দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়ন অবশ্যই পুঁজিবাজার থেকে হতে হবে

মাহবুব এইচ মজুমদার : প্রথমে একটু বলি যে যারা বলে যে মার্কেট পরিশীলিত না বা মার্কেটে অনেক সমস্যা আছে। তাদেরকে বলবো, দেখেন ক্যাপিটাল মার্কেট মানেই হলো সবসময় শেয়ারের আপ ডাউন থাকবে। আমাদের হয়তো দুই হাজার দশের পরে ডাউনের পার্টটা বেশি ছিলো। বাট ক্যাপিটাল মার্কেটে আরেকটা জিনিস আছে, আমরা যেটা প্রতিনিয়ত দেখছি, সেকেন্ডারি মার্কেট যেটা দেখছি, সেটা হলো পিক অব দ্যা আইজ বার্গ। বলা যায়, বরফের এগার ভাগের দশ ভাগ থাকে পানির নিচে, আর এক ভাগ থাকে পানির ওপরে। ঠিক আমাদের সেকেন্ডারি মার্কেটটাও এমন ছোট একটা অংশ।

প্রতিদিন যেহেতু এখানে কেনাবেচা হয়, এই জন্য এটাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু আপনি দেখেন, ডিমান্ডের দিক থেকে যদি চিন্তা করা হয়, আমাদের একটা বিশাল বড় প্রাইমারি মার্কেট আছে এবং এই প্রাইমারি মার্কেটের আকর্ষণ অনেক বেশি এবং ওই প্রাইমারি মার্কেটে একটা কোম্পানি যখন আসে তখন দেখা যায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ গুণ সেটা সাবস্ক্রাইব হচ্ছে। মানে শেয়ার বরাদ্দ করতে হচ্ছে অনেক বড় রেশিওতে। কাজেই মার্কেট নিয়ে যেসব অনর্থক মন্তব্য করা হয়, সেক্ষেত্রে তারাই ভুল। কারণ এতো সংখ্যক মানুষ একই সাথে ভুল করতে পারে না। মার্কেট ঠিকই আছে। কিছুটা আপ-ডাউন আছে। রেশনালিটি কম আছে বা থাকতে পারে। দুই হাজার দশের পরে একটা বড় ডিবাকলের পরে কিছুটা সমস্যা আছে।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে জাঙ্ক শেয়ার। এখানে একটা মুশকিল হচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা যারা আছেন তাদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, ডিভিডেন্ট মানে ফান্ডামেন্টালি শুধুমাত্র ডিভিডেন্টে বেশি নজর দেয়া হয়, আর ক্যাপিটাল গেইনের প্রতি কম নজর দেয় তাহলে তারা কখনোই লস করবে না। কারণ যে কোম্পানি ডিভিডেন্ট দেয় সে কোম্পানি কখনোই পিছনে পড়বে না। আর একটা সেমি বিনিয়োগকারীদের আমরা দেখতে পাই, যারা অতি দ্রুত তাদের টাকা দুই গুণ তিন গুণ চার গুণ করতে চায় তারা হয় কী জাঙ্ক শেয়ার অথবা যে শেয়ারগুলোর মূল ভিত্তি দুর্বল সে রকম শেয়ারগুলোতে তারা ইনভেস্ট করে। আপনি যদি দ্রুত প্রফিট চান তাহলে আপনাকে রিস্ক বেশি নিতে হবে। আপনি রিস্কে বেশি পড়বেনই। আপনি যখন রিস্ক বেশি নিবেন তখন আপনি যদি গেইন না করেন তখন আপনি যদি অনর্থক মন্তব্য করেন সেটা তো বাজারের দোষ না। সেটা তো যে ঝুঁকিটা নিয়েছে তার ঝুঁকিটা নেওয়া উচিত ছিল যে ডিভিডেন্ট বেশি দেয় সেসব কোম্পানিতে। তারা তা না করে, করলেন কী, যে কোম্পানিতে টাকা পয়সা দুই গুণ বা তিন গুণ হবে সে কোম্পানিতে তারা ইনভেস্ট করলেন। এখানে সংশ্লিষ্ট লোকের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। আমি বলবো না সেও ভুল। কারণ সে তার প্রোজেক্ট দ্রুত ম্যাক্সিমাইজ করতে চাচ্ছে। তাকে শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে আমি যতো দ্রুত চাচ্ছি ঠিক আমার রিস্কের পরিমাণ ততো বেড়ে যাচ্ছে।

গত দুই তিন মাসের বাজারটা যদি আপনি লক্ষ করেন, এখানে বেশ কিছু শেয়ারের অনর্থক বেশি উর্ধ্বগতি হয়েছে বা  দুই গুণ তিন গুণ বেড়ে গেছে। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে তিনটা পক্ষ আমার মনে হয় আরও যথার্থ ভ’মিকা পালন করা উচিত ছিল। প্রথমত, একদম কোনোভাবেই রেগুলেটর তার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। প্রথম কথা হলো যে, একটা শেয়ার যখন বেড়ে যাচ্ছেই বেড়ে যাচ্ছেই তখন ট্রেডিং বন্ধ করে দেওয়া। উন্নত বিশ্ব যেটা করে সেটা প্রথম রেমিডিটি হলো বিনিয়োগকারীদের ট্রেডিং বন্ধ করে দেওয়া। যেহেতু তার কোনো পিএসআই নাই, তার কোনো সিগনিফিকেন্ট কোনো উৎপাদন বৃদ্ধি হয় নাই, সিগনিফিকেন্ট কোনো সেলস বাড়ে নাই। দেশে এমন কোনো আইনকানুন পরিবর্তন হয় নাই যে তার প্রোডক্টটার বা তার কোম্পানিটার ভেলু অনেক গুণ বেড়ে গেল। তো কী কারণে ওই শেয়ারটা এতো টাকায় কিনতেছেন বা বিক্রি হচ্ছে সেটা রেগুলেটরদেরকে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত আমি মনে করি, এখানে যে সেকেন্ডারি রেগুলেটররা যারা আছেন তাদেরও আরও বেশি প্রাইজ সেন্সেভিটির ইনফরমেশনের একটি চিঠি দিয়েই সীমাবদ্ধ না থেকে আরও দূর অনুসন্ধান করার উচিত ছিলো।

আর দ্বিতীয়ত যেটা হলো, যেটা এখানে জাঙ্ক শব্দটা আসলে নাই। এটা আমরা যেগুলোর মূল ভিত্তি দুর্বল সেগুলাকে আমরা অথবা যারা ডিভিডেন্ট ঠিকমতো দেয় নাই অথবা যারা এজিএম ঠিকমতো করে না ওই কোম্পানিগুলোকে আমরা জাঙ্ক শেয়ার সচরাচর বলি ।

কিন্তু এ্রকচুয়েলি যেটা হলো গিয়ে আপনি এটা নিশ্চিত আপনার যে কিনবে তাকে আপনি বাঁধা দিবেন কেন, যেহেতু সেটা ট্রেড হচ্ছে। সেটা আপনি দিতে পারেন না। এখানে আরেকটা জিনিস আছে সিরিয়াল ট্রেডিং। এখন এখানে এই কোম্পানিটার পেছনে সিরিয়াল ট্রেডিং হচ্ছে কিনা, অর্থাৎ কারসাজি করে কেউ বৃদ্ধি করছে কিনা, সেটা রেগুলেটরা অবশ্যই দেখতে পারে।

প্রাইমারি রেগুলেটর, সেকেন্ডারি রেগুলেটর, আমি যেটা বলছিলাম যে ৩টা পক্ষ। এখানে আরেকটা পক্ষ কে? আরেকটা পক্ষ আমরা নিজেরা। যারা বিনিয়োগকারীরা, মূল রেগুলেটর যারা। আমরা যখন দেখতেছি যে কোনো পিএসআই ছাড়া, বা কোনো কারণ ছাড়াই একটা শেয়ারের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই যাচ্ছে। তখন আমাদের বুঝতে হবে যে এইটার পেছনে কোনো স্বার্থানেষী মহল অথবা কোনো সিরিয়াল ট্রেডিং থাকতে পারে। আমি আমার বিনিয়োগ করার পূর্বে আমি চিন্তা করে দেখবো যে এখানে ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু অত্যন্ত বেশি বিনোয়োগ করে আমি যদি এখানে লস হয় সেক্ষেত্রে আমি যেনো মার্কেটকে দোষারোপ না করি।

উন্নত বিশ্বে যেটা করে, যদি কোনোরকম কারণ ছাড়া যদি কোনো শেয়ারের দাম বৃদ্ধি বেশি পেতে থাকে সেক্ষেত্রে তারা যেটা করে ,তারা একটা ট্রেড সাসপেন্ড করে। প্রথম কাজ। অর্থাৎ এ ট্রেড আবার ওই যে ২ সপ্তাহ, ২ মাস /৩ মাসের জন্য সাসপেন্ড করে না। তারা খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। দ্রুত ট্রেড সাসপেন্ড করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং পদক্ষেপ বলতে ইনভেসটিগেশন করে। যার ফলে এটার দর বাড়াটা থমকে দাঁড়ায়। যে এইটা একটা ইনভেসটিগেশন হচ্ছে এটা কোনো সিরিয়াল ট্রেডিং হচ্ছে কিনা, কারসাজি চক্র এটার পিছনে কাজ করছে কিনা। এগুলা দেখে দ্রুত আবার ট্রেড শুরু করে। এটা করা দরকার। তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণটা কমবে।

আমাদের আর্থিক খাতের সুদের হার নিয়ে প্রথম বলবো যে, আমাদের মার্কেটে আমাদের এই আর্থিকখাতে যে ইনটারেস্ট রেট, শিল্পকারখানা তৈরিতে বা ব্যবসা বাণিজ্যে যে ঋণ দেয়া হয় সেটা অবশ্যই অনেক বেশি। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। আমাদের ডিপোজিট করে যারা অর্থাত আমানতকারীদের রেট সেটাও বেশি। এই রেটে ইনটারেস্ট নিয়ে, এই রেটে লোন নিয়ে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান কখনই সারভাইভ করা সম্ভব না।

আপনি খেয়াল করেন এবং এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক নিজেও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কারণ তাকেও তো  আমানতকারীদের হাই রেট দিতে হচ্ছে। যার ফলে সেও আলটিমেটলি গিয়ে উপকৃত হয় না। ব্যাংক উপকৃত হয় না ব্যবসাবানিজ্য তো উপকৃত প্রশ্নই উঠে না।  তো ব্যাংক ইন্টারেষ্ট কমতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, যে এভাবে কমালো কি উপকার হবে? আমার মনে হয় কোন ভাবেই হবে না। কারন আপনি  খেয়াল করেন এটা হলো ডিমান্ড ও  সাপ্লাইয়ের ব্যাপার। আপনার কি পরিমান আছে আপনাকে বুঝতে হবে ব্যাংকের টাকা তো লংটাইম ফাইনান্সের জন্য না। সিজেনাল গ্যাপ বা শর্ট টাইম ফাইনান্সের জন্য হলো ব্যাংকের টাকা। আপনার লংটাইম ফাইনান্সিং সেটা কেন ব্যাংকের থেকে আসবে? সেটা আসবে হয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে অথবা আপনার ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে। উন্নত বিশ্বে তাই হয়, কখনোই ফাইনান্সিং কর্মাশিয়াল ব্যাংকগুলা লংটাইম ফাইনান্সিং করে না।

আর যেটা হতে পারে, ডিমান্ড সাপ্লাই বা অর্থনৈতিক অন্যন্যা ইন্ডিকেটরগুলো আছে সেগুলো যদি ভালো হয়, টাকার সংকট যদি না থাকে তবে সুদের হার অটোমেটিক নিচে চলে আসবে। ব্যালেন্সও একটা জায়গায় চলে আসবে। আমরা দেখছি উন্নত বিশ্বের কোথাও কোথাও অনেক নিচে কোথাও মাইনাস ও হয়ে গেছে সুদ। উল্টা ব্যাংকে টাকা রাখলে টাকা দিতে হয়। তো আমাদের এখানে যদি এটা সাডেনলি করা হয়, মানে একটা ডেট বেঁধে দেয়া হয়, যেমন পহেলা জুলাই ২০১৮। এটা যদি করে তাহলে চারটা ঘটনা ঘটবে, যদি নয়/ছয় করে তাহলে চারটা ঘটনা ঘটবে।

প্রথমত একটা গ্রুপ টাকা নিয়ে চলে যাবে এখান থেকে। নামে বেনামে বিভিন্নভাবে টাকা উঠিয়ে সেভিং সার্টফিকেট কিনবে।  এখানে যা ইনভেষ্ট করবে সেটা সেভিং সার্টিফিকেট-এ। কারণ এখানে ১১ পার্সেন্ট ১২ পাওয়া যায়। দুই নম্বর হলো কিছু টাকা নিশ্চিত থাকেন বিদেশে চলে যাবে। সেই আবার আমাদের দেশের টাকা আমাদের বাইরের দেশে চলে যাবে। এরকম জোরাজুরি করে চলে না। তৃতীয়তো, কিছু টাকা সত্যি সত্যি ক্যাপিটেল মার্কেটে আসবে, অল্প কিছু।  আর চতুর্থত, আর একটা ঘটনা ঘটবে, সেটা হলো ল্যান্ড, বিল্ডিং, এপারটমেন্টের দাম আরও বেড়ে যাবে। যেটা আন প্রডাক্টটিভভাবে বেড়ে যাবে, যেটা অর্থনৈথিকভাবে ক্ষতিগস্থ হবো।  এটা অনেকটা বলা যায় যে, পলেসি লেভেলে যারা আছেন, তারা হয়তো অনেকটা বিভিন্ন বিষয়ে পেশারাইজড হচ্ছেন। পেশারটাকে ম্যানেজ করা উচিত ছিলো অর্থনীতির অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে। যেমন ধরেন সেভিং সার্টিফিকেট কেন ১১ পার্সেন্ট ১২ পার্সেন্ট হবে। কারন এই সেভিং সার্টিফিকেট লোয়ার ইনকাম গ্রুপের জন্য এবং এখানে অনেক হাজার কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু মোনিটরিং জিরো হ্যা এবং এই সেভিং সার্টিফিকেট এর ১১ পার্সেন্ট রেট নিয়ে সরকার আবার উচ্চবৃত্তদেরই উচ্চবত্ত করছে। অথচ যারা এটার টার্গেট গ্রুপ তারা এটার বেনিফিট পাচ্ছে না।

এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো ব্যাংক ইন্টারেস্ট বেশি, এখানে কোন দ্বি-মত নেই। এই রেটে ইন্টারেস্ট নিয়ে এদেশে শিল্প-কারখানা হবে না। কিন্তু আমার মনে হয়,  এভাবে ডেট না করে অর্থনীতির অন্যান্য যে ইন্ডেগেটরগুলো ছিলো সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিলো। যেমন, আনডিক্লেয়ার মানি’র বিনিয়োগের যে সুযোগটা, সেটা আমরা দিচ্ছি না। আমি কখনোই আনডিক্লেয়ার মানির পক্ষে নয়।  আমার বক্তব্য হলো যেটা একবার আনডিক্লেয়ার হয়ে গেলো সেটা যেন দেশের বাহিরে না যায়, দেশেই যেন বিনিয়োগ হয়। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না, হাজার-হাজার কোটি টাকা দেশের বাহিরে যাচ্ছে এটাও একটা কারণ।  তারপর অর্থনীতির চাকা ঘুরছে না, টাকাটা আনডিক্লেয়ার হয়ে যাওয়ার পরে কিছুতেই তা আর দেশে রাখা যাবে না, কোনভাবে দেশের বাহিরে পাঠানো যায় কিনা সেই চেষ্টা করা।  এটাই যে, বাহিরে পাঠানো বন্ধ করতে হবে।  এক্ষেত্রে ওই টাকাগুলো বিনিয়োগ করার একটা সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য যেখানে কালো টাকার উৎপত্তি হচ্ছে সেখানে নজর দিতে হবে। যাতে কালো টাকা উৎপত্তি না হয়। এগুলো অর্থনীতি ই›েডকেটরগুলোকে ঠিক করতে হবে। জোর করে চাপিয়ে দেওয়াই আরকটা অনৈতিকতার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষা করতে চাইলে তাদের ফোকাস করতে হবে ডিভিডেন্ড গেইনের দিকে। যে সকল কোম্পানিগু ডিভিডেন্ড বেশি দেয়, এবং মার্কেট বড় সেগুলোতে বিনিয়োগ করতে হবে। যদি আপনার বিনিয়োগকে নিরাপত্তা দিতে চান।  এক্ষেত্রে লাভের পরিমান কিছুটা কম হলেও আপনাকে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবেনা।

মাহবুব এইচ মজুমদার

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড।