পুঁজিবাজার উন্নয়নে আলাদা এইচআর পলিসি দরকার

শুরুতেই আমি আইপিও নিয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই। যখন আমরা একটা কোম্পানির কাছে যাচ্ছি, তাদেরকে বাজারে আসার জন্য অ্যাপ্রোচ করছি, তখন কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। এই প্রশ্নগুলোই আমি মনে করি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এই প্রশ্নগুলো সাধারণত দুধরণের হয়। যারা একদমই শেয়ারবাজার সম্পর্কে ধারণা রাখে না, তাদের প্রথম প্রশ্নই থাকে বেনিফিটটা কী? সেটাকে বোঝাতে হয়। তো আমরা ট্যাক্স বেনিফিটের কথা বলি। লোন নিয়ে ইন্টারেস্ট দেয়ার মত বিষয় থাকে না, পুঁজি সংগ্রহ করে পুরোটায় কাজে লাগানো যায়, সেগুলো বোঝাতে পারি। তখন তারা বেশ একটা স্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নে যখন জানতে চায় কতদিন সময় লাগবে, তখন আমরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না। বলি যে এক বছরও লাগতে পারে। একটু বেশি সময়ও লাগতে পারে। তখন আবারো যে প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয় তা হলো, এতো দিন কেন লাগবে, আমারতো এখনই লাগবে টাকাটা। আসলে যারা একটু ডায়নামিক ইনভেস্টর, খুব দ্রুত কাজটি করে ফেলতে চান, সেরকম একটা পরিকল্পণা করে হয়তো আমাদের ডেকেছেন। হয়তো এখান থেকে টাকাটা নিয়ে তাদের কাজে লাগাতে সুবিধা হবে। কিন্তু টাইমিংয়ে জাগাতে তখন তারা একটু পিছনে চলে যায়। আমরা যারা ইস্যু ম্যানেজার বা মার্চেন্ট ব্যাংকার আছি, তারা কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না যে এটা কতটা সময় লাগতে পারে। এটা কিন্তু খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবেলা করতে হয়। আর যারা একেবারেই নতুন কোম্পানি না একটু অভিজ্ঞ, তারা বলে সবই তো জানি, কিন্তু এতো সময় লাগলে তো আমার চলবে না। আমারতো একটু দ্রুত লাগবে টাকাটা। শেষ পর্যন্ত তারা ব্যাংকে চলে যায়। এক্ষেত্রে আসলে কিছু করার থাকে না আমাদের।

আরেকটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যে, ফ্যামিলি বিজনেস থেকে অনেকে বের হয়ে আসতে চায় না। আমরা যখন আলাপ করি, কেমন বোর্ড হবে ধারণা দেই, ইনডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর বোর্ডে বসবেন। তখনই তারা মনে করে, বাইরে থেকে কেউ বুঝি চলে আসলো আমাদের বিজনেসে। এই ব্যাপারগুলো স্পষ্ট করে তাদেরকে বোঝাতে আমাদের একটু সময় লেগেই যায়। তারপরও আমরা যে সফল হচ্ছি না তা নয়, তবে বেগ পেতে হয়। ঘুরেফিরে সেই টাইম ফ্রেমের জায়গাটাতে এসে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে হিমসিম খেতে হয়। একদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা তথ্য চেয়ে পাঠায়, সেগুলো আবার কোম্পানির কাছ থেকে সংগ্রহ করে এসইসিকে দিতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। কারণ তারা বলে সবইতো দিচ্ছি, তাহলে এখনো কেন অনুমতি দিচ্ছে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই জন্য সময়ের বিষয়টাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

বেনিফিট নিয়ে কোম্পানিগুলো যে অনেক বেশি আগ্রহী হচ্ছে সেটাও বলা যাবে না। তারা মনে করে এতো বেশি ঝামেলা মোকাবেলা করে যতটুকু বেনিফিট পাওয়া যায় তা বেশ লুক্রেটিভ নয়। বিশেষ করে ট্যাক্স বেনিফিট যথেষ্ট নয়। এজন্য আরো ভিজিবল বেনিফিট দিতে হবে। যেন একবাক্যে তাদেরকে বলা যায় যে, এই বেনিফিটটা আপনারা পাবেন। বিশেষ করে ট্যাক্স বেনিফিট গ্যাপটা যদি আরো বাড়ানো যায়। কারণ একটা কোম্পানির জন্য ট্যাক্স বেনিফিট একটা বড় সুবিধা।

সরকারের পক্ষ থেকে যদি বাধ্যতামূলক করে দেয়া যায় যে, নির্দিষ্ট এতো দিনের মধ্যে কোনো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকভুক্ত হতেই হবে তাহলে ভাল হবে। যেমন বিমা কোম্পানি, ব্যাংক, পাচ বছরের মধ্যে তাকে আসতেই হয়। এনিয়ম শুধু ব্যাংক বিমার মধ্যেই সিমাবদ্ধ থাকবে কেন? অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রে কেন এমন আইন হচ্ছে না।

রেগুলেটরের দিক থেকে বলবো, তারাতো ফ্যাসিলিটেটর, মার্কেটিং তো তাদের কাজ নয়। কিন্তু আমার মনে হয়, আমাদের মার্কেটটা যেহেতু একটা ডেভেলপিং জায়গায় আছে, সেহেতু বিএসইসি, ডিএসই, সিএসইর কিন্তু মার্কেটিংয়ের জাগয়গাটায় আরেকটু ফোকাস করা উচিৎ। যেমন এখন ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি প্রোগ্রামটা হচ্ছে, দশ বছর মেয়াদি একটা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রোগ্রামটাকেই ধরে এখানে শুধুমাত্র বেনিফিট নিয়ে কোনো সেশন করা হয়, যে যেখানে বা যে জেলাতে হচ্ছে সেখানকার ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এই বেনিফিটগুলো যদি ভালো করে বোঝানো যায় তাহলে তাদের মধ্য থেকে আমার মনে হয় অনেকেই এগিয়ে আসবে। চিন্তা ভাবনা করবে শেয়ার বাজারে আসার কথা ভাববে। তো মার্কেটিং জায়গাটা আরেকটু আকর্ষণীয় করা যে, কেন আসবে তারা মার্কেটে।

এই প্রোগ্রামটা যেমন জেলায় জেলায় হচ্ছে, এটা কিন্তু জাতীয় পর্যায়েও করা যায়। আমরা যেমন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিদেশে গিয়ে বড় বড় কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়ে রোড শো করি। ঠিক একইভাবে আমাদের অর্থমন্ত্রনালয়, বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই, মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন, ব্রোকার্স এসোসিয়েশন সবাই মিলে জাতীয় পর্যায়ে যারা বড় বড় কোম্পানি, গ্রুপ অব কোম্পানির প্রতিনিধি বা উদ্যোক্তারা রয়েছেন তাদের নিয়ে রোড শো করে, বেনিফিটগুলো হাইলাইট করা যেতে পারে। তখন কিন্তু দেখবেন তাদের কাছ থেকেও নানা রকম রিকমেন্ডশন আসবে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে, দেশের স্বার্থে কিছু নিয়ম কানুন সংশোধন করে যদি আরো একটু বেশি বেনিফিট দিয়ে তাদের পুঁজিবাজারে আনা যায় তাহলে ভাল হবে বলে আমার মনে হয়। এতে করে অনেক অংশগ্রহণ বাড়বে। আমাদের বাজারটা আরো অনেক বড় হবে। তাই আমাদের মার্কেটিংয়ের বিষয়টা আরো ফোকাস করা উচিৎ।

আমাদের দেশে কিন্তু এখন অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। বড় বড় সেতু হচ্ছে, পদ্মা সেতু হচ্ছে, সড়ক হচ্ছে, মেট্রো রেল হচ্ছে, সার্ভিস সেক্টর হচ্ছে। এগুলো কিন্তু বাজারে আনা যেতে পারে। বন্ড ইস্যু করে করা যেতে পারে। তাহলে কিন্তু ঋণের বোঝা বাড়বে না। উন্নত বিশ্বে তো বন্ডের মাধ্যমে বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে, আমাদের এখানে হবে না কেন।

এসব বিষয়গুলো নিয়ে কিন্তু আমরা যারা বাজার নিয়ে কাজ করছি তারা কিন্তু বলেই যাচ্ছি। কিন্তু এগুলো যদি সত্যি আমলে নিয়ে চেঞ্জ আনা যেতো তাহলে আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটটা অনেক বদলে যেত। সেই সাথে আস্থাও ফিরে আসতো।

আরেকটা বিষয় আমি সংযোজন করতে চাই যেটা বিএসইসির কাছে আমার অনুরোধ, পুজিবাজারে যারা আমরা কাজ করি তাদের ডেভেলপমেন্ট বিশেষ করে এইচ আর ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কোনো রুলস রেগুলেশন নেই। ব্যাংকের জন্য যেমন আছে তাদের এমপ্লয়ের জন্য কি ধরণের বেনিফিট তারা পাবে। কেউ নতুন জয়েন করলে বা কেউ চাকরি ছেড়ে দিলে কি বেনিফিট সে পাবে বা নিয়ে যাবে। আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে এধরণের এইচ আর রিলেটেড কোনো পলিসি নেই। আমরা আসলে যেটা ফেইস করি, ভাল ছেলে মেয়ে আমরা পাচ্ছি না কাজ করার জন্য। তারা সাধারণত দেখা যায় ব্যাংকের দিকেই ঝুকে যাচ্ছে। তারা দেখছে যে এখানেতো কোনো পলিসি নেই। যখন তখন তার চাকরি চলে যেতে পারে বা তাকে স্যাক করছি, নতুনকে নিয়ে নিচ্ছি। তো এই জায়গাটাতে একটু কাজ করলে আমরা অনেক ট্যালেন্টদের পাবো, যারা আমাদের পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্যই কাজ করবে। ব্যাংকের মতো এইচ আর পলিসি করা গেলে এই সেক্টরের অনেক উন্নয়ন হবে।

তানিয়া শারমিন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
সিএপিএম অ্যাডভাইজরি লিমিটেড