জাপানে শুধু অনুরোধেই কাজ হয়!

শোজো আজুমা, টোকিও: লকডাউনের পথে হাটেনি জাপান। তবে দেশ জুড়ে ঘোষিত হয়েছে জরুরি অবস্থা। কিন্তু অন্য দেশের সঙ্গে একটা বড় তফাত আছে। নিয়ম মানার ক্ষেত্রে কোনও জোরাজুরি নেই। দেশের সংবিধানে যেহেতু ব্যক্তিগত যাতায়াতের স্বাধীনতার (ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট) কথা বলা আছে, তাই তাকে সম্মান জানাতে সরকারি তরফে কোনও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। বদলে নাগরিকদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন মাস্ক পরেন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বজায় রাখেন, জমায়েত না করেন, যথাযথ কারণ ছাড়া না বেরোন।

ইওরোপ, আমেরিকার তুলনায় করোনার আঘাত অনেক কম জাপানে। এখনও পর্যন্ত হাজার দশেক মানুষ আক্রান্ত। মৃত্যু হয়েছে শ’দুয়েক। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ঘোষণা করেছেন, প্রত্যেক নাগরিককে নগদে এক লক্ষ ইয়েন করে দেওয়া হবে। পরে সিদ্ধান্ত বদল করেছে সরকার। ভাবুন তো, টোকিও অলিম্পিক আর প্যারালিম্পিক এবছর বাতিল হওয়াতে কী বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জাপান সরকারের! তার পরেও যখন তারা দেশের মানুষের কথা এত ভাবে, তখন এটুকু প্রতিদান আমরা দেব না? তাই শুধুমাত্র অনুরোধেই কাজ হচ্ছে জাপানে। অন্য সব দেশে যখন শুনছি পুলিশ নামিয়ে, রাস্তা ব্যারিকেড করে, ড্রোন দিয়ে নজরদারি চালিয়ে, গ্রেপ্তার করে, জরিমানা করে মানুষকে শৃঙ্খলা শেখাতে হচ্ছে, তখন জাপানি হিসেবে আরও একবার গর্ব অনুভব করছি। সরকারি অনুরোধ মেনে মানুষ অকারণ চলাচলে সত্যিই রাশ টেনেছেন। যে সব জায়গায় একসঙ্গে বেশি মানুষ জড়ো হন, যেমন বার, নাইট ক্লাব, অ্যাথলেটিক সেন্টার, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সিনেমা, থিয়েটার হল— ব্যবসায়ীরা সেগুলো বন্ধ রেখেছেন। স্কুল–কলেজ আগে থেকেই বন্ধ। আপাতত ঠিক আছে, ৬ মে পর্যন্ত এ রকমই চলবে।

এ কথা মানতেই হবে, এত বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি স্মরণকালের মধ্যে দঁাড়ায়নি বিশ্ব। জাপান সুনামি দেখেছে। এমনকী মাউন্ট ফুজি থেকে কখনও অগ্ন্যুৎপাত শুরু হলে রাজধানী টোকিও কীভাবে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে, সে বিষয়েও ধারণা আছে প্রশাসনের। কিন্তু একটা ভাইরাস যে এভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে তছনছ করে দিতে পারে, কে ভেবেছিল? আমরা তো সাধারণ নাগরিক। এপ্রিল মাসে জাপানের যুবরাজের অভিষেক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, সেটাও পিছিয়ে গেছে। কাজপাগল বলে খ্যাতি আছে জাপানিদের। ওয়ার্কহোলিক জাপানিরা অনেক বেশি সময় কাটায় কাজের জায়গায়, ওভারটাইম করতে পছন্দ করে। তার পরও অনেকে ক্লাবে–রেস্তোরঁায় সময় কাটায়। সে–সবই এখন বন্ধ। অনেক কোম্পানির মালিক তো বলতে শুরু করেছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে যখন এত কাজ করা সম্ভব হচ্ছে, তখন ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ার কথা ভাবাই যেতে পারে। এদিকে সমীক্ষা বলছে, জাপানি পুরুষেরা এমনিতে ঘরের কাজকর্ম বিশেষ করে না। কিন্তু এখন বাড়িতে থাকার ফলে তারা সংসারের প্রচুর কাজ করছে। আমার অবশ্য অত চাপ নেই। স্ত্রী আর দুই পোষ্য কুকুর নিয়ে দিন কাটছে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে ভাবতে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আবার এমন পরিস্থিতি এলে কীভাবে তার মুখোমুখি দঁাড়াব।

আমরা জাপানিরা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত। পেশাগতভাবে চোশি শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি। বিষয় রিস্ক অ্যান্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। আপাতত অনলাইনে পড়ানোর থেকেও আমি বেশি ব্যস্ত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মীদের নিরাপদে রাখা নিয়ে। আমাদের ক্যাম্পাসে এখনও করোনার থাবা পড়েনি। কিন্তু সবরকম সাবধানতা নিতে হচ্ছে। আশা করছি, ৬ মের পর ক্লাস শুরু হবে। বর্তমানটা যদিও বা সামাল দেওয়া যায়, ভবিষ্যৎ খুবই কঠিন। জাপানেও অনেক কোম্পানি ইতিমধ্যেই নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। অনেকে ব্যাপক ছঁাটাই করেছে। অর্থনীতিতে ধস নামছে। আগামিদিনে এর ফল ভুগতে হবে যুব সম্প্রদায়কে। একজন অধ্যাপক হিসেবে এটা খুব হতাশার।‌‌
সূত্র:আজকাল