দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা থাকা দরকার

ওয়ালটন। এক নামেই যার পরিচিতি। দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্যের জগতে তার সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে নতুন করে বলার নেই। বিশেষ করে এ দেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে ওয়ালটন একেবারে সামনের সারির নাম। ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজারে তাদের প্রবৃদ্ধি উল্লেখ করার মতো। এ দেশের আমদানিনির্ভর ইলেকট্রনিকস পণ্য কীভাবে দেশেই উৎপাদন শুরু হলো, আগামী দিনগুলোতে দেশের বাজার কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে, রপ্তানি বাজার ধরার কৌশল কী হবে, আসন্ন বাজেটে কী প্রত্যাশা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা, এসব বিষয়ে আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন-এবিটিভির সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়ালটনের নির্বাহী পরিচালক এস এম জাহিদ হাসান। তাঁর কথোপকথনের অনুলিখন তাঁরই জবানিতে ছাপা হলো।

বাংলাদেশে ইলেকট্রনিকস পণ্যের বর্তমান বাজার সম্পর্কে যদি আমি বলি, তাহলে বলতে পারি যে ইলেকট্রনিকস পণ্য আমাদের দেশে স্বাধীনতার আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এই পণ্য পুরোটাই আমদানিনির্ভর ছিল। বাজারটাও আদানিকারকদের দখলে ছিল, যার ফলে দেখা যেত যে নিম্নমানের পণ্য বাজারে চলে আসত এবং ক্রেতাসাধারণ এই নিম্নমানের পণ্য কিনতে বাধ্য হতো। আমরা যখন ওয়ালটন থেকে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকসজাত পণ্য বাজারজাত শুরু করি, তখন আমরা এ দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এ দেশের উপযোগী করে পণ্যগুলো উৎপাদন শুরু করি। যার ফলে এর মান ও দেশীয় উপযোগিতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে এই ইলেকট্রনিকস বাজারটাকে আমদানিনির্ভরতার জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে দেশীয় পণ্যের বাজারে পরিণত করতে পেরেছি। আমরা আমাদের দেশের অভ্যন্তÍরীণ চাহিদা মিটিয়ে ২০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করতে পারছি।

এই পণ্যটি আমাদের দেশে তৈরি করার আগে এটি সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত ছিল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের। পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের পরেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হতো এই ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানির জন্য। আজকে আমি বলতে পারি, সে জায়গটা দেশীয় উৎপাদনকারী যারা আছি, বিশেষ করে ওয়ালটনের কথাই বলতে পারি, কারণ আমরাই পাইওনিয়ার। বাজারটা আমাদের দখলে। এবং আজকে যদি একটি রেফ্রিজারেটরও বাইরে থেকে আর না আসে, তাহলেও বাংলাদেশের বাজারের কোনো সমস্যা হবে না। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতে পারব।

ওয়ালটনের মেজর পণ্য কী কী
আমাদের ওয়ালটনের অনেকগুলো পণ্য। সে ক্ষেত্রে আমাদের মেজর পণ্যগুলোর কথা যদি বলি, তাহলে প্রথমে বলব রেফ্রিজারেটরের কথা। তারপর বলতে পারি এয়ারকন্ডিশনার, টেলিভিশন, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, সুইচ, সকেট, এলইডি বাল্ব। এরই মধ্যে আমরা কমপ্রেসার উৎপাদন শুরু করে দিয়েছি। এটি বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য হিসেবে বাংলাদেশসহ বিদেশেও এক বছরের মধ্যে জায়গা করে নেবে বলে আশা করি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতি বছর ৪০ লাখ পিস কমপ্রেসার তৈরি করব। যা থেকে ২৫ লাখ পিস শুরুতেই রপ্তানি হবে।

২০২১ সালে তা ১ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হবে, যার থেকে ৮০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও ইচ্ছা ভিন্নমাত্রার পণ্য রপ্তানিযোগ্য করে তোলা। আমরা আশা করি আমাদের কমপ্রেসার বিশ্ববাজার দখল করবে। কয়েকটি দেশ পণ্যটি নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। আমাদের এই পণ্য উন্নতমানের হবে। পুরোটাই জার্মানির প্রযুক্তিতে তৈরি। আমাদের ১০০ জন প্রকৌশলীকে জার্মানি থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে এসেছি। তারপর জার্মানি থেকে ৫০ জনের মতো প্রকৌশলী আমাদের দেশে এসে আমাদের ফ্যাক্টরিটা রান করে দিয়ে গেছে। পরে আমাদের প্রশিক্ষিত কর্মীরা ফ্যাক্টরিটা চালাবে।

পণ্যের মানে আপস নেই
আমাদের পণ্যের মানের ব্যাপারে আমরা কখনোই কোনো প্রকার ছাড় দিই না। আমরা জানি, চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। যেহেতু আমাদের গ্রোথ প্রতি বছর বাড়ছে, সেহেতু আমরা মানের ব্যাপারে ছাড় দিতে নারাজ। আমাদের পণ্য যেখানে বাজার থেকে বড় বড় কোম্পানির পণ্যকে হটিয়ে দিচ্ছে, সে কারণেও আমাদের পণ্যের মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়।

বিদ্যুতের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে আমাদের রেফ্রিজারেটর ও কমপ্রেসারের ব্যবহার বেড়েছে, কারণ বিদ্যুৎ ছাড়া এ দুটি পণ্যের ব্যবহার সম্ভবই নয়। তাই যে এলাকায় বিদ্যুৎ থাকবে, সেই এলাকায় এ দুটি পণ্য লাগবে। সে কারণে আমাদের এ দুটি পণ্যের পথ চলা বেশ সুগম। কারণ এ দুটি পণ্যের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মধ্যে। উচ্চবিত্ত ফ্যামিলিতে এই পণ্য হয়তো বিলাসিতা, কারণ তারা ফ্রিজে রেখে খাবার খুব কমই খেয়ে থাকে। তারা অনেক সময় দু-একবেলা বাইরে খেয়ে থাকে। কিন্তু নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এই পণ্য বেশ প্রয়োজন।

কারণ তারা এক দিন বাজার করে তিন দিন আর বাজার না করলেই চলে। আবার এক দিন রান্না করে পরদিন আর রান্নার ঝামেলায় যেতে হয় না। একটা মুরগি কিনে যদি তারা তিন দিন খেতে পারে, সেটা তার জন্য সাশ্রয়ী। কারণ তারা সংসার ও কর্মজীবনে অনেকটা ব্যস্ত সময় পার করে। তাই তাদের জন্য এই পণ্য অপরিহার্য। এই শ্রেণির কথা চিন্তা করে, তাদের ক্রয় করার ক্ষমতার কথা চিন্তা করে, দেশীয় উপযোগী করে গুণগত মান ও মূল্য নির্ধারণ করে আমরা রেফ্রিজারেটর বাজারজাত করি। এর ফলে যারা শ্রমজীবী মানুষ, তারা কর্মক্ষেত্রে নিশ্চিত মনে কাজ করতে পারবে, স্বাস্থ্যগত দিক দিয়েও আমরা এগিয়ে যেতে পারছি।

আমি এখন বলতে পারি, ওয়ালটন ফ্রিজ সম্পূর্ণভাবে একটি দেশীয় পণ্য। কারণ আগে আমরা কমপ্রেসারটি বাইরে থেকে তৈরি করে আনতাম, এখন আমাদের ফ্যাক্টরিতেই উৎপাদন হচ্ছে।

কর্মসংস্থান ও ওয়ালটন
আমাদের প্রতিষ্ঠান সরাসরি ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ইতোমধ্যে ওয়ালটনের সার্ভিস সেন্টার আছ ৯০টির মতো। পরবর্তী পর্যায়ে দুইশর মতো সেন্টার করার ইচ্ছা আছে। কারণ আমরা চাই, আমাদের কাস্টমার যেন দ্রুত সার্ভিস পেতে পারে। প্রাকৃতিক কারণ, যেমন বজ্রপাতের কারণে একটি এলাকার সব কটি ফ্রিজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। অনেকে হয়তো এমন বলে, বিদেশি পণ্য কিনলে এমনটি হতো না। এটি সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। এ ক্ষেত্রে আমরা চাই, যত দ্রুততার সঙ্গে কাস্টমার তার পণ্যটি ব্যবহারের উপযোগী করে তার হাতে পেতে পারে, সেমই চেষ্টার জন্য সার্ভিস সেন্টার ২০০টির মতো করার পরিকল্পনা আছে, যাতে সব জেলার মানুষ তাদের হাতের নাগালে সার্ভিস সেন্টারটি পায়। আমরা সেটা দ্রুততার সঙ্গে করার চেষ্টা করছি।

আমাদের শোরুম আছে ৩০০টির মতো, যাকে আমরা ওয়ালটন প্লাজা বলে থাকি। এগুলো সরাসরি আমাদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং বাজেটে প্রত্যাশা
বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস খাতের সম্ভাবনা ও সমস্যার কথা বলতে গেলে আমি বলতে পারি, এখনো কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নামেমাত্র বাজারে আছে, যারা নিম্নমানের পণ্য আমদানি করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজারে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এদের পণ্যের মান নিয়ে ক্রেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিযোগ রয়েছে। আমরা যারা সরকারি সব আইনকানুন, নীতিমালা মেনে, ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত করছি; তারা ওই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছি। পাশাপাশি পাওয়ার, গ্যাসের কিছু সমস্যা রয়েছে, যা এখনো শিল্পের জন্য যতটা দরকার ততটা সহজলভ্য নয়। এ ছাড়া জায়গা পাওয়াও একটা সমস্যা। একটা শিল্প কারখানার জন্য যতটা জমি প্রয়োজন, ততটা জায়গা আমরা পাচ্ছি না। সরকার নিজেও অবশ্য আলাদা শিল্প জোন করার ব্যাপারে আগ্রহী। আমরা নিজেরাও আগ্রহী। তারপরও এসব সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমাদের কাজ করে এগিয়ে যেতে হবে।

বাজার দখলের ক্ষেত্রে বা মার্কেট শেয়ারের ক্ষেত্রে আমি আমাদের পণ্যের ব্যাপারে বলতে পারি, রেফ্রিজারেটরের ৭০-৮০ শতাশং বাজার আমাদের দখলে। টিভির ক্ষেত্রে ৫০-৬০ শতাংশ।  আমাদের নিকটতম প্রতিযোগী হিসেবে, অর্থাৎ উৎপাদনকারী হিসেবে আছে ভিশন, যমুনা, মাই ওয়ান, মিনিস্টার। তারা চেষ্টা করছে। আমি তাদের উৎপাদনের পরিমাণ জানি না।

সামনে আসছে বাজেট। বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা হলো, দেশীয় উৎপাদনকারীদের সরকার যেন পুরো সুযোগ দেয়, সরকারের নীতির মধ্যে থেকে। আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু বলছি না। আমরা চাই যাতে দেশীয় শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে পারে। দেশ অর্থনৈতিকভাব এগিয়ে যেতে পারে। আমার দাবি থাকবে, সব খাতে সবাইকে সরকার নীতিগত সহায়তা দেবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : শতভাগ দেশীয় মোবাইল ও টেলিভিশন
ওয়ালটনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলতে গেলে প্রথমে বলব, আমাদের একটি পরিকল্পনা ইতোমধ্যে পূরণ হয়ে গেছে, সেটি হচ্ছে কমপ্রেসার উৎপাদন। এরপর আরেকটি পরিকল্পনা হলো এলসিএম, অর্থাৎ এলসিডি টেলিভিশনের মূল যে জিনিসটা (লিকুইড ক্রিস্টাল মডিউল), সেটা আমরা আমাদের ফ্যাক্টরিতে তৈরি করব। তাহলে টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও আমরা সম্পূর্ণ দেশীয় উৎপাদনকারী হিসেবে ঘোষণা দিতে পারব। ১০০ ভাগ দেশীয় উৎপাদন বলতে পারব। পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করতে পারব। আমরা আশা করছি ২০১৮ সাল নাগাদ এটি শুরু করতে পারব।

এরপর একটি মোবাইল হ্যান্ডসেট ফ্যাক্টরিও করার ইচ্ছা আমাদের, যেটিতে ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ উৎপাদনে যেতে পারব বলে আশা করছি। তখন আমরা বলতে পারব এটি দেশীয় মোবাইল। টেলিভিশনের মাদারবোর্ড কিন্তু আমরা এরই মধ্যে তৈরি করছি; আর টেলিভিশন ও মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাদারবোর্ড প্রায় একই প্রযুক্তির, শুধু আকারে ছোট আর বড়।

একসময় আমরা বলতাম, বাংলাদেশ একটি সুঁইও বানাতে পারে না। কিন্তু এখন আমরা বলতে পারি, আমাদের রেফ্রিজারেটর আমাদের দেশেই তৈরি হয়। এরপর টেলিভিশন ও মোবাইল তৈরি হবে।

এস এম জাহিদ হাসান
নির্বাহী পরিচালক, ওয়ালটন