পাটের বিকল্প হতে পারে পিপিওভেন

তোফায়েল কবীর খান:

বিশ্বজুড়ে পিপি ওভেন ব্যাগ একটি বড় সেক্টর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এশিয়ার দেশ চীনে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো, তাদের জিডিপিতে শতকরা ৩.৭ ভাগ ভূমিকা রাখছে পিভি ওভেন খাত থেকে। কিন্তু বাংলাদেশে আগের তুলনায় এ শিল্পের প্রসার ঘটলেও সুযোগ-সুবিধার অভাবে পিছিয়ে আছে। আর এক্ষেত্রে সিমেন্টের পিপি ওভেন ব্যাগ তৈরির কাজ করছে হাতেগোনা মাত্র সাত আটটি প্রতিষ্ঠান।

৬২ ধরনের পিপি ওভেন ব্যাগ উৎপাদনসহ পিপি ওভেন সিমেন্ট ব্যাগ তৈরিতে দেশীয় চাহিদার শতকরা ৫ থেকে ১০% সরবরাহ করেছ খান ব্রাদার্স। আর অন্যান্য সেক্টরে ২ শতাংশ পিভি ওভেনের কাজ হচ্ছে তাদের। সার্বিকভাবে সারাদেশের চাহিদার ৩ থেকে ৪ শতাংশ পূরণ করছে খান ব্রাদার্স।

২০ বছর ধরে বাংলাদেশে পিভি ওভেন ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি পণ্য মোড়কীকরণে একটি আইন করা হয়েছে। ফলে কিছু সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী চাল, গম, ভুট্টা ও ধানসহ প্রায় ১৭টি পণ্যে পিপি ওভেন ব্যাগ ব্যাবহার করা যাবে না। স্থবির হয়ে যাওয়া দেশীয় পাট শিল্প উন্নয়নে, এসব পণ্য মোড়কে পাটের ব্যাগ ব্যবহার ব্যধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্ত পিপি ওভেন আর পাট দুটো আলাদা উপাদান। সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের বিশ্বজুড়ে সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্ত নতুন আইনের কিছু দুর্বলতায় পাট ও পিপি ওভেনকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করানো হয়েছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই পাট পাওয়া যায় না। ভারতের ১৩০ আর ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীনে পুরো প্যাকেজিং সিস্টেমই প্লাস্টিক নির্ভর। আর সে কারণেই এসব দেশে পিপি ওভেন ব্যাগের ব্যাপকতা রয়েছে। তাই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর চাহিদা ও ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের আইন প্রনয়ণে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। আমরা আশা করছি, সরকার তার অবস্থান থেকে সরে এসে,পিভি ওভেন খাতে কিছুটা ছাড় দেবেন।

কিছুদিন আগে চালের মূল্য বৃদ্ধির পেছনের কারণও ছিল পিপি ওভেন ব্যাগ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা। চাল বাজারজাতে স্বল্প সময়ে সঠিক মানের পাটের ব্যাগ পাওয়া যায় না। অল্প বিস্তর যা পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় ৫০ কেজি ওজনের পাটের ব্যগের দাম পড়ে ৬০। আর তার বিপরীতে মাত্র ১২টায় পিভি ওভেন ব্যাগ সহজে এবং সময়মতো পাচ্ছেন, চাল বাজারজাতকারীরা। আর এতে করে স্বাভাবিকভাবেই চালের মূল্য কেজি প্রতি দুই টাকা বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে চালের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে পিভি ওভেন ব্যাগ ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা অন্যতম কারণ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকেও উঠে আসে, চালের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ পাটের ব্যাগের উচ্চ মূল্য ও সময় মতো ব্যাগ সরবরাহ না পাওয়া। আর সে কারণে চালের দাম কমাতে, সরকার আগামী তিন মাসের জন্য, চাল আমদানিতে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।

বাংলাদেশে পিভি ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগের বড় একটা চ্যালেঞ্জ আছে। তবে যেহেতু শ্রমঘন দেশ সে কারণে চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা কাজ করতে চাই। দেশে পিভি ওভেন ব্যাগের আরেকটি ধরণ হলো, এফআইবিসি ব্যাগ। যাকে বাল্ক ব্যাগও বলা হয়। জাম্বো ব্যাগও বলা হয়। যা নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকটা প্রতিষ্ঠান কাজও করছে। এভাবে চললে গার্মেন্টসের পরেই রপ্তানি ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা রয়েছে। আরেক ধরনের ব্যাগ নিয়ে আমরা আশাবাদী হতে পারি, আর এটি হচ্ছে, এফআইবিসি বা ফ্ল্যাক্সিবল ইন্টারমিডিয়েটেড বাল্ক ব্যাগ। ক্যাটাগরি অনুযায়ী এখানে প্রতিটি ব্যাগের ক্যারিং ক্যাপাসিটি হলো, ১৫০০ কেজি, ২০০০ কেজি এমনকি ১০০০ মেট্টিক টন পর্যন্ত। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসব বাল্ক ব্যাগের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে ক্যারিংয়ের সুবিধার জন্য এগুলো বেশ জনপ্রিয়। এই ব্যাগ তৈরিতে শ্রমের একটা ব্যাপকতা রয়েছে। আশা করা যায়, এ ধরনের ব্যাগের একটা ভালে বাজার অচিরেই দেশে ও বিদেশে সৃষ্টি হবে। এমন ব্যাগ রপ্তানির মাধ্যমে ২০১৮-১৯ সালের দিকে প্রচুর রেভিনিউ আসবে।

আমরা জানি,সিমেন্ট বর্তমানে আমাদের দেশের অন্যতম বড় একটি শিল্প খাত, সেখানেই মূলত পিপি ওভেন ব্যাগ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। সারের আমদানি ও রপ্তানি কিংবা অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য প্যাকেজিংয়ে এধরনের ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। পোল্ট্রি সেক্টরেও এমন ব্যাগের বড় চাহিদা রয়েছে। টেক্সটাইল ইয়ার্ন বা সুতার জন্যও পিপি ওভেন ব্যাগের চাহিদা আছে। কারণ সুতায় পাটের ব্যাগ ব্যবহার করলে তার আঁশ সুতার সঙ্গে মিশে যায়। এর ফলে সুতার মান নষ্ট হয়। এরকম সাত আটটা সেক্টর নিয়ে লোকালি কাজ চলছে। সঠিক আদ্রতা ধরে রেখে পণ্য যাতে নষ্ট না হয়, এ কারণেই আসলে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করতে হয়। একসময় সিমেন্টে কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা হতো। কিন্ত পিপি ওভেন ব্যাগ আসার পর সারা বিশে^ এখন এই ব্যাগই ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমান উৎপাদন হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে প্রায় আট থেকে ১০ কোটি সিমেন্ট ব্যাগের চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে। এসবের মধ্যে সিমেন্টের ব্যাগ, পোল্ট্রি প্রোডাক্টের ব্যাগ, স্পিনিং মিলের জন্য ব্যাগ, সার প্যাকেটিং-এর জন্য ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে। শিগগিরই এফআইবিসি ব্যাগের উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে খান ব্রাদ্রার্স। সব ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন শেষ হয়েছে। অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরুও করেছে এবং আরো পাঁচ সাতটা প্রতিষ্ঠান পাইপলাইনে আছে।

এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র একটা বড় বিষয়। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। রপ্তানির ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক অনেক জটিলতা রয়ে গেছে। তাছাড়া অন্যান্য যে বাধা রয়েছে, সেই সব বাধা সমাধনের জন্য সরকারের উদ্যোগী হওয়াটাও জরুরি। না হলে আমরা এগোতে পারব না।

বিপিজিএমইএ’র তালিকায় প্লাস্টিকের যতরকমের পণ্য রয়েছে তার সবই অন্তর্ভূক্ত। এর মধ্যে ছোটখাটো কিছু বিষয়ে নজর দেয়া দরকার। যেমন ধান-চাল, গম, ভূট্টা ইত্যাদি পরিবহনে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার করলে এ শিল্পের প্রসার হবে। তুরষ্ক আমাদের পাটের ওপর নির্ভর করে তাদের কার্পেট ইন্ডাস্ট্রিসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশের পাটের অভাবে সেগুলো বন্ধ হতে চলেছে। বাংলাদেশ সেভাবে পাট জোগান দিতে পারছে না। এ জন্য তাদের এই খাতটাও আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। বাংলাদেশ থেকে পাট দেওয়া বন্ধ করে দিলে তাদের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। একইভাবে এদেশেও পাট উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

১৬ কোটি মানুষের এ দেশে পাটের কতটুকুই বা কনজামসন করা যাবে? ভারতে রপ্তানি করা গেলে হয়তো সেখানকার ১৩০ কোটি মানুষের মার্কেট পাওয়া যাবে। শতকরা এক ভাগ পরিমাণ পাটও তাদের জোগান দিতে পারলে ১৩ কোটি ভোক্তার কাছে পাটের ব্যাগ পৌঁছনো সম্ভব। শুধু ভারত নয়,বিশে^র অন্যান্য দেশেও পাটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ব্যাপক হারে পাট রপ্তানি করতে পারে। এতে করে পাটের স্বর্ণালী দিন আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অপরদিকে, দেশীয় বাজারে প্লাস্টিকের তৈরি ব্যাগের সম্প্রসারণ হলে একসঙ্গে দুটো পণ্যের উন্নয়ন হবে। এতে করে শিল্পের উন্নয়ন হবে, জনগণ উপকৃত হবে, সরকারও বড় অংশের রেমিটেন্স পাবে এ সেক্টর থেকে।

তোফায়েল কবীর খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
খান ব্রার্দাস লিমিটেড