ফেনীর প্রান্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’

ফেনীতে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম বিশেষ উদ্যোগ ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ফেনীর প্রান্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে। প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারির অতিরিক্ত দায়িত্বে নাজমুন নাহার জানান, এতে সদস্য রয়েছেন ৪৮ হাজার ৫৪৯ জন।

তন্মধ্যে ব্যাংকে ৫৫৪ টি সমিতির মাধ্যমে যুক্ত রয়েছেন ২৮ হাজার ৭৫৬ জন এবং প্রকল্পে ৫১৬ টি সমিতিতে রয়েছেন ১৯ হাজার ৭৯৩ জন।

নাজমুন নাহার জানান, ৪০ জন নারী ও ২০ জন পুরুষ নিয়ে প্রতি সমিতি গঠনের কথা থাকলেও সকল সমিতিতে ৬০ জন নেই এবং উদ্যোগীর অভাবে নারী পুরুষের অনুপাত একাধিক সমিতিতে নির্দেশনা অনুযায়ী অনুপস্থিত। সাধারণত ৫০ শতকের কম ভূমি রয়েছে এমন ব্যক্তি এ প্রকল্পের সদস্য হতে পারবেন।

প্রকল্প ও ব্যাংক প্রসঙ্গে নাজমুন নাহার জানান, ২০০৯ সালে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ নামে প্রকল্প শুরু হয়। ২০১৪ সালে প্রকল্পের পরিধি বিস্তৃতি ও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও তা ২০১৬ সালে মাঠ পর্যায়ে চালু হয়।

প্রকল্প ও ব্যাংকের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি জানান, মূল লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ণ। লক্ষ্য অর্জনে গ্রহণ করা হয়েছে সহজ ঋণদান ব্যবস্থা। যেখানে সদস্য ও সরকারের সমান অংশিদারিত্বের পাশাপাশি যোগ হয়েছে প্রতি সমিতিতে সরকারের আবর্তক ঋণ। এর মাধ্যমে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়েছে কৃষিসহ একাধিক পেশায়।

ফেনী সদর উপজেলা সমন্বয়কারী রিপন দেবনাথ জানান, মোট ৪৩টি খাতে সদস্যদের ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। তবে ছয়টি খাত বিবেচনায় তথ্য বিবরণী লিপিবদ্ধ হচ্ছে। খাতগুলো হল গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ, শাক-সবজি চাষ, নার্সারি এবং অন্যান্য।

নাজমুন নাহার জানান, উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ব্যাংকের আওতায় সদস্যদের মাঝে এ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৮৮ কোটি ৬১ লাখ ৯১ হাজার টাকা। প্রকল্পের আওতায় দেয়া হয়েছে ১৬ কোটি ৪৮ লাখ ৬ হাজার টাকা। এছাড়াও ৫৯৪ জন সদস্যের মাঝে এসএমই ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৩ কোটি ১৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

ঋণের পরিমাণ প্রসঙ্গে জেলা সমন্বয়কারী জানান, এসএমইতে ৫ শতাংশ এবং প্রকল্পে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এসএমইতে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদানের সুযোগ রয়েছে যা গ্রহীতা ১২ মাসে শোধ করবেন। গ্র্যাজুয়েট সদস্যরা বিশেষ এ সুবিধা ভোগ করতে পারেন। যেসব সদস্য তিনবার ঋণ নিয়ে যথাসময়ে পরিশোধ করে তাদের গ্র্যাজুয়েট সদস্য বলা হয়। তিনি জানান প্রকল্পের সদস্যদের ১০ হাজার টাকা হতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ধাপে-ধাপে ঋণ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

ফেনী জেলা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সম্পদ প্রসঙ্গে তিনি জানান, বর্তমানে মোট সম্পদ রয়েছে ৫১ কোটি ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩ টাকা। এর মধ্যে সদস্যদের সঞ্চয় ১৩ কোটি ৭০ লাখ ২৫ হাজার ১১৫ টাকা, সদস্যদের জন্য সরকারের উৎসাহ বোনাস ১০ কোটি ৫৭ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ টাকা, সরকারের উন্নয়ন বা আবর্তক তহবিল ১৬ কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার ৯৩০ টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন সুদ ও অনুদান এতে যুক্ত হয়েছে।

আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও ব্যাংকের মাধ্যমে সদস্যদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে রিপন দেবনাথ বলেন, এর মাধ্যমে পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে, তাদের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। নিয়মিত ঋণের কিস্তি শোধের হারও সন্তোষজনক।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের জেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, ব্যাংকের আওতায় ঋণ গ্রহীতাদের নিয়মিত কিস্তি শোধের হার শতকরা ৮১ শতাংশ এবং প্রকল্পে ৭০ শতাংশ।

একই সূত্র জানায়, জেলার ছয় উপজেলায় নিয়মিত কিস্তি আদায়ের গড় হার সদরে ৭৩ শতাংশ, ছাগলনাইয়ায় ৮১ শতাংশ, সোনাগাজী ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ, পরশুরাম ৮৭ শতাংশ, দাগনভূঞা ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ফুলগাজীতে ৮৩ শতাংশ।

দক্ষ জনশক্তি গড়তে প্রকল্পের বিশেষ কৌশল প্রসঙ্গে নাজমুন নাহার বলেন, আমার বাড়ি আমার খামার একজন সদস্যকে তার ইচ্ছার প্রাধাণ্য দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরী করে। ঋণদানের পূর্বে তাকে সংশ্লিষ্ট কাজে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ঋণ দেয়ার পর তার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়। নিয়মিত উঠান বৈঠক করে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করা হয়, উদ্ভুত সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করা হয়।সদস্যদের দুর্বলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সকল সদস্যের কর্মস্পৃহা একরকম নয়। তাই কেউ-কেউ ছিটকে পড়ছে অথবা ব্যর্থ হচ্ছে।

সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নে ধর্মপুর আমার বাড়ি আমার খামার সমিতি-৯ এর একজন সফল উদ্যোক্তা রুপিয়া আক্তার। বর্তমানে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এ টাকায় ছাগল ও সবজি চাষ করেছেন। তিন মাস আগে ৯৫ হাজার টাকা ছাগল বেচে পেয়েছেন। সবজি বাজারে অল্প পরিমাণে বিক্রির জন্য নিয়মিত পাঠান এবং নিজেদের চাহিদা মেটান। তিনি বলেন, খুব বেশী আয় করি না তবে পরিবারের খরচ যোগানে অংশগ্রহণ করতে পারি।

বরইয়া আমার বাড়ি আমার খামার সমিতি-৭ এর সদস্য আনোয়ারা বেগম চতুর্থ দফায় ৭০ হাজার টাকা ব্যাংক হতে ঋণ পেয়েছেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি টেইলারিং ব্যবসা করছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানে আরও তিনজনকে চাকরি দিয়েছেন। তবে করোনার আঘাতে নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখছেন। অবশিষ্ট ৬ কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ এবং পারিবারিক ব্যয় বহনে অনিশ্চয়তায় ভূগছেন।

ঋণের কিস্তি আদায়ের হার দিয়ে প্রকল্প ও ব্যাংকের সফলতা দেখতে রাজি নন ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজামান। তিনি বলেন, কতগুলো পরিবার তাদের আর্থিক উন্নতি করেছে ও উৎপাদনে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছে তার ওপর নির্ভর করবে সফলতা।

তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ মজবুত অর্থনীতির ভীত গড়ে তুলতে বাড়ি-বাড়ি খামার সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেছেন। এর আলোকে ফেনীর সর্বত্র উদ্যোক্তা সৃষ্টির কাজ চলছে। একটি নির্দিষ্ট ছকের মাধ্যমে সক্ষমতার বিচারে সদস্যদের প্রশিক্ষণ শেষে কাজে নামানো হচ্ছে। সদস্যদের নিয়মিত উঠান বৈঠকের মাধ্যমে প্রেষণা দেয়া হচ্ছে। উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

প্রকল্প ও ব্যাংকের জেলা অফিস সূত্র জানায়, ফেনীর ছয় উপজেলার ৩৭ হাজার ৭২০ পরিবার আমার বাড়ি আমার খামারের সাথে সরাসরি যুক্ত থেকে উপকার ভোগ করছে।

জেলা কার্যালয় সূত্র প্রদত্ত তথ্য মতে অনাদায়ী ঋণের হার ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। ব্যর্থ উদ্যোগ প্রসঙ্গে জেলা সমন্বয়কারী নাজমুন নাহার ও সদর উপজেলা সমন্বয়কারী রিপন দেবনাথ জানান, প্রত্যেক ঋণ গ্রহীতাকে তার পারদর্শিতা ও ইচ্ছার ভিত্তিতে কর্মের খাত নির্বাচন করে দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় ঋণ দেয়ার পর যারা পরিকল্পনা অনুযায়ী লগ্নি করছে না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেউ-কেউ ঋণের টাকা পরিবারের অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করেছে। কিছু সদস্য সচেতনভাবে ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে। অনেকে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে, কিস্তির জন্য অতিমাত্রায় চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।

সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নে মধুয়াই সমিতির সভাপতি শংকর রঞ্জন শর্মা উপজেলায় পরপর দু’বার শ্রেষ্ঠ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সাবলম্বী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফেনীতে বাজার চাহিদা বড় তাই যেকোনো উৎপাদন ও কর্মকান্ডে সফলতা সহজ।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরীন সুলতানা জানান, উদ্যোগের আওতায় সফলতা স্পষ্ট লক্ষনীয়। গ্রামীণ সমাজের প্রত্যেকটি সদস্যের বাড়ি এখন খামারে পরিণত হয়েছে। উপার্জনের পাশাপাশি পরিবারের চাহিদা মিটছে ফলে খরচ কমছে। তবে ফেনীতে প্রচুর জমি এখনো অনাবাদি পড়ে থাকে।

তিনি বলেন, প্রকল্প ও ব্যাংকের আওতায় সদস্যদের আর্থিক সক্ষমতা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফেনী বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ একটি জেলা। এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে আমার বাড়ি আমার খামার। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান