নিরপত্তার স্বার্থেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে হবে

রনি রেজা
বিগত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে প্রতিবেশি হিসেবে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার মাসুল গুনছে বাংলাদেশ। ১৯৯১-৯২ সালে The state law and order restoration council (SLORC) নামে মায়ানমার সরকার উত্তর রাখাইন স্টেটে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দমনের নামে রোহিঙ্গাদের জাতিগত দমন প্রক্রিয়া শুরু করে। এর পর থেকেই বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে আছে রোহিঙ্গারা। ওই সময়েই প্রচুর রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। বাংলাদেশকে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামলাতে হচ্ছে বছরের পর বছর। গত কয়েক মাসে সেই সঙ্কট আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। বেসরকারি হিসেবমতে বর্তমানে প্রায় ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে রয়েছে। রোহিঙ্গার জাতিগত সমস্যায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া। এতে স্থায়ীভাবে বাসস্থান হারিয়ে বাংলাদেশের দিকে ছুটছে রোহিঙ্গারা। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক অধিকার রক্ষা ও বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে আনার কথা বলে রাজনীতি করে এসেছেন অং সান সু চি। কিন্তু গত তিন বছর ধরে উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ গণহত্যা চালালেও তিনি মুসলমানদের রক্ষায় একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। বরং তিনি সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমানদেরকে স্বীকৃতি না দেয়ার পক্ষে নানান সাফাই গেয়েছেন। উগ্রবাদী আখ্যা দিয়ে রোহিঙ্গা দমন প্রক্রিয়াকে বৈধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চি। তিনি দাবি করছেন, রোহিঙ্গারা কখনোই মায়ানমারের নাগরিক ছিল না। অথচ ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশে পূর্ব ভারত থেকে প্রায় খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ বছর পূর্বে অষ্ট্রিক জাতির একটি শাখা ‘কুরুখ’ (Kurukh) নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে, ক্রমান্বয়ে বাঙালি হিন্দু (পরবর্তীকালে ধরমান্তরিত মুসলিম), পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। এ সকল নৃগোষ্ঠীর শংকরজাত জনগোষ্ঠী হলো এই রোহিঙ্গা। বস্তুত রোহিঙ্গারা আরাকানের বা রাখাইনের একমাত্র ভুমিপুত্র জাতি। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। পক্ষান্তরে ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজ্য দখলদার কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা ‘আনাওহতা’ মগদের বারমা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করান। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস, দক্ষিণে বার্মার বংশোদ্ভুত ‘মগ’ ও উত্তরে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ‘রোহিঙ্গা’। আজ সেই রোহিঙ্গাদেরই অস্বীকার করা হচ্ছে। ১৯৪৮ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকেই তাদের চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে। সর্বশেষ ১৯৮২ সালে তথাকথিত নিউ সিটিজেনশিপ ল বা নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বটুকুও কেড়ে নেয় তারা। তাদের মায়ানমার বহির্ভূত বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হয়। আরোপিত হয় গ্রামের বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা। বন্ধ হয়ে যায় তাদের শিক্ষার সুযোগসহ সব মৌলিক অধিকারের দরজা। এভাবেই নিজেদের আবাসভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। এখন সেই ভূমি থেকেই বিতাড়িত করতে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে মায়ানমার সামরিক জান্তা। যা মানব ইতিহাসের লজ্জাজনক এক অধ্যায় রচনা করে চলেছে। এটা যদি তার রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতো তাহলে আমাদের মাথ ঘামানোর কিছু ছিল না। কিন্তু কারো অভ্যন্তরীণ বিষয় যখন অন্য কারও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেটা আর অভ্যন্তরীণ থাকে না। ভৌগলিক কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে সীমান্ত খুলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।

একথা সত্য মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর এখন যে নিপীড়ন চলছে তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও সকলের দায়িত্ব। তাদের আশ্রয় দেওয়া মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব কি শুধুই বাংলাদেশের? সমগ্র বিশ্ব চুপ করে থাকবে, আর বাংলাদেশকে সীমানা খুলে দিতে হবে? সীমান্ত খুলে দেওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আজ বাংলাদেশ দুই লক্ষ রোহিঙ্গাকে জায়গা দেবে ৬ মাস পর মিয়ানমারে আবার শুরু হবে রোহিঙ্গা নিধন আবার বাংলাদেশের প্রতি সীমান্ত খুলে দেওয়ার অনুরোধ আসবে; এভাবে কতদিন? জাতিসংঘের বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহবানও প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ আহ্বানের মাধ্যমে কি মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা তাড়ানোর মৌন সমর্থন প্রকাশ পায় না? তারা কি সমস্যাটি জিইয়ে রেখে আরাকান থেকে এ কৌশলে রোহিঙ্গাদের বের করে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে ঠেলে দিয়ে আরাকানের ভূমি বৌদ্ধদের নিরাপদ আবাসে পরিণত করতে চাচ্ছে? বাংলাদেশের প্রতি সীমান্ত খুলে দেওয়ার অনুরোধ করার আগে নিজেদের মাতৃভূমিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া বেশি জরুরি নয় কি? রোহিঙ্গা সমস্যা এখন যতই মানবিক হোক না কেন তা এখন ভূ-রাজনীতির জন্য জটিলতা সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। মায়ানমার ভালোভাবেই জানে, রোহিঙ্গারা একবার বাংলাদেশে ঢুকতে পারলে আর ফেরত নিতে হবে না। ইতিপূর্বেও সেটাই দেখা গেছে। মায়ানমার সরকার যেমন তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না তেমনি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারাও মায়ানমারে ফেরত যেতে চায় না। ভাষাগত ও ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশের প্রতি রোহিঙ্গাদের সমর্থন বা আকর্ষণ অনেক আগে থেকেই রয়েছে। ১৯৪৭ সালের ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বর ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ না হয়ে যদি ভাষাগত জাতিতত্ত্বে ভাগ হতো তাহলে আরাকান অবশ্যই বঙ্গের অংশ থাকত। যৌক্তিকভাবেই বঙ্গের অংশ, বাঙ্গালীদের অঞ্চল তো মিয়ানমারের অধীনে থাকার কথা নয়। কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হলে তা যে কোনো বিবেচনায়ই বংলাদেশের সঙ্গেই হওয়ার কথা। ভৌগোলিক দিক থেকেও আরকানের বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়াই সঙ্গতিপূর্ণ। কোনো যুক্তিতেই তা মিয়ানমারের অংশ হতে পারে না। ভারত পাকিস্তান ভাগাভাগির সময় তখনকার বার্মার রোহিঙ্গা নেতারা বার্মিজ মুসলিম লীগ গঠন করে মুহম্মদ আলী জিন্নার সাথে দেখা করে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। তারা চেয়েছিল রোহিঙ্গা মুসলিম প্রধান এলাকাগুলি পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হোক। মোহাম্মদ আলী জিন্না তা বাস্তবায়ন করেননি। জিইয়ে রেখেছেন রোহিঙ্গা সংকট। যার দুর্ভোগ এখনও সামলাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে মায়ানমার।

১৪৭৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের এই ছোট্ট ভূ-খ প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে আমরা নিজেরাই কোনোরকম আছি। এখনও আমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া অর্থ বাড়তি চাপ নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এসব রোহিঙ্গার একটি বড় অংশ সন্ত্রাসী, মাদক চোরাচালান ও অসামাজিক কাজে জড়িত। এছাড়া বড় ভয়টা হলো কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় থাকা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে এরা অবস্থান নিতে পারে। যেকোন উপায়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পায়তারা করছে এরা। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এরা নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গারা মধ্যপ্রাচ্য যাচ্ছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে। ফলে তাদের এসব অপকর্মের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশি শ্রমিকদের। আর এখনকার শরণার্থী রোহিঙ্গারা এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বাংলাভষী রোহিঙ্গারা। ঢুকে পড়বে জনবহুল শহর ঢাকাতেও। অর্থাভাবেই হোক আর অস্তিত্ব সংকটেই হোক জড়িয়ে পড়বে নানা অপরাধকর্মে। যার শিকার হবো আমরাই। তাই নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকেই উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতিতে মায়ানমারের কৌশলী প্রভাব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। শুধু অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতার দৃষ্টি থেকেই নয়। এ সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তার প্রয়োজনেই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

E-mail: ronyrejaulkarim@gmail.com