পঞ্চগড়ে বন্ধ হচ্ছে না কৃষি জমির উর্বর মাটি কাটা

আইন অমান্য করে পঞ্চগড়ে ফসলি জমির উর্বর মাটি কাটা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এতে কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বর শক্তি। জানা গেছে, পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ, বোদা ও আটোয়ারী উপজেলার শতাধিক ইটভাটার মালিক প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমির উপরের উর্বর মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। জৈব পদার্থ বা গুণ সমৃদ্ধ মাটির উপরের অংশেই সঞ্চিত থাকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ও উপকারী অনুজীব যা পুড়িয়ে তৈরি করছে ইট। কৃষকদের ফুসলিয়ে স্বল্প মূল্যে কৃষি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছে ভাটা মালিকরা। এতে সহায়তা করছে মাটি সরবরাহকারী এক শ্রেণির দালালচক্র। ১০ থেকে ১৫ ফুট গর্ত করে ফসলি জমির মাটি কেটে শত শত ট্রাকে করে ইটভাটায় স্তুপ করে রাখা হয়েছে। ৩০ থেকে ৪০ লাখ ইট তৈরি করতে প্রতিটি ভাটায় প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ সিএফটি মাটি প্রয়োজন। সে হিসেবে পঞ্চগড় জেলার শতাধিক ইটভাটায় প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমির উপরের উর্বর মাটি নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কৃষি জমি ও উঁচু জমি পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে।

আইন অনুযায়ী কৃষি জমির মাটি ইটভাটায় ব্যবহার নিষিদ্ধ। প্রতি বছর এত বিপুল পরিমান কৃষি জমি নষ্ট হলেও প্রশাসনের তেমন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ভাটা মালিকরা প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট হওয়ায় প্রকাশ্যেই পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। ইটভাটায় মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিশেষ করে টপ সয়েলের ব্যবস্থা বন্ধ করা, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও কোন ইটভাটার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের শশ্বান কালী নয়নপাড়ার ধনঞ্জয় রায় জানান, প্রতি বিঘা জমির টপ সয়েল মাটি ২৬ হাজার টাকা দরে কেনা হয়। প্রতি ট্রলি মাটি ভরাটে শ্রমিকরা পান ১২০ টাকা। প্রতিদিন একেকটি ইটভাটায় ৩০০ এর বেশি ট্রলির মাটি সরবরাহ করা হয়। বোদা উপজেলার ভাসাইনগরের এমএমএল ব্রিকসের ম্যানেজার জগদীশ চন্দ্র রায় জানান, আবহাওয়া ভালো থাকলে প্রতি মৌসুমে একটি ইটভাটায় পাঁচ বার ইট পোড়ানো যায়। একবারে ৫ লাখ থেকে ৮ লাখ পর্যন্ত ইট তৈরি হয়। এজন্য আড়াই থেকে পাঁচ লাখ সিএফটি মাটি প্রয়োজন হয়। প্রতি ট্রলি মাটি ৪০০-৫০০ টাকায় ক্রয় করা হয়। দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শামীম ইকবাল জানান, ‘টপ সয়েল কেটে নেয়া জমিতে ১৫-২০ বছরেও ফসল ফলানো সম্ভব হবে না। কৃষি জমি নষ্ট বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে কৃষি জমি হ্রাস পাবে এবং খাদ্য সঙ্কটের পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে।’বোদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ জানান, ‘ইটভাটা মালিকরা অর্থের লোভ দেখিয়ে কৃষি জমি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। সাময়িকভাবে কৃষকরা লাভবান হলেও দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। কৃষি জমির উর্বরতা হারাচ্ছে। ভবিষ্যতে মাটির যে প্রাণ জৈব সার টপ সয়েলের সাথে চলে যাচ্ছে। এর ফলে জমির সমস্ত পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যা রিকভার হতে ১৫-২০ বছর লেগে যাবে।’

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌহিদুল বারী বাবু জানান, ‘কৃষি নির্ভর এ জেলার কৃষি ধ্বংসের অন্যতম কারণ অবৈধ ইটভাটায় ব্যবহৃত টপ সয়েল। ইটভাটার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল কৃষি জমির টপ সয়েল। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে এখনও টপ সয়েল ব্যবহার করে ইট তৈরি করা হচ্ছে। টপ সয়েল কেটে নেয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে এবং ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে জমিতে অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করতে হচ্ছে। এক পর্যায়ে শুধু সারের উপরই কৃষককে ফসল উৎপাদনের জন্য নির্ভর করতে হবে।’ পঞ্চগড় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবু হানিফ জানান, ‘টপ সয়েল কেটে নেয়া কৃষি ও কৃষকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর দিক। ইটভাটা মালিকরা কৃষি জমি থেকে টপ সয়েল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। উপরিভাগের মাটি বা টপ সয়েল একটি জমির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাটির ছয় ইঞ্চি গভীরতাতেই ফসলের সব ধরনের খাবার থাকে। যে আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে সেসব জমির চাষাবাদ অন্য জমির মতো হবে না। ফসলি জমি থেকে কৃষকরা যাতে মাটি বিক্রি না করে এজন্য আমরা কৃষকদের পরামর্শ দেই।’কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে নেয়ার বিষয়ে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন কোন কথা বলতে চাননি। দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রত্যয় হাসান জানান, ‘শুধু শাস্তি নয় আমরা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করব। কৃষকরাও যাতে কৃষি জমির মাটি ইটভাটায় না দেন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়াসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান