ঝরে পড়া রোধ ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে করণীয়

খায়রুন নাহার লিপি: শিক্ষা জাতির মৌলিক চাহিদা । এ চাহিদা পূরণে প্রাথমিক শিক্ষাই Foundation বা ভিত্তি প্রস্তর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে গুরুত্বারোপ করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নয়নের জন্য উন্নত রাষ্ট্রসমূহ শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন। মূলত: উন্নত বিশ্বে উন্নত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা। উন্নত বিশ্ব যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থাকে মান সম্মত ও যুগোপযোগি হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পড়া রোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ঝড়ে পড়া রোধ করা হচ্ছে ধীর ও দৃঢ় গতিতে।

ব্যানবেইজের তথ্য মতে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ৫টি ক্যাটাগরিতে ২৮ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নব জাতীয়করণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, নন রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, পরীক্ষণমূলক বিদ্যালয়, কমিউনিটি বিদ্যালয়, শিশু কল্যাণ বিদ্যালয়সহ আট ধরণের বিদ্যালয়।
‘বি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে এবতেদায়ী মাদ্রাসাসহ তিন ধরণের স্কুল
‘সি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে কিন্ডার গার্টেন, টি গার্টেন
‘ডি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে মসজিদ, মন্দির ভিক্তিক ও কওমী মাদ্রাসাসহ নয় ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
‘ই’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে এনজিও পরিচালিত ৩ ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠ পদ্ধতি, কারিকুলাম ও অব কাঠামোগত পার্থক্য থাকায় এর প্রভাব পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর স্কুল সমূহে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়লেও এর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে জাতিসংঘের গৃহীত তথ্যমতে -১৮ বছরের কমবয়সীদের শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। মূলত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুরাই ঝড়ে পড়ছে বিধায় শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রতিকূলতা বিরাজমান। ঝড়ে পড়ার কারণসমূহ বিচার বিশ্লেষণ করে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝড়ে পড়া রোধ করা সম্ভব।

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশই ১৮ বছরের নিচে। আর এই শিশুদের প্রথম শিক্ষা সম্ভব হয় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে। আর সেখানেই বাংলাদেশ পিছিয়ে গিয়েছে। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলেছে – দেশের ৬৭ শতাংশ শিশুই প্রস্তুতিমূলক এই শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। এই শিশুদের অধিকাংশই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এর মধ্যে অনেকেই পথশিশু, যৌন পল্লী শিশু, শ্রমজীবী, দলিত শ্রেণি, বস্তিবাসী, পাহাড়ী জনগোষ্ঠী। তারা কোনভাবেই প্রাথমিক শিক্ষায় আসতে পারছেনা। আর এদেরকে যদি আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় না আনতে পারি তবে প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সম্ভবপর নয়।

শুধুমাত্র দারিদ্র ও সামাজিক নয়, ভৌগলিক কারণেও অনেক শিশু শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারছেনা। এদের কে যদি শিক্ষা ব্যবস্থার গন্ডিতে আনা হয় তবে তাদের প্রাক প্রাথমিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ প্রাক প্রাথমিক যারা আসতে পারছেনা তাদের অধিকাংশ শিক্ষা ব্যবস্থা হতে ঝরে পড়ছে। এদের শিক্ষার আওতায় আনার জন্য ইউনেস্কো, বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা বিশ্লেষকগণ বলছেন

শিশুদের প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা জীবনের জন্য অনেকগুলো কারণও রয়েছে। ঢাকা শহরের ভাসমান জনগোষ্ঠির অনেক বাবা-মা লেখাপড়া জানে না। ঢাকা শহরের চিত্র যদি এমন হয় অর্থাৎ রাজধানীর মানুষ যদি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর খাতায় নাম লিখে তবে যারা দেশের চিত্র অনেকটাই ভয়াবহ। উল্লেখ্য যে, ৪ বছরের একজন শিশু বিদ্যালয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তার জন্য রাস্তাঘাট কতটুকু বন্ধুসুলভ নিরাপদ ? স্কুলের ভৌত অবকাঠামো কিভাবে তাকে আকর্ষন করছে ? বিদ্যালয়ের শিক্ষকগন তার সাথে কতটুকু বন্ধুসুলভ মনোভাব নিয়ে মিশছে এ সকল বিষয়টিকে সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ কথা সত্য যে শিক্ষার চাহিদা সর্বত্র তৈরি হয়েছে। দেশের প্রায় অধিকাংশ মা বাবাই চান তার সন্তানেরা বিদ্যালয়ে যাক। কিন্তু ৪ বছর বয়সেই একজন শিশু বিদ্যালয়ে যাবে এ বিষয়টি নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। সেখানে সচেতনতা একটি বিষয় রয়েছে। প্রস্তুতি পর্বের জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত? যারা নীতি নির্ধারক এবং শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ করেন, মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বিভাগ কতটুকু প্রস্তুত ? শুধুমাত্র মা বাবা প্রস্ততিই যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘ প্রত্যেক শিশুকে প্রাক প্রাথমিকে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন। গত ১০-১২ বছর পর্যন্ত এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর মাত্র ২ বছর আগে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহন করা সম্ভব হয়েছে। এটিকেও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বলা যাবে না, আংশিক বাস্তবায়ন বলা যেতে পারে। এর সংখ্যা বাড়তে হলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়-৭৯% শিশু ৫ম শ্রেনিতে উত্তীর্ন হওয়ার পূর্বেই শ্রমের বাজারে চলে যায়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, শিশু শ্রমিকের ২২% শিশুই ঝুকিপূর্ণ কাজে জড়িত। এটা সত্য যে, আমাদের শিক্ষায় অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

সকল শিশু বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। তবে অনেক পরিবারের জন্যই বিনামূল্যে বইয়ের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে পড়া শিশুর জন্য মনোযোগ আরও বৃদ্ধি করার আবশ্যকতার অবস্থান অনেক শীর্ষে। ১৯৯৬ সালের সরকারি তথ্যমতে ঢাকা শহরে ৩৮০০ টি বস্তিতে ৪২% শিশু বাস করে। এর মধ্যে ২০% শিশুই স্কুলের আওতা বহির্ভূত। পথ শিশুদের লেখা পড়ার বিষয়টি একেবারেই অনিশ্চিত পর্যায়ে। কোনো সামাজিক সংগঠন বা বক্তি পর্যায়ের কোনো উদ্যোগ ব্যতীত তাদের লেখাপড়ার সুযোগ থাকছে না। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকই যথেষ্ঠ নয়। এক এক অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে একেক রকম প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে শিক্ষার্থীর লেখাপড়া ও পুষ্টির চাহিদা পূরনের দায়িত্ব সরকারের। আর আমাদের উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ দায়িত্ব সরকার ও জনগনের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের এই বিপুল জনগোষ্ঠিকে জন সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর এক্ষেত্রে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাই হবে একজন শিশুর বুনিয়াদ।

শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের হিত পদক্ষেপের অন্যতম দিক হলো বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। লেখাপড়ার মাঝে খেলা ও ছবির আকাঁর বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করে পাঠদান কার্যক্রম ঢেলে সাজানো হয়েছে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা পড়ার মাঝে বিনোদন খঁজে পায়। আর এ ধারণা থেকেই বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সাভারে পরিচালনা করছে খেলা ও আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের। এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “শিখবে প্রতিটি শিশু” । দেশের ১৩টি উপজেলায় ১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু রয়েছে এ শিক্ষা ব্যবস্থা।

উল্লিখিত বিষয়ের পর্যালোচনায় বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে বিশেষত: প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়ারোধ কল্পে নিচের সুপারিশসমূহ সুবিবেচনায় রাখা যেতে পারে:
১। কর্মজীবী মায়ের সন্তানদের জন্য ডে কেয়ার এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
২। সকল বিদ্যালয়কে দুপুরের খাবারের আওতায় আনা যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগনের সম্প্রক্ততা বাড়াতে হবে। যদি সকল শিশুর জন্য দুপুরের খাবার যোগান দেয়া সম্ভবপর না হয় তবে সকল শিশুর মাঝে স্থানীয় জনগনের সম্প্রক্ততায় টিফিনবক্স বিতরণ তাদেরকে সেই বক্সে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার আনার পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।
৩। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুদের ভাষা শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে শুধুমাত্র আদিবাসী শিশুদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
৪। শিশুদের জন্য নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে ।
৫। শ্রমজীবী শিশুদের জন্য সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। অর্থাৎ লেখাপড়া ও কাজের সময় সুনির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে।
৬। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলো আকর্ষনীয় করে সাজানো যেতে পারে।
৭। বাংলাদেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাহিদা সনাক্ত করে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ নিশ্চিত করা যেতে পারে।
৮। Need based শিক্ষক নিয়োগ করা যেতে পারে।
৯। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডার গার্ডেন বিদ্যালয়ের কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক এর মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনা যেতে পারে।
১০। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝে বন্ধুসুলভ মনোভাব গড়ে তোলার জন্য সকল শিক্ষককে Child psychology বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা যেতে পারে।
১১।“বিদ্যালয় শিশুর সূতিকাগার” এ ধারণা শিশু, অভিভাবক, স্থানীয় জনগন, শিক্ষানুরাগীসহ সকলের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করে বিদ্যালয় পরিবেশ শিশুবান্ধব করে তোলা যেতে পারে।

উল্লিখিত সুপারিশমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়া রোধ করা অনেকটাই সম্ভবপর হবে। এতে করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাস্তব রূপদান প্রদান করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।

খায়রুন নাহার লিপি
সহকারী শিক্ষক
মিরপুর আর.সি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

 

আজকের বাজার:এবি/এলকে/ ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭