পুঁজিবাজার সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে

আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি যে, একটা দেশের পুঁজিবাজার প্রয়োজন হয় তখনি, যখন জনগণের হাতে সঞ্চয়ের টাকা আসে। একটি দেশের পুঁজিবাজার কেন, সেটা আগে আমাদের বুঝতে হবে। এক সময় কমিউনিস্ট দেশে পুঁজিবাজার ছিল না। চায়নাতেও পুঁজিবাজার ছিল না। বলা হতো এটা শুধু মাত্র ক্যাপিটালিস্ট দেশ। আমরা বলি, মুক্ত অর্থনীতির যে দেশ সাধারনত সেগুলোতে পুঁজিবাজার থাকে। আমাদের বুঝতে হবে, জনগনের হাতে যখন টাকা সঞ্চয় হয় এবং থাকে, তখনই ক্যাপিটাল মার্কেটের প্রয়োজন হয়। জনগনের সঞ্চয়কে প্রোডাক্টিভ খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, জনগনের সঞ্চয়ের একটি অংশকে যদি প্রোডাক্টশনের মধ্যে আনা যায়, তাহলে কিন্তু সরকারকে এককভাবে দেশের উন্নয়ন করতে হয় না। কোনো দেশের সরকার সবকিছু করে না। কল কারখানা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রোজেক্ট, বিভিন্ন সার্ভিস সেক্টর, গার্মেন্টস সেক্টর বলেন টেক্সটাইল সেক্টর বলেন বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এই যে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তারা যখন কোম্পানি গঠন করে, তখন তাদের টাকার প্রয়োজন হয়। সেই প্রাথমিক টাকাটা বিশ্বের সব দেশে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে তারা নেয়, নিজেরা কিছু দেয়। কেউ কেউ আবার প্লেসমেন্ট শেয়ার দিয়ে কিছু টাকা সংগ্রহ করে। যখন কোম্পানিটা কয়েক বছর পরে একটা লাভ জনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তখন তারা কোম্পানি টাকে বড় করতে চায়। তখন তার টাকার প্রয়োজন হয়। সেই টাকাটা তখন তারা জনগণ থেকে সংগ্রহ করে এবং জনগণ ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে শেয়ার হোল্ডার হিসাবে, সে কোম্পানিকে আপগ্রেড করতে সহায়তা করে। আমাদের এখানে এখন সঞ্চয়ের হার আটাশ থেকে ত্রিশ পারসেন্ট। জনগনের সঞ্চিত টাকা যদি প্রোডাক্টটিভিটিতে না আনতে পারেন তাহলে দেখা যাবে এই টাকাটা আনপ্রোডাক্টটিভ খাতে থেকে যাবে, হয় ফিক্সড ডিপোজিটে, না হলে জমিজমাতে থাকবে। তাহলে দেখা যাবে জমির দাম বেড়ে যাবে, ফিক্সড ডিপোজিটে থাকলে এটা একটা লায়াবিলিটিজ হয়ে যাবে। দেখা যাবে তাদের যে একটা পারটিসিপেশন, সেটা আর থাকছে না। সে জন্য এই পুঁজিবাজার খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পৃথিবীর সব দেশে বড় বড়, দীর্ঘ মেয়াদী যে প্রোজেক্টগুলো আছে, পনেরো-বিশ বছরের একেকটা প্রোজেক্ট, সেখানে অনেক টাকার প্রয়োজন। সেই টাকাটা ব্যাংক বাবস্থা থেকে সাধারণত কেউ নেয় না। কারণ ব্যাংক ব্যবস্থা হলো স্বল্প মেয়াদী ঋণ। আপনি টাকাটা রাখেন আবার তুলে নেন। ডিপোজিটও স্বল্প মেয়াদী করেন আবার তুলে নেন। একটা ব্যাংক যদি দীর্ঘ মেয়াদী কোন ঋণ দেয়, তাহলে সেটা ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে দাড়ায়। দেখা যাচ্ছে যারা বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দেয়, তারা ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। কারণ আঠারো পারসেন্ট চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দিতে হয় অনেক টাকা। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানে কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। আর পুঁজিবাজারে আসলে জবাবদিহিতা থাকে। কারণ আপানকে একটা ত্রৈ মাসিক রিপোর্ট দিতে হয়। ইন্টারন্যাশ্যানাল অডিট অ্যাকাউন্টস করতে হয়। এখানে ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর থাকে, কর্পোরেট কালচার গড়ে তুলতে হয়, ভালো গভর্ন্যান্স থাকতে হয়। এজন্য পুঁজিবাজারের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

আজকে আমরা যদি দেখতে চাই যে, আমাদের জিডিপি গ্রোথ সেভেন প্লাস বা এইটের কাছাকাছি হবে, তাহলে আমরা যে পুঁজিবাজারের স্বপ্ন দেখি, সেরকম একটা ভালো পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে হবে। ভালো ভালো উদ্যোক্তা এই দেশের বিনিয়োগকারীদের থেকে টাকা নিয়ে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলবে, তারা শিল্পায়ন করবে, পাওয়ার প্রোজেক্ট করবে, টেক্সটাইল প্রোজেক্ট করবে, সার্ভিস সেক্টর গ্যাস প্রোজেক্ট করবে, কমিনিকেশন প্রোজেক্ট করবে, রাস্তা ঘাট বড় বড় ব্রিজ করবে, এয়ারপোর্ট করবে। পৃথিবীর বড় বড় প্রোজেক্টের সাথে আমাদের সম্পৃক্ত করার মতো এই পুঁজিবাজারকে গড়ে তুলতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই বলেন, পুঁজিটা সংগ্রহ করতে হবে জনগণ থেকে। দীর্ঘ মেয়াদী পুঁজি সেটা ব্যাংক থেকে না, পুঁজিবাজার থেকে নিতে হবে। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে পুঁজিবাজারে শুশিক্ষিত বিনিয়োগকারী থাকতে হবে। যারা বিনিয়োগের সময় আবেগের বসবতি বিনিয়োগ করবে না। যারা রিউমার শুনে বাজারে আসবে এবং টাকা বানাবে, এই প্রবণতা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগের জন্য নয়, দীর্ঘ মেয়াদী, ছয় মাস, নয় মাস, এক বছর, দুই বছরের জন্য বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজারে আসতে হবে। কেউ ডেভিডেন্ড এর জন্য বিনিয়োগ করবে। এ ধরণের বিনিয়োগকারী আমাদের এখানে থাকতে হবে। একটা শক্তিশালী রেগুলেটরি বডি থাকতে হবে, যেটা আমাদের বিএসইসি আছে। উনারা অনেক রিফর্মস করেছেন। কিন্তু এই রিফর্মসের সুফলটা আমরা এখনো পাচ্ছি না।

এখন যদি আমাদের মার্কেটের দিকে তাকান, দেখবেন বাজারে যখন শেয়ারের দাম বাড়ে তখন জেড গ্র“পের শেয়ারের দামও বাড়ে। নন পারফরমেনস কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে, ছোট পেইডআপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে। যেগুলো ডিভিডেন্ড দেয় না বছরের পর বছর, সেগুলোর দামও বাড়ে। এগুলো বাজারের জন্য ভালো লক্ষণ না। একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে যে আমাদের উদ্যোক্তা সংকট অনেক বেশি। আমি লক্ষ্য করে দেখছি, কিছু ভালো উদ্যোক্তা বা কোম্পানি ছাড়া বেশিরভাগ উদ্যোক্তা শেয়ার ব্যবসায় যুক্ত হয়ে গেছে। তারা কোম্পানি কিভাবে ভালো করবে এবং কোম্পানিকে লংটার্ম ভালো ভাবে চালিয়ে সেখান থেকে আয় করে বিনিয়োগকারীকে দিবে, শেয়ার হোল্ডারদেরকে দিবে, নিজেরা লাভবান হবে, সেসব দিকে মনোযোগ নাই। তার চেয়ে বেশি কত স্বল্প সময়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে তারা এখান থেকে বেনিফিট নিতে পারে, সেই দিকে তাদের প্রবণতা অনেক বেশি। অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে, কোম্পানি আইপিওতে আসার আগে উদ্যোক্তারা প্লেসমেন্টে শেয়ার দেয় ও নেয়। এরপর কোম্পানিটি আইপিওতে আসে এবং কোম্পানিটি বাজারে এসে বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে। তাহলে প্লেসমেন্টেধারীরাও বড় পরিমান শেয়ার বোনাস হিসেবে পায় এবং বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে বড় একটা মুনাফা তুলে নেয়। আবার এক দুই বছর পর প্লেসমেন্টের শেয়ারটায় যখন লক ইন থাকে না, তখন তারা বিক্রি করে দেয়। এইভাবে আইপিও আসার শুরু থেকেই তারা ইনকাম করা শুরু করে।

অনেক সময় উদ্যোক্তারা তাদের প্রত্যেকের কাছে যে টু পারসেন্ট রাখার কথা, সকল উদ্যোক্তা মিলে মোট ত্রিশ শতাংশ রাখার কথা, তা তারা না রেখে নিজেরাই শেয়ার বিক্রি করে দেয়। এখন কোন্ শেয়ার কখন বিক্রি হচ্ছে, সেটা মনিটরিং করাও কঠিন হয়ে যায়। শেয়ারগুলো এয়ার মার্ক করা থাকে না। কোনো এক জায়গাতে এয়ার মার্ক করে রাখতে হবে, যে এটা হলো উদ্যোক্তা শেয়ার। এটা বিক্রি করার আগে একটা ক্লিয়ারেনস্ লাগবে। আমাদের এখানে উদ্যোক্তারা যখন শেয়ার বিক্রি করতে যায়, তখন তার কাছে থাকা ত্রিশ পারসেন্টের বেশি যা শেয়ার আছে সেটা সে বিক্রি করতে পারে। কিন্তু সে ঘোষণা দিয়েই বিক্রি করা শুরু করে দেয়। আবার অনেকে ঘোষণাও দেয় না। আইন কানুন কিছু মানে না। আমি মনে করি, উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা থাকা উচিৎ। উদ্যোক্তা শেয়ার বিক্রি করার আগে, শেয়ার হোল্ডারদেরকে তা জানাতে হবে। যারা তাকে দেখে বিনিয়োগ করেছে, যারা ম্যানেজমেন্টে নাই তাকে আগে বের হবার সুযোগ দিতে হবে। আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা হিসাবে শেয়ার বিক্রি করে বা আপনি একটা নির্দিষ্ট পরিমান শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন, ঠিক আছে শেয়ার হোল্ডার হিসাবে আমিও বিনিয়োগ করেছি, আমিতো ব্যবস্থাপনাতে নাই। আমি আপনাকে দেখে বিনিয়োগ করেছি। এখন আপনিই বেরিয়ে যাচ্ছেন, তার আগে আমাকে সুযোগ দিতে হবে আমি যেন বেরিয়ে যেতে পারি। এগুলো কিছু নিয়ম কানুনের বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। উদ্যোক্তার ত্রিশ পারসেন্ট শেয়ার থাকতে হবে এবং ইনজেনারেল শেয়ার সে কি পাবলিক মার্কেটে বিক্রি করতে পারবে, না সে ব্লক মার্কেটে বিক্রি করবে। উদ্যোক্তাদের উচিৎ হবে পাবলিক মার্কেটে বিক্রি না করা। সে যদি টোটাল শেয়ার বিক্রি করতে চায়, তাহলে আরেকটা কোম্পানির কাছে টেন্ডার দিতে হবে যে, আমি উদ্যোক্তা আমি এত পারসেন্ট শেয়ারের মালিক আমি কোম্পানি বিক্রি করে দিব। তাকে ব্লকে শেয়ার টা বিক্রি করতে হবে। কোম্পানির মালিকানা হাতবদল হল। তখন বিনিয়োগকারীরা জানলো এবং তারা চিন্তা করবে শেয়ার রাখবে না কি রাখবে না।

আমাদের মার্কেটে আমরা শুধু ট্রেড করি, আমাদের মার্কেটকে ট্রেডিং মার্কেট বলা হয়। এখানে শেয়ার বেচা কিনা করি। এটা শুধুমাত্র ইকুইটি মার্কেট। আরও কিছু অপশন থাকতে হবে, প্রডাক্ট থাকতে হবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য এখানে বন্ড থাকতে হবে, অল্টারনেটিভ মার্কেট থাকতে হবে। ছোট, মিডিয়াম পেইডআপ ক্যাপিটাল মার্কেট করতে হবে। অনেক ধরণের অপশন থাকতে হবে। একজন বিনিয়োগকারী দশ লক্ষ টাকা নিয়া আসবে, তার জন্য অনেক অপশন থাকা উচিৎ। শুধু ইকুইটি দিয়ে তো মার্কেট চলে না অনেক অপশন থাকতে হবে। স্মল পেইডআপ ক্যাপিটাল, এসএমই বোর্ডটা দ্রুত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেখানে ছোট উদ্যোক্তারা কোম্পানি নিয়ে আসবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখানে ট্রেড করতে পারবে না, এলিজেবল যারা তারাই ট্রেড করতে পারবে।

চায়নারা আমাদের সাথে এসেছে, আমাদের শেয়ার তারা কিনেছে, তারা আমদের টেকনিক্যাল অনেক সাপোর্ট দিবে, তাদের অনেক বড় বড় বিনিয়োগকারী আছে। তাদের সারভিলেন্স, ডাটা সংরক্ষণ সিস্টেম সবকিছুতেই নতুনত্ব আছে, আমি মনে করি এগুলো দিয়ে তারা বন্ড মার্কেটে আমাদের সহযোগিতা করতে পারবে। আমরা যদি স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারি, আমরা যদি আইনের পরিপূর্ণ প্রতিপালন করতে পারি, সবার ক্ষেত্রে এক রকম আইন প্রয়োগ করতে পারি এবং আমরা যদি কমপ্লায়েন্স চার্ট সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে পারি, সবকিছুর উপর নজরদারি খুব শক্তিশালী থাকে, তাহলে আমি মনে করি আমরা একটা ভালো পুঁজিবাজারের স্বপ্ন দেখতে পারি। যে স্বপ্ন এ দেশের শিল্প উন্নয়নে, জিডিপি গ্রোথে এবং দেশের উন্নয়নে অনেক ভুমিকা বিনিয়োগকারীরা রাখতে পারবে।

যখন পদ্মা সেতু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন আমি বলেছিলাম যে, এনআরবি বা প্রবাসিরা আমাকে বলেছে, এদেশের মানুষেরাও বলেছে, আমরা পদ্মা সেতুতে ফাইন্যান্স করবো। পদ্মা সেতু কোম্পানি গঠন করে শেয়ার ছাড়–ক, দশ বছরেও আমরা বিক্রি করবো না। আমরা দেশ ও জাতির জন্য কন্ট্রিবিউট করবো। সরকার সব কিছু করবে এবং সরকার সব কিছুর ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে এটা ঠিক না, এটা একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পাওয়ার প্রোজেক্ট, গ্যাস প্রোজেক্ট, কমিনিকেশন প্রোজেক্ট, এয়ারপোর্ট প্রোজেক্ট, লাভ জনক যত প্রোজেক্ট আছে, আমি মনে করি সরকারের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার জনগনের কাছে ছেড়ে দেয়া উচিৎ। কিন্তু আলটিমেটলি যদি এসব কোম্পানির শেয়ার জনগনের হাতে থাকে তাহলে জবাবদিহিতা থাকে, পারফর্মেন্স অনেক ভালো থাকে। সরকার তো ব্যবসা করবে না, সরকার শুধু ইনফ্রাচট্রাকচার তৈরি করে দিবে, সরকার কমিনিকেশন লাইন তৈরি করে দিবে, বিদ্যুৎ দিবে, শুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দিবে, রোড ঘাট করবে। বাকিগুলো জনগণ করবে।

আমরা মনে করি, মাননীয় অর্থমন্ত্রী অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, পরিকল্পণা মন্ত্রী ছিলেন, এক সময় অর্থ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, উনার আমলে ডিমিউচুয়ালাইজেশন হয়েছে। উনি আমাদেরকে অনেক সহযোগিতা করেছেন, উনি এই বিষয় অনেক ভালো বুঝেন। বিএসইসি আছে উনারা অনেক রিফর্মস করেছেন। সবাই মিলে যদি আমরা একসাথে কাজ করি তাহলে একটা ভালো ও সুন্দর পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে পারবো।

স্ট্যাবল কোম্পানি অনেক কম আসে আমাদের বাজারে। বড় বড় কোম্পানি, স্কয়ারের মতো, একমি লেব্রেটোরিজের মতো ভালো ভালো কোম্পানি, টেক্সটাইল খাতে, সার্ভিস সেক্টরের ভালো ভালো কোম্পানি বাজারে আসতে চায় না। কারণ তারা অতি সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়ে যায়। ব্যাংক থেকে দীর্ঘ মেয়াদের ঋণ বন্ধ করতে হবে। কেউ যখন এক্সপানশনে যাবে, তাকে বাধ্য করতে হবে পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করতে। ব্যাংক থেকে যারা কোটি কোটি টাকা লোণ নিয়ে প্রাইভেট কোম্পানি এক্সপানশন করছে। তাদের যদি পুঁজিবাজারে আনা যায়, তাহলে ব্যাংকের উপর চাপ কমে যাবে। ব্যাংক ইন্টারেস্ট রেটটাও কমে যাবে এবং সরকারের জন্য অনেক প্লাস পয়েন্ট হবে। সরকারি শেয়ার দীর্ঘ দিন সরকারে হাতে থাকা উচিৎ না। কোন এক সময় দেখা যাবে এটা অলাভ জনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। কারণ এটাতে জবাবদিহিতা অনেক কম।

পৃথিবীর সব দেশে কিন্তু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো, এমনকি ভারতেও তাদেরকে পুঁজিবাজারে লিস্টেড হতে হয়। অথচ আমদের এখানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ব্যাবসা করছে, কিন্তু এক্সপানশন করতে গিয়ে আমাদের এখানে লিস্টেড হচ্ছে না, শেয়ার দিচ্ছে না, পাবলিকে আসছে না। আমি বিনীত অনুরোধ করবো, তারা যখন এক্সপানশন করতে যাবে, তখন কিছু শেয়ার পাবলিককে দিতে হবে। তাদেরকে লিস্টেড হতে হবে। অবশ্যই লিস্টিংয়ের জন্য তাদেরকে আকর্ষনীয় প্যাকেজ দিতে হবে। একটা সিমেন্ট কোম্পানি লিস্টেড আছে, আরেকটা নন লিস্টেড। দুটোর একই উৎপাদন ক্ষমতা, লিস্টেড কোম্পানি কতো ট্যাক্স দেয় আর নন লিস্টেড কতো ট্যাক্স দেয়, আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন। লিস্টেড কোম্পানির ট্যাক্স কিছু হের ফের করা যাবে না। কারণ তার একটা কর্পোরেট কালচার আছে। অনেক কিছু তাকে ফিল-আপ করতে হয়, তাকে জবাবদিহি করতে হয়, তাকে ডিভিডেন্ড দিতে হয়। এই সব কিছু প্রতিপালন করে তাকে ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। অপর দিকে প্রাইভেট যে সিমেন্ট কোম্পানি আছে, ওটা দেখেন কত ট্যাক্স দেয়। এটা আমাদের একটা ভুল ধারণা, এখানে আসলে ট্যাক্স কমে যাবে। আমার মনে হয়, ব্যাংক ব্যাবস্থা থেকে যদি দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোকে যদি পুঁজিবাজারের দিকে ধাবিত করা যায়, তাহলে একটা ভালো পুঁজিবাজার গড়ে উঠবে।

এখানে শিক্ষিত বিনিয়োগকারী লাগবে। আপনি অবাক হবেন, অনেক বিনিয়োগকারী এসে জেড গ্র“পের শেয়ার, জাঙ্ক শেয়ারে বিনিয়োগ করে। যারা আজকে এসে কালকেই টাকা বানাতে চায়, এ ধরণের প্রবণতা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ ধরণের বিনিয়োগকারী হলে চলবে না। জেড গ্র“পের শেয়ার, জাঙ্ক শেয়ারেরও দাম বাড়ছে, আবার ভালো কোম্পানিরও দাম বাড়ছে। তখন আমি শংকিত হই। ভালটাকে আমি উৎসাহিত করবো, খারাপটাকে উৎসাহিত করতে পারি না। বিনিয়োগকারীদের আবেগ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগ বলতে বিনিয়োগই করতে হবে।

পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় সহায়তা দেয় সেন্ট্রাল ব্যাংক। সেন্ট্রাল ব্যাংক মানি মার্কেটকে সাপোর্ট দেয়, ক্যাপিটাল মার্কেটকেও দিতে হবে, নেগেটিভে হলে হবে না। এমন কিছু আইন প্রনয়ন করা যাবে না যেমন মার্চেন্ট ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল কোম্পানিদের শেয়ার ধরে রাখার কথা, তাদেরকে যদি শুধু কিনবে বিক্রি করবে এই ধরণের প্রবণতায় আইনের মাধ্যমে ফেলে দেয়, তাহলে আর যাই হোক একটি ভালো পুঁজিবাজার হবে না। তাহলে দেখা যাবে এক মাস ভালো আছে পরের মাস খারাপ, এটা পুঁজিবাজার না। পৃথিবীর সব দেশে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালি করার জন্য মিউচুয়াল ফাণ্ড অনেক ভুমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের এখানে আইসিবি’র কয়েকটা মিউচুয়াল ফাণ্ড ছাড়া প্রাইভেট মিউচুয়াল ফাণ্ড নিয়ে নানা বক্তব্য আছে। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, ওপেন এন্ড বলেন আর ক্লোজ এন্ড বলেন, যারা সৎ, যারা ডেডিকেটেড, যারা প্রফেশনাল, যারা অন্যের ফাণ্ডের মাধ্যমে বাজারকে পরিচালনা করছে, তারা যদি সততার সাথে, দক্ষতার সাথে এই বাজারে তাদের ফান্ডকে পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে বাজার আরও খারাপ হবে, ওই খানে সবাই টাকা হারাবে। মিউচুয়াল ফাণ্ডে কর্পোরেট কালচার গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীর সব দেশে, বেশিরভাগ ব্যাক্তি নিজে ব্যাবসা করে না, টাকাটা মিউচুয়াল ফাণ্ডে দিয়ে দেয়। যারা তাদের ওখানে এক্সপার্ট আছে, যাদের করপোরেট কালচার আছে, যাদের গুড গভার্নেন্স আছে, তারা সততার মাধ্যমে ফান্ডটা পরিচালনা করে। আমাদেরও মিউচুয়াল ফান্ডের সেক্টরে তেমন করপোরেট কালচার, সুশাসন, সততা, দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে। মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড মার্কেট, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, আইপিও আনে যেসব মার্চেন্ট ব্যাংক, স্টক ব্রোকার , স্টক ডিলার, অ্যাসেট ম্যানেজার, উদ্যোক্তা এবং সকল শ্রেনির বিনিয়োগকারী, সকলকে নিয়ম ও আইন অনুযায়ী একটা ভালো ভূমিকা পালন করতে হবে। যে আইন বা নিয়মের বাইরে কিছু করবে, সে যেই হোক তাকে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে। তাহলেই একটি পরিপূর্ণ সঠিক বাজার গড়ে উঠবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।

মো. রকিবুর রহমান
চেয়ারম্যান, মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেড
পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড