বাংলাদেশের চা শিল্প ও এর সম্ভাবনা

 শুরুর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বাংলাদেশে চা শিল্পের বয়স ১৭৮ বছর। এ সু-দীর্ঘ সময়ে দেশের মানচিত্র বদলেছে দুইবার। তার মাঝেও এ শিল্পের অগ্রযাত্রা থামেনি। অমিত সম্ভাবনার অনুপাতে এই শিল্পের অর্জনও কিন্ত কম নয়। আমাদের দেশে সর্ব প্রথম চা বাগান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ১৮২৮ সালে। অবিভক্ত ভারতের চট্টগ্রামে কোদালায় জমি নেয়া হয় চা বাগান স্থাপনের। বর্তমানে যেখানে চট্টগ্রাম ক্লাব, ১৮৪০ সালে সেখানেই পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করা হয় প্রথম চা গাছ।

১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনিছড়া চা বাগানের মাধ্যমে চা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয়। তখন থেকে ধীরে ধীরে চা এ দেশে একটি কৃষি ভিত্তিক শ্রমঘণ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টিতে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন শুরু করে।

বাংলাদেশে চা-শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এ শিল্পকে সঠিকভাবে তদারকি করতে পারলে দেশের জাতীয় অর্থনীতি আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। বর্তমানে আমাদের দেশে যে পরিমাণ চা উৎপাদন হয় তা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। এতে করে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে। অপরদিকে এ শিল্পের কারণে দেশের বেকার সমস্যার কিছুটা লাঘব হচ্ছে। চা উৎপাদনে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে দেশের চা-শিল্প। এবারের মৌসুম শেষে চা উৎপাদনে সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টির ধারণা ক্রমেই বাস্তব রূপ লাভ করছে। চলতি অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত চা উৎপাদনের এ ধারা ঠিক থাকলে তা হবে গত ১৬২ বছরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড। গত বছর দেশে চায়ের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অধিক। বর্তমানে চা রফতানিতে বাংলাদেশ অষ্টম। জিডিপিতে এর অবদান শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ।

চা শিল্পের ইতিহাস ঐতিহ্য অনেক পুরনো। কিন্তু অতীত আর বর্তমানের মধ্যে অনেক ফারাক। হাঁটি হাঁটি পা পা করে চা শিল্প আজ স্বাধীন দেশের একটি উন্নয়নশীল শিল্পের খাতায় নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছে। অর্থকরী ও ঐতিহ্যবাহী চা শিল্পখাত এখন সম্ভাবনার নতুন দিগন্তে উপনীত। চায়ের অভ্যন্তরীণ ও রফতানি বাজার চাহিদাকে ঘিরে এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা রচিত হচ্ছে। সুদূর অতীতকালে এদেশের মসলিন কাপড় কিংবা নিকট অতীতে পাট-চামড়া শিল্পের মতোই সুপ্রাচীন শিল্প ও বাণিজ্য খাত এই চা। সগৌরবে এগিয়ে চলেছে সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে। চা শিল্প এখন আর অবহেলিত নয়। প্রচলিত এই রফতানি পণ্যটি তার সুবিশাল বাজার সহসাই ফিরে পেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে চা শিল্প খাতকে উপেক্ষা, অবহেলার কারণে কালের বিবর্তনে হারাতে যাচ্ছিল তার সু-খ্যাতি। এবার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য সময়োপযোগী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যাতে বনেদি চা শিল্প অচিরেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

চা উৎপাদন একন শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচাঁন্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। ২০০০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়েও ছোট আঙ্গিকে চায়ের চাষ শুরু হয়। ২০০৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় চায়ের চাষ। বাংলাদেশে চা শিল্পের বিকাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৫৭-৫৮ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সে সময়ে চা শিল্পে মাঠ ও কারখানা উন্নয়ন এবং শ্রম কল্যাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

চা শিল্পের বর্তমান অবস্থা
চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল এত কারো কোন সন্ধেহ নেই। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমাগত নগরায়নের ফলে ও জনতার শহরমুখিতার কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া সামজিক উন্নয়নের ফলে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। বিগত তিন দশক ধরে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ফলে চায়ের রপ্তানি হঠাৎ করেই কমে গেছে। তারপরও জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। জিডিপিতে চা খাতের অবদান ০ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বাংলাদেশের ১৬২টি বাগানের ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ২০১৫ সালে ৬৭ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন প্রতি বছর আনুমানিক ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি হয়। কাজাখাস্থান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কুয়েত, ওমান, সুদান, সুইজারল্যান্ডসহ অনেকগুলো দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের চা।

গত দশ বছরে পৃথিবীতে চায়ের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। এই চাহিদার সাথে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর প্রায় ৫২ ভাগ চায়ের চাহিদা পূরণ করছে। সে তুলনায় চা উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে না পারলে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশের চা বিদেশে রপ্তানি করা খুব কঠিন হবে৷

আমাদের দেশে বর্তমানে চায়ের প্রায় সোয়া ২ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। ২০১৬ সালে সারা দেশে ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে, যা গত ২০১৫ সালের চেয়ে ১ কোটি ৭৮ লাখ ১০ হাজার কেজি বেশি। এটি আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৭ কোটি কেজি। ২০১৪ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার কেজি, ২০১৩ সালে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। ২০১২ সালে ৬ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার, ২০১০ সালে ৬ কোটি ৪ লাখ কেজি, ২০০৯ সালে ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার, ২০০৮ সালে ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার, ২০০৭ সালে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। ২০০৬ সালে ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার কেজি, ২০০৫ সালে ৬ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার কেজি উৎপাদন হয়।

অপর দিকে ২০১৬ সালে ১ কোটি ৪৩ লাখ কেজি চা-পাতা আমদানি করতে হয়। ২০১৫ সালে ১ কোটি ৫০ লাখ কেজি, ২০১৪ সালে প্রায় ৬১ লাখ কেজি চা আমদানি করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি ৫২ লাখ টাকার চা।

এক সময় চা রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। চায়ের হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। ভবিষ্যতে চা শিল্পের বিকাশ এবং রফতানি বাড়াতে একটি “পথ-নকশা” তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিগগিরই পথ-নকশাটি প্রকাশ করা হবে। চা রফতানিতে বাংলাদেশ এখন অষ্টম। আরও এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, দেশে প্রথমবারের মতো চা উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। চা-শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে বর্তমান সরকার।

আশা করা হচ্ছে, চা-শিল্প তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। বর্তমানে দেশে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। তার মধ্যে সিলেট জেলায় ২০টি, মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩টি, হবিগঞ্জে ২২টি, চট্টগ্রামে ২৩টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙামাটিতে ১টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২০টি বাগান আছে ব্রিটিশদের। দেশীয় মালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা ১৩১টি, আর সরকার পরিচালিত বাগানের সংখ্যা ১৬টি। এতে চা চাষের জন্য জমি রয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে ৫২ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। দেশে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার সংখ্যা এখন ১১৪টি। চা বাগানগুলোতে বর্তমানে স্থায়ীভাবে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ নারী শ্রমিক।

অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত আছে আরও ৩০ হাজার শ্রমিক। তবে চা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সাড়ে ৩ লাখ ও পরোক্ষভাবে প্রয় ৭ লাখ মানুষ জড়িত। আমাদের দেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনায় নিলে ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের মোট চাহিদা দাঁড়াবে ১২৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন কেজি এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে একই সময়ে চায়ের উৎপাদন হবে মাত্র ৮৫ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয়টি ‘চায়ের রাজ্য’ শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। গবেষণার মাধ্যমে উন্নততর প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগের ধারাবাহিকতার লক্ষ্যেই ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। শুরু থেকেই ইনস্টিটিউটটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এ ইনস্টিটিউটের বর্তমানে ৩টি পূর্ণাঙ্গ ও একটি নতুন সৃষ্ট উপকেন্দ্র রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর পরিচালক, ড. মাইনউদ্দীন আহমেদ জানান ‘বিটিআরআই তার জন্মলগ্ন থেকে সীমিত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে চা শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে আসছে। উদ্ভাবন করেছে অনেক লাগসই প্রযুক্তি। উচ্চ ফলনশীল ও আকর্ষণীয় গুণগতমানের ১৮টি ক্লোন উদ্ভাবন করেছেন বিটিআরআই-এর গবেষকরা। উদ্ভাবিত চায়ের ক্লোনগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হেক্টর প্রতি ৩ হাজার কেজি থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে চার হাজার কেজি। অদূর ভবিষ্যতে আরও দু’টি নতুন ক্লোন বিটি-১৯ ও বিটি-২০ চা শিল্পের জন্য অবমুক্ত করা হবে। চায়ের ক্লোন উদ্ভাবন ছাড়াও এ পর্যন্ত চার ধরণের বাই-ক্লোনাল ও এক প্রকারের পলিক্লোনাল বীজ উদ্ভাবন করেছে বিটিআরআই। জার্মপ্লাজম সমৃদ্ধ জীন ব্যাংক স্থাপন করেছে ৫১৭টি।’

সমগ্র বাংলাদেশে চা আবাদের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাঁকুরগাও, নীলফামারি, দিনাজপুর, লালমণিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর নেত্রকোণা, টাংগাইলের মধুপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং কক্সাবাজার জেলায় মোট ১,০১,৭২ হেক্টর স্বল্প আয়তনের জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে চা চাষ করা সম্বব হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন বছরে ৩১ মিলিয়ন কেজি থেকে বেড়ে ৬৭ মিলিয়ন কেজিতে পৌঁছেছে। আবাদী জমি ৪২ দশমিক ৬ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ৬০ হাজার হেক্টর হয়েছে। হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ৭৩৫ কেজি থেকে ১২৭০ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। এমন উন্নয়নে গবেষণাপ্রসূত জ্ঞান ও প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। উচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন উন্নত মানের চায়ের ক্লোন উদ্ভাবন করে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা স্বর্ণপদকও পেয়েছেন। স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীরা হলেন মরহুম এম এম আলী, ড. এস এ রশীদ, মরহুম হারাধন চক্রবর্তী ও জনাব এ.এফ.এম. বদরুল আলম। এছাড়া ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক ড. কে. এ. হাসান চা শিল্পে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে জাতীয় পুরস্কারেও ভূষিত হন।

জাতীয় অর্থনীতিতে চা-শিল্প
আমাদের দেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনায় নিলে ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের মোট চাহিদা দাঁড়াবে ১২৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন কেজি এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ওই সময়ে চায়ের উৎপাদন হবে মাত্র ৮৫ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি। এদিকে চা শিল্প উন্নয়নে ‘উন্নয়নের পথ নকশা’ শীর্ষক একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ পরিকল্পনায় চায়ের অতীত ইতিহাস ধরে রাখতে ও গড় ব্যবহার বাড়াতে সারা দেশের ১৬২টি চা বাগান থেকে ১১ কোটি কেজি চা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। যেহেতু চা একটি অর্থকরী ফসল, সেহেতু এর চাষাবাদ সম্পর্কে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে। দেশের চা-চাষের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও এর চাষাবাদ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে চা-চাষের পরিমাণ বাড়লে একদিকে যেমন আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল হবে, অপরদিকে কর্মসংস্থানের সৃস্টি হবে। তবে চা চাষের ক্ষেত্রে এর গুণগতমান বজায় রেখেই উৎপাদন বাড়াতে হবে।

চা শিল্পের সমস্যা
চা শিল্প বিনিয়োগের অভাবে তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার এত বেশি যে বিনিয়োগের জন্য ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা উৎপাদনকারীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা চাষাধীন জমির মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ অতিবয়স্ক, অলাভজনক চা এলাকা রয়েছে যার হেক্টর প্রতি বার্ষিক গড় উৎপাদন মাত্র ৪৮২ কেজি। এই অতিবয়স্ক চা এলাকার কারণেই হেক্টর প্রতি জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া চা বাগানের শ্রমিক অসন্তষ, জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ, চা কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে অভাব এ শিল্পের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে চা শিল্পকে প্রতি বছরই খরার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ফলে অসংখ্য গাছ মরে যাচ্ছে। এ কারণেও চায়ের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।

সমাধানের উপায়
চা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারের এগিয়ে আসা অপরিহার্য। চায়ের মাঠ ও কারখানা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য নি¤œ সুদে, সহজ শর্তে পর্যাপ্ত তহবিল প্রয়োজন। চা সেক্টরে বিনিয়োগের ৫-৭ বছর পর থেকে কাঙ্খিত হারে উৎপাদন শুরু হয়। এ কারণে ঋণ প্রদানের বছর থেকেই সুদ আরোপ করা উচিত নয়। এছাড়া চা শিল্পকে রক্ষা করার জন্য বিদেশ থেকে চায়ের আমদানি যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন।
আবার বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা চায়ের রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ এই তিনটি বিষয়ে গুণগত মান উন্নত করার ওপরই জোরালো তাগিদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে চা শিল্প ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেও যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত হয়নি। তবে সুযোগ-সম্ভাবনা রয়ে গেছে অপার। পরিশেষে বলব বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা চায়ের রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ এই তিনটি বিষয়ে গুণগত মান উন্নত করার ওপরই জোরালো তাগিদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে চা শিল্প ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে যেসব বিষয়ে একটু ঘাটতি রয়েছে তার যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত করতে পারলে আমাদের চা শিল্প উন্নতির শিখরে স্থান করে নিবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

এক্ষেত্রে যেসব দেশ চা রফতানিতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে তাদের চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে চাষিদের সরকারিভাবে স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্তা করতে হবে। চায়ের চাষ বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। যাতে করে দেশের মানুষ চা চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

আজকের বাজার/সাখাওয়াৎ লিটন