তিস্তা নদীর দুই পাড় একটি পর্যটন নগরী রূপে গড়ে উঠতে যাচ্ছে

তিস্তা নদীর দুই পাড় ঘিরে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। আগামীতে তিস্তা নদীর দুই পাড় একটি পর্যটন নগরী রূপে গড়ে উঠতে যাচ্ছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দরিদ্রপীড়িত জেলা লালমনিরহাটকে কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী জেলা হিসেবে গড়ে তুলতে মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
এর আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে লালমনিরহাট জেলাকে দারিদ্র মুক্ত করতে কাকিনার মহিপুরে তিস্তা ব্যরেজ সেচ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে লালমনিরহাট জেলা তিস্তা ব্যারেজের সেচ প্রকল্পের আওতায় আসত। কিন্তু জাতির জনককে পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। ফলে কাকিনায় আর সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়নি।
ফলে এক সময়ের খর¯্রােতা তিস্তা নদী জেলার জন্য অভিশাপে পরিণত হয়। সেচ প্রকল্পের কারণে বর্ষা মৌসুমে ভারত অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তা নদীর পানির তোড়ে জেলাবাসী দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ে। আবার শুস্কমৌসুমে ভারত সরকার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে তিস্তা ব্যারেজের রির্জাভারে পানি সংরক্ষণ করে সেচ ব্যবস্থা চালু রাখতে ব্যারেজের ৪৪টি গেট বন্ধ করে রাখা হয়। ফলে তিস্তা নদী শুকিয়ে যায়। তিস্তা পাড় হয়ে উঠে মরুভুমির মত।
১৯৮৯ সালের পর হতে তিস্তা পাড়ের তিস্তা নদীকে ঘিরে পেশাজীবি যেমন, মৎস্যজীবি, খেয়া ঘাটের নৌকার মাল্লা, কৃষিজীবিসহ নানা পেশার হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পথে বসে যায়। লাখ লাখ হেক্টর ফসলের জমি নদী গর্ভে বিলীণ হয়ে যায়। এক সময়ের বিত্তবান জোতদার কৃষক পরিবার গুলো রাতারাতি পথের ফকিরে পরিণত হয়ে যায়। নেমে আসে দারিদ্রতা। তিস্তা পাড়ে গৃহহীন মানুষ ঝুঁপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে। দেখা দেয় মঙ্গা।
পরবর্তিতে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ বছরের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও নানা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে তিস্তাপাড়ের মানুষকে নিয়ে আসেন। তিস্তা নদীর চরের বাড়ি গুলোকে বন্যামুক্ত করতে ভিটা উচু করে দেয়া হয়। বাড়িতে বাড়িতে খামার করতে সরকারি কর্মসূচি হাতে নেয়। গবাদি পশু পালন সহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে চরের নারীদের সম্পৃক্ত করাসহ চরে শুস্ক মৌসুমে নানা ফসল ফলাতে সরকারি ভর্তুকি দেয়। বিনামূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও আধুনিক চাষ পদ্ধতি সর্ম্পকে কৃষক ও কৃষাণিদের সরকারি ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়। প্রায় প্রতিটি চরে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। চরবাসীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ৬ হাজার জনবসতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিটি ক্লিনিক। চরে অভাবের সময় কর্মহীন মানুষের কাজ নিশ্চিত করতে বছরে দুই বার ৪০দিন ৪০দিন করে কর্মসৃজন কর্মসূচি সরকারি ভাবে বাস্তবায়ন করে। এসব নানা উদ্যোগে এখন তিস্তা পাড়ের মানুষ মঙ্গা মুক্ত হয়েছে।
এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থায়ীভাবে তিস্তা পাড়ের মানুষের র্দুদশা লাঘবে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড় মিলে ২২০ কিলোমিটার তিস্তা নদীর দুই পাড়ে উচুঁ গাইড বাধ নির্মাণ করা হবে। বাধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মত মেরীন ড্রাইভ। মানে রিভার ড্রাইভ রোড় (চওড়া প্রস্থ মসৃণ রাস্তা)। যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইবে যেতে পারেন। এছাড়াও এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে । নদী পাড়ের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেষ্টুরেন্ট।
তিস্তা নদীর বর্তমান নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। তাই তিস্তা নদীর প্রশস্ততা কোথাও ৮ কিলোমিটার কোথাও আবার ১২ কিলোমিটার। শুস্কমৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে দেখা দেয় মরুভূমির মত। এই পরিকল্পনায় তিস্তা নদীর গভীরতা বাড়াতে মেজর খনন কাজ করা হবে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মো: আবু জাফর বলেন,‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ জেলা একদিন শিক্ষা ও সম্পদে সমৃদ্ধশালী হবে।’
নদীর দুই ধারের প্রস্ততা করা হবে মাত্র দুই কিলোমিটার। এতে করে নদীর দুই ধারে কয়েক লাখ হেক্টর ফসলের জমি উদ্ধার হবে। উদ্ধারকৃত জমিতে ১৫০ মেগাওয়ার্ড সৌর বিদূৎ উৎপাদনের পাওয়ার গ্রীড বসানো হবে। সেখানে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদূৎ উৎপাদন হবে। নদী পাড়ে থাকবে ইকোনমি জোন। নদী খনন করে গভীরতা বাড়িয়ে চালু করা হবে নৌ পথের রুট। যাতে স্বল্প খরচে নদী পথে অনেক বেশী পণ্য পরিবহন করা যায়। গড়ে তোলা হবে সরকারি কর্মকর্তা কমচারিদের বসবাস যোগ্য সকল নাগরিক সুবিধা সমৃদ্ধ নগর। উদ্ধারকৃত জমি ভুমিহীনদের মাঝে কৃষি কাজের জন্য বিতরণ করা হবে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে জেলায় কোন বেকার সম্যসা থাকবেনা। জেলা হয়ে উঠবে অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ।
ইতিমধ্যে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুই বছর আগে তিস্তা নদীর তীঁরে বাঁধ নির্মাণ, নগর নির্মাণ, সৌর বিদূৎ কেন্দ্র নির্মাণ, নদী খনন, নদীর প্রশস্ততা হ্রাস, রিভার ড্্রাইভ, পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল, মোটেল, রেষ্টুরেন্টসহ নানা পরিকল্পান বাস্তবায়ন করতে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ারকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি দুই বছর ধরে তিস্তা নদী সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা ডিজাইনসহ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার কৌশল ও সম্ভাব্য ব্যয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ধরে ১টি প্রজেক্ট সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
সেখানে প্রকল্পটি যাচাইবাচাই হয়েছে। প্রস্তাব ইআরডিতে জমা হয়েছে। আর্ন্তজাতিক পানি সম্পদ বিভাগ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এমওই স্বাক্ষর হয়েছে। এখন প্রজেক্ট প্রোফোজাল বাস্তাবায়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রাথমিক খরচ ধরেছে।
জানা গেছে , মন্ত্রণালয় হতে প্রজেক্টের অর্থ বিনিয়ককারী খোঁজা হচ্ছে। এমন কী কয়েকটি দাতা দেশ সহজ শর্তে অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রজেক্ট যত দ্রুত শুরু করা যায় তার জন্য ব্যক্তিগত আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এমন কী জিও’র মাধ্যমেও হলেও তিনি প্রকল্প শুরু করতে চান। এদিকে রংপুর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহা সড়ক ফোর লেনের কাজ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় রংপুর হতে বুড়িমারী পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফোর লেনের কাজ শুরু হবে।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় লালমনিরহাট জেলা শহরের অদুরে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এ্যারোনোটিক্যাল এভিয়েশন প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। ঢাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে চলতি ২০১৮- ২০১৯ শিক্ষা বছরে অর্নাস ও মাষ্টার্স কোর্সে ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। চলছে তাদের নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম। আগামী বছরের জানুয়ারী মাসে প্রায় ৬৬০ একর জমিতে মূল ক্যাম্পোসের ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। জেলা প্রশাসনকে বিশ^^বিদ্যালয়ের ভিসি ৩ মাস আগে জমি অধিগ্রহনের কাগজপত্র ও আবেদন পত্র জমা দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঢাকা হতে তাদের সামরিক বাহিনীর পাইলট প্রশিক্ষণের এভিয়েশন স্কুল লালমনিরহাটে স্থানান্তর করেছে। বর্তমান সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহম্মেদ এই পাইলট প্রশিক্ষণের স্কুলটি প্রায় কয়েক মাস আগে উদ্বোধন করেন।
এখানেই শেষ নয়,জানা গেছে , শহরে সাপটানায় ৯ একর জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধিনে। সেখানে তথ্য প্রযুক্তি র্নিভর আইটি পার্ক নির্মাণ করা হবে। মহেন্দ্রনগরে প্রায় ৭শ’ একর জমিতে গড়ে উঠবে ইকোনমি জোন ও ইপিজেড। সেখানে দেশি বিদেশি বিনিয়গের মাধ্যমে গড়ে তোলা হবে মাঝারি ও ভারি শিল্প কলকারখানা।
সদ্যযোগদানকৃত লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, চায়না পাওয়ার কোম্পানি দুই বছর ধরে তিস্তা পাড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাপরিকল্পনায় নির্মাণকৃত প্রকল্প বাস্তবায়নে নক্সাঁ ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করেছে। তারা সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে। পৃথক প্রজেক্ট আকারে পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজ বাস্তবায়ন করবে। খুব শিগগির টেন্ডার প্রক্রিয়া শুর হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে এই জেলার বর্তমান চিত্র রাতারাতি পাল্টে যাবে। অভিশপ্ত দারিদ্র জেলার দুর্নাম হতে মুক্ত হবে। বিশে^র নানা দেশ হতে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসবে।
তিনি বলেন, ইকোনমিজোনে ও নানা প্রকল্পে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সমৃদ্ধশালী জেলার পরিচয় বহন করবে। এসব প্রকল্প বাস্তাবায়নের অবদান একজনের ইচ্ছায় হচ্ছে। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সত্যিই তিনি রংপুর বাসিকে অনেক ভালবাসেন। রংপুরের যত উন্নয়ন চোখে পড়ে সব তার অবদান। তিনি রংপুরকে বিভাগ করায় দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। রাতারাতি পাল্টে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো, ব্যবসা বাণিজ্য।
স্থানীয় একটি কলেজের অধ্যক্ষ শওয়ার আলম জানান, তিস্তা পাড়কে ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর মহা উন্নয়ন বাস্তবায়ন হলে এখানকার শিক্ষিত বেকারদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তিস্তা পাড়ের সব চেয়ে নদীভাঙ্গেন শিকার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ মোফাজ্জল হোসেন মোফা বলেন, মানুষের দাবি ছিল স্থায়ী নদী ভাঙ্গনরোধ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা সহ তিস্তা পাড়ের মানুষকে সমৃদ্ধশালী করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এখানকার মানুষের উন্নয়নে কারও মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না।

সূত্র – বাসস