বন্যা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা

দেশের একটি বিশাল অঞ্চল বন্যাকবলিত থাকায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ৮ থেকে ১০টি জেলায় বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি অনেক বেশি। এরইমধ্যে অনেক এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে ভেঙ্গে পড়েছে অবকাঠামো, তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাড়িঘর, মাছের খামার, আবাদি জমির ফসল। কৃষিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, দেশের ৩১ উপজেলায় ৬ লাখ ২৩ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ লাখ ৪৯ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদন হয়েছে। এরজন্য সরকারি উদ্যোগে প্রণোদনা দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন মন্ত্রী। এসব বানভাসির পুনর্বাসন করবে সরকার।

কৃষকদের পুনর্বাসন করতে সরকার ১১৭ কোটি টাকার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে বলেও জানান তিনি। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, সামপ্রতিক বন্যায় অনেক কৃষিক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য সরবরাহ সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এবং বাংলাদেশ পড়তে পারে খাদ্যঝুঁকির মুখে। বন্যার কারণে কয়েক লাখ পুকুর ও মৎস্য চাষের খামার প্লাবিত হয়েছে। অসংখ্য গবাদিপশু ভেসে গেছে এবং মরে গেছে। ফলত বন্যাকবলিত মানুষদের অর্থব্যবস্থা তথা আয়ের সকল উপকরণ ও উপায় বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বন্যার্তদেরকে জীবন চালনার জন্য খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদের চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে বিনামূল্যে কৃষি বীজ ও চারা প্রদানকরত সার ও কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। বন্যার্তদেরকে প্রয়োজনে বিনাসুদে বা পরিবারগুলোর ক্ষতির পরিমাণ ভেদে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া যেতে পারে যাতে করে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে। ইতোমধ্যে সরকার এ ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুরু করেছে। এক্ষেত্রে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে যেন দুর্গতদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ বা অন্য যে কোনো উপকরণ বেহাত না হয়। পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও বা দাতা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ এই পুনর্বাসনকে আর ত্বরান্বিত করতে পারে।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা জানিয়েছেন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তিনি বলেছেন, সারা দেশে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের হিসাব নিরীক্ষায় কয়েকটি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বিশেষ করে কৃষি, সড়ক পরিবহন ও সেতু, রেল, এলজিআরডি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। এসব মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদাভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করবে। এরপর সম্মিলিতভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করবে সরকার। এসব কার্যক্রমের সমন্বয় করবে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পরিসংখ্যান ও আর্থিক ক্ষতির পরিমাপ সংগ্রহ করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।
আগামী ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা, কী পরিমাণ সহায়তা লাগবে তার ‘ইস্টিমেট’ তৈরির কাজ শেষ হবে। তার পরেই শুরু হবে আনুষ্ঠানিকভাবে পুনর্বাসনের কাজ।

জানা গেছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পুনর্বাসনে জন্য ৯০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ জন্য ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক ও কৃষি বাস্তবায়ন পুনর্বাসন কমিটির সভাপতির নামে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বরাদ্দপত্র থেকে জানা গেছে, কলার ভেলায় ভাসমান বীজতলা তৈরিতে ৭ লাখ ৫৮ হাজার ১৬০ টাকা, নাবী জাতের রোপা আমন ধানের বীজ বিতরণে ৩ লাখ ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং নাবী জাতের রোপা আমন ধানের বীজতলা তৈরি, চারা উত্তোলন ও বিতরণে ৮০ লাখ ২৬ হাজার ২০০ টাকা লাগবে। আর মৎস্য অধিদপ্তর ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের সহায়তার জন্য ৪৫৯ কোটি টাকার সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে।

কৃষকদের ক্ষতির বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও উপকরণ) মো. সিরাজুল হায়দার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত একজন কৃষক এক বিঘা আমন ধানের জমিতে রোপণের জন্য শুধু ধানের চারা বিনামূল্যে পাবেন। আমন ধানের বীজ বিতরণের ক্ষেত্রে একজন কৃষক এক বিঘা জমির জন্য ৫ কেজি ধানের বীজ বিনামূল্যে পাবেন। পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় প্রত্যেকটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে তিন বান্ডিল টিন এবং ৫ হাজার টাকা দেবে।

সত্যব্রত সাহা বলেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মাছ ও গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তৈরি করবে। এরপর এসব খাতে পুনর্বাসনের প্যাকেজ ঘোষণা করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বন্যা-পরবর্তী বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে মেডিকেল টিম গঠন করেছে। তারা ইতোমধ্যে কাজ করছে বন্যাকবলিত এলাকায়।

তিনি আরো বলেন, দেশে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ আগামী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে শুরু হবে। বন্যায় সারা দেশে কী পরিমাণ রেল, কৃষি, মৎস্য ও সড়কের ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়ে প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এবারের বন্যায় বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি মোকাবিলায় আমরা পরিকল্পনা করে এগুচ্ছি। আমাদের মন্ত্রণালয় ছুটির দিনসহ ২৪ ঘণ্টা বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের কাজ করা হচ্ছে।

ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের পানি নেমে যাচ্ছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ৩৩টি জেলায় ১৭ লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেবে।

তিনি বলেন, এছাড়া রাস্তাঘাট মেরামতের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানের জন্য কাজ করছে। পাশাপাশি রেলপথ মন্ত্রণালয় সারা দেশে কত কিলোমিটির রেললাইনের ক্ষতিসাধিত হয়েছে। তার পরিসংখ্যান শিগগিরই জানানো হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এছাড়াও ভয়াবহ এই বন্যায় সড়ক ও রেল অবকাঠামো যেভাবে ধ্বংস হয়েছে সেটা সংস্কারও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষ। বন্যা দুর্গত এলাকার অনেক জেলায় রেল লাইন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সড়কপথ ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। অনেক এলাকার রাস্তা-ঘাট এখনো তলিয়ে আছে।

তবে এমন পরিস্থিতিতেও আশার কথা শোনালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, গত রোজার ঈদের আগেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আমরা একটা বার্তা পেয়েছিলাম- সেখানে বলা হয়েছিল এবার বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বহু এলাকা প্লাবিত হতে পারে। তখন থেকেই আমরা প্রস্তুতি শুরু করি। জেলা হাসপাতালের বাইরেও উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমরা ওষুধের মজুদ রেখেছি। সেগুলো যেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যবস্থাও আছে আমাদের। আমাদের যে মজুদ আছে তা দিয়ে দুই সপ্তাহ চলে যাবে। আশা করছি, এবার বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে রোগ বালাই মুক্ত থাকতে পারব আমরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার বন্যায় রেল ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রেললাইনের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একাধিক জায়গায় রেললাইন এক থেকে পাঁচ ফুট পানির নিচে রয়েছে। ফলে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। রেল মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছে, রেললাইন থেকে পানি অপসারিত হলে এবং লাইন সংস্কার শেষে এই রুটে ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা করা হবে। এদিকে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর। শুক্রবার দুপুরে তলিয়ে গেছে স্থলবন্দরের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন অফিস এবং ব্যবসায়ীদের অফিস। এ কারণে বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ও যাত্রী পারাপার ব্যহত হচ্ছে।

দিনাজপুর সদর উপজেলার ইউএনও আব্দুর রহমান জানান, শুধু সদরেরই ২৬টি সড়কের ভেঙ্গে যাওয়ার খবর পেয়েছি। তবে এটা আরও বেশি হতে পারে। সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, সাধারণ মানুষকেও সহযোগিতা করতে হবে।

পার্বতীপুর রেলস্টেশন মাস্টার শোভন রায় জানান, বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন সংস্কার ও মেরামত কাজ শেষে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু করা যাবে। তবে কবে নাগাদ শুরু হবে বলতে পারেননি তিনি। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা সদর ইউনিয়নের প্রধান সড়কের এমপি ডাঙ্গী গ্রাম ও সুপারিবাগান গ্রাম পয়েন্টের রাস্তার সঙ্গে পদ্মা নদী একাকার হয়ে গেছে। যে কোনো সময় রাস্তাটি ধসে পড়ে জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

বাংলাদেশ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ বলেন, বন্যা পরবর্তীতে সরকার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে মধ্যে পড়বে। যেখানে অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে তার জন্য কোন ফান্ড বরাদ্দ নেই। উন্নয়ন খাত থেকে টাকা এনে এখানে দিতে হবে। এগুলো করতেও সময় লাগবে। পাশাপাশি উন্নয়নে কর্মকা-েও বিরূপ প্রভাব পড়বে। তবে এসব কিছুর আগে আমাদের বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, সাধারণ মানুষকেও তাদের সহযোগিতা করতে হবে। আর ১৯৯৮ সালের পর আমাদের সড়ক অবকাঠামো এভাবে ধ্বংস হয়নি। তাই বন্যার সময় যেমন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাহায্যে এগিয়ে আসে তেমনি বন্যা-পরবর্তীতেও দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

আজকের বাজার: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭