নাটোরসহ ১৪ জেলার শীর্ষ চার অঞ্চলে পেঁয়াজের ক্রপিং জোন স্থাপনের পরামর্শ

উৎপাদনের পরিধি ও পরিমাণ বৃদ্ধিতে প্রণোদনা এবং সংরক্ষণের ঘাটতি পূরণে হিমাগার স্থাপনের মাধ্যমে পেঁয়াজ সংকটের সমাধান সম্ভব। এ লক্ষ্যে নাটোরসহ শীর্ষ পেঁয়াজ উৎপাদনকারী ১৪ জেলার চারটি অঞ্চলে ক্রপিং জোন স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন কৃষক ও কৃষিবিদগণ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে দেশের ১৯টি কৃষি অঞ্চলের ৬৪ জেলায় দুই লক্ষ ৩৭ হাজার ৯২৮ হেক্টর জমি থেকে মোট ২৫ লক্ষ ৬৭ হাজার ৪৭০ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এরমধ্যে রাজশাহী অঞ্চলের নাটোরসহ বৃহত্তর রাজশাহীর চার জেলা এবং বগুড়া অঞ্চলের পাবনা ও বগুড়া জেলায় অর্থাৎ ছয় জেলার ৮৩ হাজার ৪৭১ হেক্টর জমিতে নয় লক্ষ ৩০ হাজার ৩০২ টন উৎপাদিত হয়। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারিপুর, গোপালগঞ্জ ও শরিয়তপুর জেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার ৮৩ হাজার ৭১৬ হেক্টর জমিতে নয় লক্ষ ৪১ হাজার ৪৮৩ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। যশোর অঞ্চলের কুষ্টিয়া, মাগুড়া ও ঝিনাইদহ জেলার ৩০ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে তিন লক্ষ ৪৪ হাজার ৬২৩ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। অর্থাৎ তিনটি অঞ্চলের ১৪টি জেলায় প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে ২২ লাখ ১৭ হাজার ৪০৮ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে-যা দেশের মোট উৎপাদনের ৮৬.৩৬ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ শতাংশ সংগ্রহ উত্তর বা সংরক্ষণকালে বিনষ্ট হয়ে ঘাটতি হয়। সেই হিসেবে মোট দেশজ উৎপাদনের ২৫ শতাংশ ঘাটতি বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে ১৯ লাখ ২৫ হাজার ৬০৩ টন। অন্যদিকে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি সাত লাখ ৯৩ হাজার ২২১ জন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং পরিসংখ্যান ব্যুরো’র যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন জনপ্রতি পেঁয়াজের চাহিদা ৩৬.২৮ গ্রাম। অর্থাৎ জনপ্রতি বাৎসরিক চাহিদা ১৩ কেজি ২৪২ গ্রাম। এ হিসেবে আমাদের দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ ৬১ হাজার ৬৪৩ টন। বর্তমানে সংরক্ষণ ঘাটতি বাদে বাৎসরিক উৎপাদন ১৯ লাখ ২৫ হাজার ৬০৩ টন। অর্থাৎ চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি থাকছে তিন লাখ ৩৬ হাজার ৪০ টন।
দেশে পেঁয়াজের বাৎসরিক ঘাটতি মাত্র তিন লাখ ৩৬ হাজার ৪০ টন। এর সাথে সংগ্রহ বা সংরক্ষণকালের ২৫ শতাংশ অপচয় যোগ করা হলে ঘাটতির পরিমাণ হয় চার লাখ ২০ হাজার ৫০ টন।

নাটোর পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত জেলা। আবার পেঁয়াজের গড় উৎপাদন দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক বেশী। কৃষি বিভাগ নির্ধারিত প্রতিদিন প্রতিজনের পেঁয়াজের চাহিদা ৩৬.২৮ গ্রাম এবং বছরে ১৩ কেজি ২৪২ গ্রাম। এ হিসেবে জেলার মোট ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৮ জন মানুষের বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ হাজার ৩১ টন। জেলায় মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ৭২ হাজার ২৩৭ টন। সংরক্ষণ ঘাটতির ২৫ শতাংশ বাদে অবশিষ্ট পেঁয়াজ থাকে ৪৬ হাজার ২১১ টন। জেলার মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৮ জন মানুষের বাৎসরিক চাহিদা ২৬ হাজার ২৬ টন পূরণের পরে জেলায় উদ্বৃত্ত থাকছে ২০ হাজার ১৮৫ টন-যা যাচ্ছে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ঘাটতির এলাকাগুলোতে।

নাটোর সদর উপজেলায় স্থাপিত কৃষি বিভাগ স্থাপিত ১০টি প্রদর্শনী খামারের মধ্যে তেবাড়িয়া ইউনিয়নের বাঙ্গাবাড়িয়া এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলাম বিঘায় ৮০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছিলেন। একই উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের আগদিঘা এলাকার কৃষক সবুজ আলী তাহেরপুর জাতের পেঁয়াজ চাষ করে ৭০ মণ ফলন পান। নলডাঙ্গা উপজেলার রামসার-কাজীপুর এলাকার কৃষক জিয়াউর রহমান তিন বিঘা জমিতে তাহেরপুর ও বারি-১ জাতের পেঁয়াজ আবাদ করে উভয় ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ মণ করে ফলন পেয়েছেন। অর্থাৎ নাটোরে পেঁয়াজের গড় উৎপাদন অনেক বেশী। আদর্শ কৃষকবৃন্দ ফলন পেয়েছেন হেক্টর প্রতি ২৪ টন পর্যন্ত এবং জেলার গড় ফলন সাড়ে ১৬ টন। অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে উন্নত বীজ সরবরাহ, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রদর্শনী খামারের পরিধি বাড়িয়ে অনায়াসে ঘাটতির অনেক বেশী পেঁয়াজ বিদ্যমান আবাদি জমি থেকেই উৎপাদন করা সম্ভব। আবার জমি থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে উন্নত করা গেলে এ পর্যায়ের ২৫ শতাংশ বিনষ্ট রোধ করা সম্ভব।

নাটোরের পেঁয়াজ চাষী সাইফুল ইসলাম বলেন, দক্ষ কামলার অভাবে জমি থেকে পেঁয়াজ তুলতে যেয়ে অনেক পেঁয়াজ কাটা পড়ে বা নষ্ট হয়। আবার ঘরের চাতালে পেঁয়াজ রাখলে শুকিয়ে ও পচে যেয়ে অনেকটাই কমে যায়। আলুর রাখার মত হিমাগারে পেঁয়াজ রাখার ব্যবস্থা করা গেলে বছরের শেষার্ধে এসে পেঁয়াজের সংকট আর তৈরী হবেনা।

এক বিঘা করে কৃষক পর্যায়ে প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে আমরা কৃষকদের উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করি। এসব প্রদর্শনী খামারের গড় ফলন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে কৃষক পর্যায়ে সহযোগিতা করা হলে উৎপাদন অনেক বাড়বে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মেহেদুল ইসলাম। আর এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে অন্যান্য কৃষকরা উৎসাহিত হবেন পেঁয়াজ চাষে। ফলে আবাদি জমির পরিধিও বাড়বে।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক নাটোরসহ সর্বোচ্চ পেঁয়াজ উৎপাদনকারী রাজশাহী, বগুড়া, যশোর ও ফরিদপুর কৃষি অঞ্চল জুড়ে পেঁয়াজের ক্রপিং জোন তৈরী করে কৃষক পর্যায়ে নিবিড় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের পরিধি বৃদ্ধি, তাদেরকে প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এবং এসব অঞ্চলে পেঁয়াজ সংরক্ষণের হিমাগার স্থাপন করা হলে দেশে আর পেঁয়াজ ঘাটতি থাকবেনা, বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে দেশ হবে রপ্তানীকারক দেশ।