃত তলোয়ার নয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে গোল্ডেন জুবিলি উপলক্ষে এ জেনারেল গাইড টু দ্যা ঢাকা মিউজিয়াম নামে একটি গাইড প্রকাশিত হয়। যেখানে তৎকালীন ঢাকা মিউজিয়ামের বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য ও মূল্যবান নিদর্শন এবং তখন পর্যন্ত ঢাকা জাদুঘরের সকল নিদর্শনের বিবরণ উল্লেখ থাকলেও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কোনো তলোয়ার থাকার কথা লেখা নাই।

জাদুঘরের কিউরেটর নিরু শামসুন্নাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তিনিও মনে করেন, গবেষণা করে এটা প্রমাণ করা উচিত যে এটি আসলেও সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ার, অথবা প্রমাণ হয়ে যাওয়া দরকার যে এটি তার তলোয়ার নয়। এটি হতে পারে যে এর উপস্থাপনের বা প্রদর্শনীর সময় লেখা থাকুক যে, এটি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নামাংকিত তলোয়ার।

শামসুন্নাহার বলেন, এক সময় সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে সিরাজ-উদ-দৌলার তলোয়ারটি জাদুঘর থেকে চুরি হয়ে গেছে তা ঠিক নয়। তবে এটি তার তলোয়ার কিনা তা সমাধান হয়ে যাওযা দরকার।
সুত্র: পরিবর্তন.কম

আজকের বাজার: সালি / ১৭ জানুয়ারি ২০১৮