বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্করী বন্যা ১৯৭০-২০১৭

বাংলাদেশের মানুষের বন্যার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবথেকে বেশি বন্যার মুখোমুখি হতে হয় বাঙালিদের। প্রতিবছরই ছোট বড় বন্যার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে কোনো কোনো বছরের বন্যার ভয়াবহতা ভুলবার নয়। ১৯৭০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভয়াল বন্যার সমীকরণ থেকে দেখা যায়- ১৯৭০ সালের মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে শুধু লোকই মারা যায় সরকারি হিসাবে ৫ লাখ। এ বন্যায় উপকূলের ১৬ হাজার র্বগমাইল এলাকা প্লাবিত হয় এবং ১২ লাখ ৯৮ হাজার টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। ১৯৭১ সালে আরও একটি মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়। এ বন্যায় ১৪ হাজার র্বগমাইল এলাকা প্লাবিত হয় এবং ১২ লাখ টন ফসল নষ্ট হয়। এ বছর মানুষ মারা যায় ১২০ জন। ২ লাখ ১৯ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ নষ্ট এবং ২ হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। এভাবে ৭২, ৭৩ ও ৭৪ সালে বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয়। ১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবনে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৩০ হাজার র্বগমাইল তলিয়ে যায়। বন্যার করাল গ্রাসে সরকারি হিসাব অনুযায়ী লোক মারা যায় ৩৩৩ জন। আর বেসরাকরি হিসাবে এ সংখ্যা ৬০০-এর বেশি।

দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৭টিতে বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। ৪৬৮টি উপজেলার ২৯৩টি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ২ কোটি ১০ লাখ। বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৩ কোটি। বাস্তুহারা হয় ৩০ লাখ মানুষ।

বিগত ৩৫ বছরে বন্যা কবলিত হয়নি এমনসব উঁচু এলাকাও তলিয়ে গিয়েছিল ৮৮-এর মহাপ্লাবনে। এ বন্যায় দেশের প্রায় ৮০ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বন্যায় ১ কোটি কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পতিত হয়েছিল। প্রায় ২০ লাখ একর জমির ফসল পুরোপুরি এবং ১৫ লাখ একর জমির ফসল আংশিকভাবে ভেসে যায়।

বন্যায় সরকারি হিসাবে ফসল ক্ষতি হয় ২০ লাখ টন শস্য। প্রলয়ঙ্করী বন্যার ছোবলে দেশের ৬ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ১ হাজার ১৭৫ কিলোমিটার ধ্বংস হয়। এ ছাড়া সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

দেশের ২৪৬টি সেতু ও কালভার্ট বিধ্বস্ত এবং প্রায় আড়াই হাজার ফুট রেলপথ বন্যায় ভেসে যায়। সর্বোপরি গাছপালা ভেসে যায় এবং পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হয়।

সরকারি সূত্রে জানা যায়, ৮৮ এর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ মেরামতের জন্য তখন প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছিল। বন্যায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। বন্যায় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সমগ্র দেশের সব যোগাযোগ বিচ্ছেন্ন হয়ে পড়েছিল।

এ বন্যায় রাজধানীরও অনেক এলাকা ডুবে যায়। ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর, গুলিস্তান ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কিছু অংশ ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব এলাকাই জলমগ্ন হয়েছিল। তখনকার হিসাবে ৬০ লাখ লোকের রাজধানী ঢাকা শহরের প্রায় ৫০ লাখই পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

ঢাকায় প্রায় ৪০০ ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল। এসব ত্রাণ শিবিরে প্রায় ৫ লাখ বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছিল।

এ ছাড়া ২০০০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এক আকস্মিক বন্যায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ৭টি এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় ২টি জেলার ৪১টি উপজেলার ২৮০টি ইউনিয়নে বন্যায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৮ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হওয়ার পাশাপাশি উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। বেসরাকরি হিসাবে মানুষ মারা গিয়েছিল ১৩০ জন। এদের বেশির ভাগ মানুষ সাপের কামড়ে, পানিতে ডুবে এবং পেটের পীড়ায় ভুগে মারা গেছে।

সরকারি বিবৃতিতে জেলা তথ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, ৫৮ হাজার ৯০৫টি পরিবারের ৩১ লাখ ৯২ হাজার ৭৮৬ জন বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৮ লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে ৮ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সিডর প্রবাহিত হয়। এর আঘাতের কবলে পড়ে দেশের ২২টি জেলা।

সিডরে প্রায় ১৫ হাজার লোক মারা যায়। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, এটি ১৩১ বছরের ইতিহাসে বড় দশটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম।

১৯৭৪ ময়মনসিংহে প্রায় ১০,৩৬০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল বন্যা কবলিত। মানুষ ও গবাদি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি ও লক্ষলক্ষ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত।

১৯৮৭ জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যায় বড় ধরনের বিপর্যয়। প্রায় ৫৭,৩০০ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সমগ্র দেশের ৪০% এরও অধিক এলাকা)। এ ধরনের বন্যা ৩০-৭০ বছরে একবার ঘটে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতই বন্যার প্রধান কারণ ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র একীভূত হওয়ার নিচের অঞ্চল, খুলনার উল্টরাংশ এবং মেঘালয় পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়।
১৯৮৮ আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যায় ভয়ংকর বিপর্যয়। প্রায় ৮২,০০০ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সমগ্র দেশের ৬০% এরও অধিক এলাকা)। এ ধরনের বন্যা ৫০-১০০ বছরে একবার ঘটে। বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (তিন দিনের মধ্যে) দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ একই সময় ঘটার (ংুহপযৎড়হরুব) ফলে বন্যার আরও ব্যাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরও প্লাবিত হয়। বন্যা স্থায়িত্ব ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন।

১৯৮৯ সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকায় বন্যায় ৬ লক্ষ লোক পানিবন্দী।

১৯৯৩ সারা দেশে প্রচন্ড বৃষ্টিতে হাজার হাজার হেক্টর জমির শস্য পানিতে তলিয়ে যায়। মোট ২৮ জেলা বন্যা কবলিত হয়।

১৯৯৮ ১৯৯৮ সালের বন্যা হয় আগস্ট মাসে। এতে ৬৮ শতাংশ এলাকার ১ লাখ ২৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। বন্যার ব্যাপ্তি অনুযায়ী এটি ১৯৮৮ সালের বন্যার সাথে তুলনীয়। ব্যাপক বৃষ্টিপাত, একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ ঘটার ফলে ও ব্যাক ওয়াটার এ্যাফেক্টের কারণে এই বন্যা ঘটে।

২০০০ ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ৫টি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা বন্যায় বিধ্বস্ত। প্রায় ৩০ লক্ষ লোক গৃহহ্লীন। বন্যাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মাটির বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে ঘটে।
২০০৪ সালে বন্যা হয় জুলাই মাসে। এতে বাংলাদেশের ৩৮ শতাংশ এলাকার ৫৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়।

২০০৭ এই বন্যাকে “২০০৭ এর মহাবন্যা” বলা হয়। ২০০৭ সালের বন্যা হয় সেপ্টেম্বর মাসে। এতে দেশের ৪২ শতাংশ এলাকার ৬২ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়।
২০১৩ সরকারি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তথ্য অনুযায়ী ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলা এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়।ভারত থেকে আসা প্রবল বৃষ্টি ও বন্যার কারণে বাংলাদেশে এই বন্যা সংঘটিত হয়।
২০১৬ এই বন্যাকে ১৯৮৮ সালের বন্যার পর সবচেয়ে বড় বন্যা বলা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৮শে জুলাই যমুনার পানি বিপদসীমার ১২১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর প্রভাবে জামালপুরের নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চল তলিয়ে যায়।সরকারি হিসেবেই ৩৪ লাখের বেশি । মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[৩]

আজকের বাজার: আরআর/ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭