প্যানক্রিয়াটিক ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানুন

ডায়াবেটিস রোগীর একটি অংশ সরাসারি প্যানক্রিয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণেই রোগটিতে ভোগেন। অর্থাৎ প্যানক্রিয়াসের বিটাকোষ, যা ইনসুলিন তৈরি করে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে ইনসুলিন উৎপাদন কমে যায় এবং ডায়াবেটিস হয়। এটিকে অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হারে এ রোগের উপস্থিতি দেখা যায়। তবে উন্নত দেশগুলোতে এ রোগ নাই বল্লেই চলে। আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশসমূহে প্রধানত: বিষুবীয় এলাকা বিশেষ করে এ রোগের আধিক্য দেখা যায়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ যেমন- ত্রিপুরা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, তামিলনাড়ু, বিহার, মাদরাজ; বাংলাদেশের কিছু এলাকা এবং শ্রীলংকা, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায় এ রোগের যথেষ্ট বিস্তার আছে। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে জিম্বাবুইয়ে, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় এফসিপিডি-র রোগী আছে।

এ রোগটি সাধারণত: বয়ো:সন্ধিকাল বা কৈশরে শুরু হয়। ক্রনিক প্যানক্রিটাইটিসের লক্ষণ হিসেবেই এটি শুরু হয়। ক্রনিক প্যানক্রিটাইটিসের অন্যতম কারণ হলো- অতিরিক্ত মদ্যপান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রোগটির কারণ শিশু বয়সে আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব। যা শরীরের অন্য অনেক অঙ্গের গাঠনিক অস্বাভাবিকতা তৈরি করার সাথে সাথে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়েরও স্থায়ী কাঠামোগত দূর্বলতা তৈরি করে। ফলে অগ্ন্যাশয় হতে নি:স্মৃত আমিষ খাদ্যের পাচক রসটি (এনজাইম) আক্রান্ত ব্যক্তির অগ্ন্যাশয়ের আমিষ উপাদানকেই হজম করতে থাকে। এ অংশটার সাথে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষের সহাবস্থান। ফলশ্রুতিতে বিটা কোষের পরিমাণ কমতে থাকে – ইনসুলিন উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে এবং ডায়াবেটিস হবার পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেহেতু পৃথিবী ব্যাপী মানুষের পুষ্টির উন্নতি হয়েছে, এ রোগটির প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে।

এ রোগটি অনেক ক্ষেত্রে জীনগত হতে পারে। কাছাভা খাওয়ার সাথে প্যানক্রিয়াটিক ডায়াবেটিসের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তবে বাড়ন্ত বয়সে মাত্রাতিরিক্ত কম পরিমাণে আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণই এর প্রধানতম পরিবেশগত কারণ।

রোগটি প্রথমত: বয়ো:সন্ধিকালের কাছাকাছি সময়ে পেটের উপরের দিকে ডানপাশে অল্প-বিস্তর ব্যথা হিসেবে দেখা দিতে পারে; যা প্রথমদিকে গুরুত্বহীনভাবে দেখা হয়। কিন্তু ক্রমশ: এর তীব্রতা বাড়তে থাকে এবং ঘন ঘন দেখা দিতে থাকে। প্রথমদিকে যেকোন ব্যথানাশক ওষুধেই এ ব্যথা দূর হলেও পরের দিকে ব্যথা দূর করা অনেক কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী যে কেউই এতে আক্রান্ত হতে পারে। এফসিপিডিতে আক্রান্ত রোগীদের চেহারা ছবিতে তীব্র অপুষ্টির ছাপ থাকে। অর্থাৎ এরা সবাই ক্ষীণকায়া ও অস্বাস্থ্যকর ত্বকের অধীকারি। রোগটি শুরুর দিকে সামান্য গ্লুকোজ অসহিষ্ণুতা (প্রিডায়াবেটিস) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। রোগীর বয়স তৃতীয় দশকে পড়লে এদের অধীকাংশই পুরোপুরি ডায়াবেটিস রোগীতে পরিণত হয়।

অন্যান্য ডায়াবেটিস রোগীর তুলনায় প্যানক্রিয়াটিক ডায়াবেটিস রোগীদের কিছু স্বাতন্ত্র থাকেঃ
১। এটি প্রধানত শৈশব-কৈশরে প্রতিষ্ঠিত হয়।
২। অনেক রোগীই শুধুমাত্র মুখে খাবার ওষুধ সেবন করেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন।
৩। এদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস হবার সম্ভাবনা নাই বল্লেই চলে।
৪। এরা অনেক দীর্ঘায়ু পাবার সম্ভাবনা নেই।

রোগটি শনাক্তকরণের জন্য রক্তের গ্লুকোজের অতিরিক্ত উপস্থিতি যেমন প্রমাণ করতে হবে; তেমনই অগ্ন্যাশয়ের পাথরের উপস্থিতি অথবা অগ্ন্যাশয়ের প্রধান নালিটি স্ফিত হবার প্রমাণ থাকতে হবে। এ জন্যে পেটের এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম এবং সিটিস্ক্যান সহায়ক পরীক্ষা পদ্ধতি হতে পারে।

এ রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ কাঙ্খিত মাত্রাই রাখতে মুখে খাবার ওষুধসমূহ বেশ কার্যকরি। তবে অনেকেরই ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়। একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (হরমোন বিশেষজ্ঞ)- এর পরামর্শ রোগীর জন্য সহায়ক হবে। যেহেতু রোগীর অগ্ন্যাশয়ে এনজাইম তৈরি করার অংশটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রোগীর সামগ্রীক পুষ্টিহীনতার প্রকট সম্ভাবনা থাকে। যা রোগীকে আজীবন ভোগ করতে হবে।

ডায়াবেটিসের রোগীর দীর্ঘস্থায়ী সকল জটিলতাই এদের ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে ডায়াবেটিক কিডনি ডিজিজ, স্নায়ু রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ইত্যাদি। কিছু কিছু রোগীর অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
ফোন: ০১৯১৯০০০০২২