বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলো ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন

ব্রিটিশ নাগরিক মানবদরদী লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট অবশেষে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পেলেন। এই দেশের জন্য তাঁর অমিত ভালোবাসা এবং মানবতার সেবায় নিবেদিত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকার ৮৭ বছর বয়সী লুসি হেলেনকে নাগরিকত্ব প্রদান করে সম্মানে ভূষিত করেছে। লুসি হেলেন ৫৭ বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করে আসছেন।

শনিবার বিকেলে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লুসি হেলেনের কাছে নাগরিকত্বের সনদ হস্তান্তর করেন।

অনুষ্ঠানের পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের এ কথা জানান। বাংলাদেশী নাগরিকত্ব অর্জনে প্রতিবছর তাঁর ভিসা নবায়নের পেরেশানির অবসান ঘটলো।

বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এবং প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীল মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রেস সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ রেহানা উভয়ই ৮৭ বছর বয়স্ক মানবতাবাদী লুসি হেলেনের সঙ্গে কথা বলেন। লুসি বর্তমানে বরিশাল নগরীর অক্সফোর্ড মিশনে কর্মরত রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘তিনি (লুসি) নাগরিকত্ব পেয়ে অত্যন্ত খুশি।’

লুসি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন যে, তিনি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন, তবে তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি ‘আজ আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে আমার সেই আশা পূরণ হয়েছে।’
পিতা জন হল্ট এবং মা ফ্রান্সিস হল্টের কন্যা লুসির জন্ম ব্রিটিশ শহর সেন্ট হেলেন্সে ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কোল হিলস জুনিয়র স্কুলের শিক্ষকতা থেকে বিদায় নেয়ার পরে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মানবতার সেবায় অনুপ্রাণিত হন এবং নার্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।

লুসি হেলেন শৈশবের পর থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। মানবতার সেবার অঙ্গীকার নিয়ে তিনি ১৯৬০ সালে বাংলাদেশে আসেন।

ওই বছরেই লুসি হেলেন বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে যোগদান করেন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পড়াতে শুরু করেন। এরপরে তিনি আর নিজের দেশে ফেরেননি এবং এই দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণে বাংলাদেশেই অবস্থান করেন।

পরে তিনি যশোর, খুলনা, নওগাঁ, ঢাকা ও গোপালগঞ্জে ৫৭ বছর ধরে কাজ করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি অবসনে যান এবং ওই বছরেই বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে ফিরে যান।

অবসর জীবনে লুসি এখন দুস্থ শিশুদের ইংরেজি শেখাচ্ছেন এবং মানসিক বিকাশে সহায়তা করছেন। পাশাপাশি লুসি দুস্থ শিশুদের জন্য সম্পদশালী লোকদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করছেন।

অকৃতদার লুসি হেলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে যুদ্ধকালে তিনি যুদ্ধাহত লোকদের সেবা করেছেন। এ সময় লুসি যশোর ক্যাথোলিক চার্চে কাজ করছিলেন, সেখানে তিনি শিশুদের ইংরেজি শেখাতেন। যুদ্ধ শুরু হলে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য খুলনা চলে যান।

মানুষের জীবন যখন বিপণ্ন, সেই বিপদের মধ্যেও তিনি নিকটবর্তী ফাতেমা হাসপাতালে ছুটে যান এবং যুদ্ধাহত সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা দিতে চেয়েছেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা একজন বিদেশি নাগরিকের আগ্রহ দেখে বিস্মিত হন এবং দ্রুত সম্মতি প্রদান করেন। এরপর তিনি যুদ্ধাহত মানুষদের সেবা করে আসছেন।
মৃত্যুর পর লুসি বাংলাদেশের মাটিতেই সমাহিত হতে চেয়েছিলেন এবং এই দেশের নাগরিকত্বের জন্য গত ২২ জানুয়ারি বরিশালের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন জানান এবং তার আবেদনটি মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। সকল প্রকার প্রক্রিয়া সম্পাদনের পর বাংলাদেশের জন্য তার অবদানের কথা বিবেচনা করে সরকার ২২ মার্চ তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে।

এর ফলে লুসি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সকল সুবিধা পাবেন এবং ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেও তার সবরকম সুবিধা বজায় থাকবে।

লুসি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য তার বন্ধু ও অন্যান্যের কাছে চিঠিপত্রও লিখেছিলেন। লুসি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ণনা করে লেখা একটি চিঠি তার নিজের কাছে রেখেছেন।
যুদ্ধের পর তিনি ১৯৭৩ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার মুজিবের কাছে একটি চিঠি ও কিছু উপহার পাঠান। পরে শেখ রেহানা চিঠি ও উপহারের জন্য লুসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান, যা এখনও তার কাছে রয়েছে।

এমআর/