‘নো হাউ’র কোনো বিকল্প নেই

শুরুতেই যে বিষয়টা আমরা বলতে চাই তা হলো, পৃথিবীর দুটো বৃহত্তম স্টক এক্সেচেঞ্জ আমাদের সাথে পার্টনারসিপে এসেছে। শুধু দুটো বৃহত্তম স্টক এক্সেচেঞ্জই না, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এখন আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে। এটা হলো সবচেয়ে বড় আশার আলো। কারণ, আমরা যদি আমাদের দেশ নিয়ে একটু চিন্তা করি, আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে তুলনা করি, দেখবো পাকিস্তান, ভারত, ভিয়েতনামসহ অনেকগুলো দেশের তুলনায় একটা ছোট দেশ, যেখানে অনেক লোকসংখ্যা। যাদের ৬০ শতাংশের বেশি লোক ৩২-৩৫ বছর বয়স্ক, ক্রয় ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে বেশ অনেকদিন থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই এবং খুবই স্থিতিশীল রয়েছে মুদ্রামান। আপনি পাকিস্তানে দেখেন ৬০-৭০ শতাংশ কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশন হয়েছে, ভারতেও অনেক হয়েছে, কেবল বাংলাদেশে হয় নাই। যে সমস্ত বিনিয়োগকারী মুদ্রার এই অবমূল্যায়ন দেখতে চায়, তাদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাসেজ।


গত দশ পনের বছর ধরে জিডিপি’র ধারাবাহিক গ্রোথ, এটাও গ্লোবালি আকর্ষণ হওয়ার মত একটা বিষয়। ২০১৯ সালের আউটলুক হলো সিরিয়ার পরে বাংলাদেশে ৭.৯ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ, তুলনামূলকভাবে যেখানে চায়না স্লো ডাউন। সবকিছু মিলিয়ে গত পাঁচ সাত বছর ধরে দেশের এই ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে একটা গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচক হিসেবে আগ্রহ তৈরি করেছে। কারণ, সবাইতো উন্নতির বিষয়গুলো দেখতে চায়।

আমরা একটা রুগ্ন জাতি ছিলাম। সেখান থেকে আমাদের যে উন্নতি হয়েছে, এই উন্নতিগুলো আন্তর্জাতিক রাডারে ধরা পড়েছে। এই কারণে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, এই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ দিনকে দিন বাড়ছে। তাদের আগ্রহও বাড়ছে। এই আগ্রহের কারণে এবং আমাদের স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন প্রকল্পের শর্ত হিসেবে কিন্তু এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ। অনেক দিন চেষ্টার পর চায়নিজদের এই অংশীদারিত্ব। চায়নিজরা আমাদের এখানে শুধু যে ব্যবসা করার জন্যই এসেছে তা নয় বরং আমাদের এই উদীয়মান বাজারের সাথে থাকতে চায়। সবাই চায় সফল একটা বাজারের সাথে থাকতে। এই বাজার নিয়ে সবার অনেক আশা, সেই জায়গাটাতে চাইনিজরা এসেছে। আমাদের সিস্টেমে তারা ইন করেছে। শুধু যে আমাদের স্টক মার্কেটে তারা এসেছে তা না, তারা অর্থনীতির অনেক বিষয় নিয়ে আসছে। বাংলাদেশের অনেক প্রকল্পে তারা জড়িত।

এখানে অনেক ফান্ডের ইস্যু আসবে একসময়। ভবিষ্যতে শুধু যে তারা বিদেশ থেকে ফান্ড নিয়ে আসবে তা নয়। এই দেশ থেকেও লোকাল ফান্ডগুলোকে চ্যানেলাইজ করতে হবে স্টক মার্কেটে।

চায়নার দুটো স্টক এক্সচেঞ্জ যে জায়গাগুলোতে সফল হয়েছে, যেমন একটা স্টক এক্সচেঞ্জ এসএমই লিস্টিংয়ে সফল হয়েছে। অনেক বছর থেকে এসএমই লিস্টিংয়ে সর্বোচ্চ নাম্বারে আছে। ওই জায়গায় তারা বিশ্ব রেকর্ড করেছে।
সব কিছু মিলিয়ে ওদের যে ‘নো হাউ’টা আছে, চায়নাদের অংশীদারিত্বে এই ‘নো হাউ’র অংশে আমরা লাভবান হবো। এই ‘নো হাউ’টা যদি আমরা পেতে পারি লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে, টেকনোলোজির ক্ষেত্রে, লেনদেনের ক্ষেত্রে, ক্রসবর্ডার লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে, মনোনিবেশের ক্ষেত্রে, তাহলে সব কিছু মিলিয়ে অনেকগুলো জিনিস আমরা ওদের মাধ্যমে পাবো।

আমরা এমন একজনকে পেয়েছি, যারা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরীক্ষিত এবং সফল। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এরা আমাদের সাথে এসেছে, আমরা অনেক কিছু তাদের কাছ থেকে পাবো। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এই পার্টনারশিপে দীর্ঘমেয়াদী কিছু পাবো বলেই আমরা আশা নিয়ে বসে আছি।

চায়নারা আমাদের বাজারে ঢুকে গেছে বলেই যে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক অনেক বেড়ে যাবে এটা আশা করার কোনো কারণ নেই। কারণ অবকাঠামোতে অনেক পরিবর্তন আশা দরকার। প্লাটফরম বলতে বুঝাচ্ছি, ‘নো হাউ’ বলতে বুঝাচ্ছি। অনেক কোম্পানি লিস্টিং নাই। আমরা কথায় কথায় বলি লিস্টিং হয় না কেন? লিস্টিং হওয়ার বেনিফিটটা কি? ব্যবসায়ী কিন্তু সব সময়ই ব্যবসা চায়। সে যদি ব্যবসা পায়, সে লিস্টিং হবে না কেন, অবশ্যই হবে। তাকে আটকিয়ে রাখতে পারবেন না। কারণ এটা একটা ভ্যালুয়েশন গেম।

নাম্বার টু হলো, যদি বিনিয়োগকারী দেখে যে, ব্যাংকের চেয়ে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ অধিক নিরাপদ, সেখানেও একটা কাজ আছে আমাদের, প্রমোট করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ যাতে খর্ব না হয়, এ বিষয়গুলাকে যখন আরও জোরদার করা হবে, তখন বিনিয়োগকারী দেখবে যে এখানে রেপুটেশন উন্নত হয়েছে। তখন তাকে আর আটকে রাখা যাবে না। সেও চলে আসবে একসময়। গ্লোবালই এটাই হয়েছে। তাই সব কিছু মিলিয়ে আমরা বিশ্বাস করি, কেউ যদি সিস্টেমের মধ্যে থাকে, তাকে জোর করে আনার দরকার নেই। কাউকে লিস্টিং করার জন্য বলার দরকার নেই, সে-ই আসবে।

কাউকে যথাযথ বেনিফিট দিলে, সেই বিনিয়োগকারী ব্যাংকে টাকা রাখবে না, সে স্টক মার্কেটে রাখবে। কারণ মানুষের টাকার ধর্ম হলো, আগে নিরাপত্তা পরে লাভ। কেউ যদি দেখে যে, এখানে টাকা আনা নিরাপদ, তাহলে সে ফান্ড আনবে। ফান্ড ম্যানেজারের মাধ্যমে সে বেনিফিটটা ম্যানেজ করে নিবে। সবকিছুই মিলিয়ে। তারপর তো চাইনিজ ‘নো হাউ’ আছে। কিভাবে এটা কাজ করে, কিভাবে বিনিয়োগকারীদের আত্মরক্ষা করা হয়। এসব জিনিসগুলাকে কিভাবে সুরক্ষা দেয়া হয়। টোটাল জিনিসগুলা কিন্তু ফেইস বাই ফেইস এক দিনে আসবে না। এর জন্য ধাপে ধাপে সময় প্রয়োজন। ওরা আসছে মানে ওদের গ্রহণযোগ্যতা, মানে ওদের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি নিতে পারবো। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে নতুন কোনো কর্মী যোগ দেয়, তাহলে পুরনো কর্মীদের সাথে মিশতেও তো ছয় মাস এক বছর লেগে যায়। একইভাবে ওদেরকে গ্রহণ করার মানসিকতা আসতে আসতে সময় লেগে যাবে। এক সময় যখন আমরা বিষয়টাকে বুঝবো গ্রহণ করবো, তখন কাজগুলো অনেক সহজ হবে সুন্দর হবে।

একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের স্টক মার্কেটে সবচেয়ে বেশি ব্র্যাক ইপিএলের মাধ্যমে এসেছে। এটাতে আমরা এখনও পায়োনিয়ার। কিভাবে হয়েছি এটা? ২০১৩ সালে আমাদের কি অনেক বড় কিছু করতে হয়েছে? হ্যা, আমাদের ছোট একটা কাজ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ যে একটা প্রসপেক্টিভ কান্ট্রি, বাংলাদেশের কিছু কোম্পানি ছিল আন্ডার ভ্যালুড। আমরা তাদের কাছে এটা নিয়ে গিয়েছি। আমরা তাদেরকে ব্রোশিউরের মাধ্যমে দেখিয়েছি অনেক ভালো ভালো কোম্পানি আছে, এগুলোতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিজনেস অপরচুনিটি। দীর্ঘ সময়ের জন্য এ বিনিয়োগে লাভবান হওয়া যাবে। তাকে আর কিছু বলতে হয়নি। ২০১২-১৩ সালে তখনও আমাদের বাজারে অনেক ঝুঁকি ছিল। এখন তো ঝুঁকিগুলো অনেক কমে এসেছে। তখন তারা বাংলাদেশের কান্ট্রি রিস্কটাকে মাথায় রেখে, রিস্ক যেহেতু বেশি, তাই রিটার্ন পার্সপেক্টিভে রিস্কটাকে নিয়েছে তারা। নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তারা ২২-২৫ টাকায় ব্র্যাক ব্যাংক কিনেছে এবং এখান থেকে একটা ভালো লাভ করেছে। এ ধরণের রিটার্ন উন্নত দেশে তারা পাচ্ছে না। যে কারণে তারা একটু ঝুঁকি নিয়েছে, বেশি কিছু করতে হয়নি। ইতিমধ্যে অনেক নিয়মের উন্নতি হয়েছে। আমার মনে হয়, এখানে বিদেশি বিনিয়োগ যেভাবে এসেছে, পার্ট অব দি গেম চায়নিজরাও সেভাবে এসেছে। আমরা হয়তো এক সময় বুঝতে সক্ষম হবো যে চায়নিজদের কেন দরকার আছে। কেননা আমাদের দেশেও এখন অনেক বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প হচ্ছে বা হবে।
এগুলোর জন্য সব তো আর বিদেশি বিনিয়োগে হবে না, কিছু লোকাল পার্টনারশিপ হবে। যদি পার্টনারশিপে হয়, তাহলে টাকাটা বের করার জন্য হলেও তো লিস্টিং হতে হবে। এসব জিনিসগুলো যখন আসবে, সময়ের আবর্তে মানুষ কিন্তু এগুলো করে ফেলবে।

আমারা যদি দেখি, গত বছর আমাদের ব্যাংকিং খাতে অনাদায়ী ঋণ, খেলাপি ঋণসহ যত রকমের সমস্যার কথা শুনেছি, আমার মনে হয় নতুন অর্থমন্ত্রীও সেসব বিষয়ে প্রথম থেকে সোচ্চার রয়েছেন। উনি এনপিএল নিয়ে কথা শুনতে চান না। উনি কিছু বেসিক বার্তা সবাইকে দিয়েছেন। দেশের একটা বড় সমস্যা দুর্নীতি। দুর্নীতি নিয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিনই একটা না একটা কথা বলে আসছেন। সুতরাং তারা কিন্তু বুঝেন যে, কোনটা এখন সেল করতে হবে, কোনটা এখন আমাদের জন্য বটলনেক।

এ বিষয়গুলো কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মাথায় আছে। এ জিনিসগুলো বিদেশিরা শুনতে চায়। তারা বুঝতে চায় আমরা কোন জাগাটায় সোচ্চার। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার, আমরা সোচ্চার এনপিএল নিয়ে। আমি মনে করি, আমাদের এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ, এই ‘নো হাউ’ আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে এবং নিয়ে যেতে বাধ্য। কারণ আমরা কিন্তু সব কিছু গ্রহণ করছি। আমাদের স্বাধীনতার পরে, আমরা কিন্তু এখনও কোনো কিছুতে ফেইল করিনি। হ্যা কারেন্ট ব্যালেন্স গত বছর প্রথমবারের মত নেগেটিভ হলো। এর আগে নেগেটিভ হয়নি। আমরা ভালো পেমেন্ট মাস্টার।
আমি প্রায় বলে থাকি, বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশে কিন্তু এখনো বোয়িং সেভেন এইট সেভেন ড্রিমলাইনার কিনতে পারে নাই। অথচ আমরা দুটো সেভেন এইট সেভেন কিনে ফেলেছি। নিশ্চয় আমরা ভালো পে মাস্টার। আমরা ডিফল্টার না। সেজন্য বোয়িং কোম্পানি আমাদের সাথে বিজনেস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে।
এসব কিছু বিবেচনা করে বলা যায়, চায়নারাও এখানে ভালো করবে। আমি মনে করি, আমাদের কোনো পার্টনারশিপ আর কখনো ফেল করবে না। আমিতো শুনেছি, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটা হয়েছে, আরও দুই তিনটা আসতে চাচ্ছে। পাওয়ার সেক্টরের মধ্যেও কাঠামোগত আরও পরিবর্তন আসবে। সবকিছুই পজিটিভ। এখন কাজে লাগানোটা সময়ের ব্যাপার।

ইকোনোমিতে যদি পঞ্চাশ বছরের একটা হিস্ট্রি দাড় করালে দেখা যাবে, ইউরোপের ইকোনোমি ছিল ব্যাংক নির্ভর। ইউএসবি, বার্কলেস, ইউবিএস’র মত বড় বড় ব্যাংকগুলো ছিল এখানে। কিন্তু আমেরিকানরা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং কনসেপ্টটা কাজে লাগিয়ে তাদের ইকোনমিকে দ্রুত গ্রো করাতে সক্ষম হলো। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং কনসেপ্টটা কাজে লাগিয়ে এন্টারপ্রেনারদের তারা প্রমোট করেছে। এন্টারপ্রেনারসিপ স্কিল গ্রো করেছে। যে কারণে বিশ্বের বিশটা বড় নামকরা ব্রান্ড কোম্পানির মধ্যে পনেরটাই আমেরিকান কোম্পানি। গুগল, ফেইসবুক, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন এসবই আমেরিকান কোম্পানি।

আমার কাছে মনে হয় উন্নয়নের এসব বিষয়গুলো ক্যাপিটাল মার্কেটে আসতেই হবে। কারণ আপনার বড় প্রজেক্ট করতে হলে অবশ্যই পুঁজির দরকার। আমাদের দেশের কোম্পানিরা একসময় ছোট ছোট প্রজেক্ট করতো। ব্যাংকের থেকে টাকা নিতো। কিন্তু এখন কোম্পানিগুলো এত বড় বড় প্রজেক্ট করে যে, ব্যাংক ফাইন্যান্স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ ব্যাংক থেকে টাকা নিলে কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যায়। তাই এখন অনেক বড় বড় গ্রুপ কস্ট নিয়ে ভাবছে। কাজেই তারা বিকল্প ভাবছে। কেউ বিদেশি ফান্ডের চিন্তা করছে, কেউ বিদেশি ঋণ নিচ্ছে, আবার কেউ লিস্টিংয়ের দিকেও ঝুকছে। ছোট আকারে হলেও কিন্তু বড় বড় কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসছে। ইউনাইটেড গ্রুপের একটা পাওয়ার প্লান্ট এসেছে। বসুন্ধরা গ্রুপ এসেছে, ওয়লটন আসতে চাচ্ছে, রানার গ্রুপ আসছে। আমরা দেখছি, বড় বড় কোম্পানিগুলো চিন্তা করছে, পুঁজিবাজারে আসার অন্তত একটা উইন্ডো খোলা রাখি। যেখানে আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ব্যাংক নির্ভর। সেখান থেকে বের হয়ে পুঁজিবাজারমূখী হতে তো একটু সময় লাগবে। এটা সময়ের ব্যাপার।

এখন মানুষের সঞ্চয়টা ব্যাংক নির্ভর। এটাকে চ্যানেলাইজ করতে হবে পুঁজিবাজারে। এটা কিন্তু রাতারাতি করে যাবে না। এখন যদি রাতারাতি ব্যাংক থেকে সব টাকা স্টক মার্কেটে চলে যায় তাহলে ব্যাংকিং সেক্টর একটা সমস্যায় পড়ে যাবে। এটা হতে হবে ধাপে ধাপে। যেমন সরকার ব্যাংকের ইন্টারেস্টের উপর একটা ক্যাপ দিয়েছে। এখন মানুষ চিন্তা করবে যে, সরকার চায় না ইন্টারেস্ট রেট সিংগেল ডিজিটের উপর উঠুক। এখন ইন্টারেস্ট রেট কম রাখা মানে ডিপোজিট রেটও কমে যাচ্ছে। সুতরাং যারা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে বা কর্পোরেট ব্যাংকে টাকা রাখতো, পাঁচ সাত দশ পার্সেন্ট হারে এফডিআরে সুদ পেতো, তাদের আয় এখন অর্ধেক হয়ে গেছে। তারা এখন চিন্তা করছে, বিকল্প কি আছে, স্টক মার্কেটে যাওয়া যায় কিনা। স্টক মার্কেটে যদি দশ শতাংশ লাভ পাওয়া যায়, তাহলে কেন স্টক মার্কেটে আসবে না। ঝুকি তো থাকবেই, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে, রিটার্ন বিবেচনায় এই ঝুকিতো নেয়াই য়ায়। এ বিষয়গুলো আসছে, ওই সিস্টেমে পরিবর্তন আনার কারণে। সুতরাং সময় লাগবে, রাতারাতি হবে না, দিনশেষে অবশ্যই আমরা লাভবান হবো।

চায়নারাতো বলেই দিয়েছে, তারা কোন কোন জায়গায় কাজ করবে, কোথায় কোথায় ফান্ডিং করবে। তারা টেকনোলজিতে কাজ করবে। এরইমধ্যে চায়নাতে গত বছর টেকনোলজির উপর কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হলো। সেখানে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন ব্রোকার হাউজ থেকে, আইটি থেকে লোকজন নিয়ে গেছে। তাদেরকে টেকনোলজির উপর ফোকাস করেছে, আধুনিক প্রযুক্তি, আর্টিফিসিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমি মনে করছি ওদের কিছু প্রোগ্রাম থাকবে, এক্সচেঞ্জ কিভাবে কাজ করে, ‘নো হাউ’টা কিভাবে কাজে লাগানো যায়, লিস্টিংয়ের বিভিন্ন ধাপগুলো সম্পর্কে নলেজ বিনিময় করার জন্য আমাদের এক্সচেঞ্জ থেকে কিছু লোক ওরা নিয়ে যাবে। একই সাথে সেন্ট্রাল ক্লিয়ারিং সেটেলমেন্ট, ডেরিভেটিভ্স এসব নিয়ে এডিবি কিছু কাজ করছে। এসব কিন্তু সমন্বিত কাজেরই একটি অংশ।
আমাদের মার্কেটে কিন্তু ২০১০’র ধ্বসের পরে, স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদি অনেক কাজ হচ্ছে, আমারা একসাথে দেখতে পাচ্ছি না। আমারা ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন না করলে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার পেতাম না। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রোজেক্টগুলো ছিল সক্ষমতা তৈরির জন্য। সেন্ট্রাল ক্লিয়ারিং সেটেলমেন্ট কোম্পানি না হওয়ার কারণে আমারা বন্ড মার্কেট অ্যাক্টিভ করতে পারছিলাম না। ডেরিভেটিভস্ অ্যাক্টিভ করতে পারছিলাম না। এ্যাক্সেজ ট্রেডেড ফান্ড অ্যাক্টিভ করতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন সেন্ট্রাল ক্লিয়ারিং সেটেলমেন্ট কোম্পানি হয়ে যাবে, তখন অনেকগুলো বিষয় একসাথে কার্যকরী হয়ে যাবে। তখন ডেরিভেটিভস্ যুক্ত হবে, তখন সুকু যোগ হবে। এই সবগুলো কিন্তু একেকটা কাজের একেকটা রোল। এই পার্ট অফ দি রোলের মধ্যেই চাইনিজ পার্টনারশিপও একটা। এটাকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। এক্সচেঞ্জের ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের শর্তে ছিল বিদেশি পার্টনারশিপ আনতে হবে। কাজেই এটা কিন্তু সামগ্রিক ফ্রেমওয়ার্কের একটা আউটপুট। বিষয়টাকে যদি শুধু পার্টনারশিপ চিন্তা করি তাহলে হবে না। চায়নিজ পার্টনারশিপ চলছে। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং নিয়ে কাজ চলছে। নতুন নতুন ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে কাজ হচ্ছে। মার্কেট ম্যাকানিজম নিয়ে কাজ হচ্ছে।
আমারা যখন শ্রীলংকা গিয়েছি, তখন ওদের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন বলছিল, আমরা দুই বছরেও অনেক আইন পরিবর্তন করতে পারি না, অথচ তোমরা তো প্রতি বছরই অনেক আইন নিয়ে কাজ করো। অনেক আইন পরিবর্তন করছো, পরিবর্ধন করছো। এই সব জিনিসগুলো কিন্তু ইন্ডিকেশন।

এখন আপনি যদি বাংলাদেশ কে নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের চোখে দেখেন, তাহলে তো হবে না। বাংলাদেশকে দেখতে হবে বাংলাদেশের চোখে। ৪৭ বছরের একটা দেশ। আমাদের অনেক সমস্যা ছিল। সবকিছুকে কাটিয়ে একটা নেতৃত্ব এসছে। দুই টার্ম যাওয়ার পর এই সরকার এবার টানা তৃতীয় মেয়াদে এসেছে। সরকারের এই ধারাবাহিকতা, সবকিছু মিলিয়ে ইন্ডিকেশন হচ্ছে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমি মনে করি, আমরা অনেক দ্রুত অনেকের চেয়ে অনেক ভালো এগিয়ে যাবো।

চায়নিজ কনসোটিয়ামের মধ্যে যে ফান্ডিং হবে সেখানে তারা বলেছে, ডিসক্লোজারের উপরে তারা একটা প্লাটফরম করে দিবে। যেখানে কোম্পানিগুলোর কাছে কোন বিনিয়োগকারির যদি কোনো কোয়ারি থাকে, তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বা ভায়া হয়ে ওই কোয়ারি বা প্রশ্ন যাবে ওই কোম্পানির কাছে। এগুলো তো পার্ট অফ দি স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ। নয়টা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তো তারা ফান্ডিং করবে, হয়ে যাবে। শুধু একটু অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।

আশার জায়গাটা হলো, আমি সবসময় বলে থাকি, যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের দেশে ধাবমান হচ্ছে, তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষার জন্য, তারা অনেক কিছু আমাদের দেশে করবে। শুধু এক চায়নিজ পার্টনারশিপ দেখেই বসে থাকলে হবে না। আমাদের দেশে অনেক কিছু হবে। আমাদের দেশে সব কিছুই আছে, শুধু ‘নো হাউ’ দরকার। আমরা স্টক এক্সচেঞ্জকে বা রেগুলেটরকে যদি সেই ‘নো হাউ’টা দিতে পারি। এটা কিছুই না, উন্নত বিশ্বে কি হচ্ছে, সেটা যদি আমি এখানে সেট করতে পারি, তাহলে তো আমি উন্নত বিশ্বের মত হবো। সে জিনিসগুলো তো আমার কাছে আসতে হবে।

আজকে বিদেশি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংক মাত্র কয়েকটা ব্রাঞ্চ দিয়ে আমাদের দেশে এত ব্যবসা করছে কিভাবে? কারণ তারা জানে, তাদের কাছে ‘নো হাউ’ আছে। তাদের ৫-৭টা শাখা দিয়ে তারা অনেক লোকাল ব্যাংকের চেয়ে বেশি বিজনেস করছে। কেন পারছে, কারণ তাদের কাছে ‘নো হাউ’ আছে। তারা জানে কিভাবে বিজনেসটা করতে হবে। সুতরাং আমার মনে হয়, আমাদের এই মুহর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এবং একমাত্র প্রয়োজন হচ্ছে ‘নো হাউ’।

শরীফ এম এ রহমান
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড