নীরবে বিকশিত হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প

দিনে দিনে আমাদের দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পোল্ট্রি বিজনেস। দেশীয় অর্থনীতিতেও এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য। তবে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ও সফলতার পেছনের গল্পটি কষ্ট, সাধনা আর অসীম ত্যাগের ইতিহাস। ২০০৭, ২০০৯ এবং ২০১১ সালে বার্ড ফ্লু’র ভয়াবহ সংক্রমণে এ শিল্পের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রায় ৫০ শতাংশ খামার বন্ধ হওয়ার পরও এ শিল্পের অগ্রগতি থেমে থাকেনি। এই পথচলা এত সহজ ছিলোনা। বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত শ্রম সাধনায় এসেছে সাফল্য, ঘটেছে নীরব বিপ্লব। পদে পদে নানান ঘাত-প্রতিঘাত, বিপর্যয়, বাঁধা-বিঘœতা পেরিয়ে উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, কঠোর পরিশ্রম, বিনিয়োগে উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টায় পোল্ট্রি শিল্প সফলতার অনন্য উদাহরণ। চাকরির বাজারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশের যুব ও যুব মহিলারা স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ আর সীমিত পুঁজি নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এই শিল্পকে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের তথ্য মতে, ডিম ও মুরগির মাংস রপ্তানি করে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে এখাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা। আশার খবর হলো, দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ শিল্প যে দেশের ডিম ও মাংসের শতভাগ চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি, কোন কোন সময় অতিরিক্ত উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো।

১৯৬৪ সালে ৩০ একর জমির উপরে গাজীপুরে এক ব্যক্তি উদ্যোগে পোল্ট্রি শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। তবে তথ্য উপাত্তে জানা যায়, বিকাশমান পোল্ট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ৯০ এর দশকে। ১৯৯৫-৯৬ সালে দেশি ও সোনালী জাতের মুরগীর বাইরে উন্নত জাতের লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগীর চাষে খামারিরা ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। আর বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর খাতটি এখন অনেকটাই আত্ম-নির্ভরশীল। এখানে যেসব মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত, তার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এ শিল্প থেকে আসছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প।

পোল্ট্রি শিল্পটি বড় হচ্ছে নীরবে নিভৃতেই। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এ শিল্প থেকে আসছে। বর্তমান বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ফিড মিলে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২৫ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন এবং লোকাল উৎপাদন প্রায় ১ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক। বর্তমান বাজারে মুরগির মাংস ও ডিম সবচেয়ে নিরাপদ খাবার। মুরগির বিষ্টা দিয়ে এখন বায়োগ্যাস ছাড়াও তৈরি হচ্ছে জৈব সার।

বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। এছাড়াও আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান। জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ। দেশে বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি। পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ফিড মিলে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২৫ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন এবং লোকাল উৎপাদন প্রায় ১ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়- জাপানের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে প্রায় ৬০০টি। বাংলাদেশের মানুষ খায় মাত্র ৪৫ থেকে ৫০টি ডিম। আমরা জানি উন্নত বিশ্বে ডিম গ্রহণের পরিমান বছরে প্রায় ৩৬০টি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর মতে, সুস্থ থাকার জন্য প্রতিটি মানুষকে বছরে অন্তত: ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার। মাংস খাওয়া উচিত নূন্যতম ১৮ থেকে ২০ কেজি। আমাদের দেশের মানুষ মুরগির মাংস খায় বছরে গড়ে মাত্র তিন দশমিক ৬৫ কেজি। অথচ আমেরিকায় মানুষ খায় বছরে গড়ে প্রায় ৫০ কেজি। বর্তমান সরকার ২০২১ সাল নাগাদ জনপ্রতি বার্ষিক ডিম খাওয়ার গড় পরিমাণ ১০৪টিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডিম এবং দৈনিক প্রায় ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। তার পেছনে বিনিয়োগ দরকার হবে প্রায় ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকা। পোল্টি শিল্পকে কেন্দ্র করে পরিচালনা, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ এবং খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমের সুবাদে আরো ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে ব্যবসা এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে পোল্ট্রি শিল্প। জানা গেছে, পোল্ট্রি শিল্পে ছোট বড় খামার রয়েছে ৭০ হাজারের বেশি। এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, প্রায় ১ লাখ প্রাণী চিকিৎসক, পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ, নিউট্রিশনিস্ট সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। বেসরকারিভাবে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ রয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা।

নতুন আশা নিয়ে সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১২০০ কোটি ডিম ও ১০০ কোটি ব্রয়লার উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছে এই শিল্পটি। বিভিন্ন সূত্রে জানা জানায়, ২০২১ সাল নাগাদ দেশে প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি ডিম ও প্রায় ৪ হাজার টন মুরগির মাংসের প্রয়োজন হবে। এই চাহিদা পূরণ করতে এ খাতে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়বে। এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণের সুদ, বীমার আওতায় পোলট্রি খাতকে নিয়ে আসা ও সরকারি সহায়তা দেয়ার সুপারিশ করেছে খাত সংশ্লিষ্টরা। পোল্ট্রি শিল্প উদ্যোক্তাদের মতে, খামারিদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, পোল্ট্রি শিল্পের জন্য বীমা প্রথা চালু এবং পোল্ট্রি নীতিমালা বাস্তবায়ন এ খাত থেকে ডিম ও মাংস রপ্তানি করে বছরে ১২ হাজার কোটি আয় করা সম্ভব। পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব হলে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে প্রতি বছর ১২০০ কোটি ডিম এবং ১০০ কোটিরও বেশি ব্রয়লার উৎপাদন করা সম্ভব। এই পদক্ষেপ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এই সেক্টরে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা তথ্যে বলা হয়েছে, ২০২১ সাল নাগাদ পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়ারে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ। আর তা হলে দেশের বৃহত্তর খাত হিসেবে পোল্ট্রি শিল্প আত্ম-প্রকাশ করবে। পোল্ট্রি খামার জেলা, উপজেলা থেকে ছড়িয়ে ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যায়ে চলে যাবে। পোল্ট্রি লিটার থেকে বছরে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।

ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে অনিরাপদ পোল্ট্রি খাদ্য প্রস্তুত ও বাজারজাত বন্ধ করতে হবে। পোল্ট্রি শিল্পের উৎপাদন আরও বাড়াতে এবং মান উন্নয়ন করতে উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞানীদের মেধার সমন্বয় ঘটাতে হবে। মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে পোল্ট্রি পণ্যের দাম ক্রেতার জন্য সহনীয় রাখা। ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা। পাইকারি বাজার ব্যবস্থায় খামারি কিংবা উদ্যোক্তাদের সমন্বয় ঘটানো। শিল্পের বিকাশেএকটি পোল্ট্রি বোর্ড গঠন করা। পোল্ট্রি শিল্পকে বীমার আওতায় আনতে হবে। পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ সহজ ও শুল্কমুক্ত করতে হবে।