বাগেরহাটে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা

বাগেরহাটে খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া শুরু করেছে জেলা প্রশাসন, যা এক বিরল পদক্ষেপ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি দল রামপাল উপজেলার হোগলডাংগা গ্রামে গিয়ে রোকেয়া বেগম(৮৫)নামে এক বৃদ্ধার হাতে ৪ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করে। বাড়ি বসে ক্ষতিপূরণের চেক হাতে পেয়ে এখন খুঁশিতে অনেকটা আত্মহারা ওই বৃদ্ধা। শুধুমাত্র রোকেয়া বেগমই নন, একইদিনে রুমিচা খাতুন, আরাফাতুন নেছা, মান্নান মলঙ্গি, জাবের মলঙ্গি, মতিয়ার রহমান, আহম্মেদ মলঙ্গিসহ আরও ৩১ জন ভূমি মালিককে মোট ৭৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। হোগলডাংগা গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে খুঁশি ওই গ্রামের সাধারণ মানুষ।

এর আগে, হোগলডাংগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের ক্ষতিপুরণ বিষয়ে গণশুনানী অনুষ্ঠিত হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. কামরুল ইসলাম এবং ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন ক্ষতিগ্রস্তদের বক্তব্য শুনে সেখানে বসেই সিদ্ধান্ত দেন। এরপর ক্ষতিপূরণের অর্থের চেক দিতে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি বাড়ি ছুটে যান জেলা প্রশাসনের দল। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কয়েক কিলোমিটার পথ হেটে হেটে চেক হস্তান্তর করেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন গ্রামবাসী।

হোগলডাংগা গ্রামের রোকেয়া বেগম বলেন, গত আট বছর আগে তার স্বামী ইউসুফ আলী মারা গেছেন। ছয় ছেলে-মেয়ে আর নাতি-নাতনি নিয়ে তার সংসার। বাড়ির পাশে খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এজন্য তাদের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আর ক্ষতিপূরণ বাবদ তাকে চার লাখ ১৫ হাজার টাকার চেক দিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ক্ষতিপূরণের এই চেক নিতে আগে মানুষের ছোটাছুটি আর বিড়াম্বনার শেষ ছিল না। কিন্তু এখন বাড়িতে বসেই ক্ষতিপূরণের টকা পাওয়ায় খুঁশি স্থানীয়রা।

বাড়িঘরের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাঁচ লাখ আট হাজার টাকার চেক পাওয়ার কথা জানালেন একই গ্রামের আরাফাতুন নেছা। তিনি বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাড়ি এসে স্বাক্ষর নিয়ে তার নিজের হাতে ওই চেক তুলে দিয়েছেন। চেক হাতে পাওয়ার পর তার বিশ্বাস হয়েছে যে, বাড়ি বসে ক্ষতিপুরণের চেক পাওয়া যায়। কোন ধরণের বিড়ম্বনা হয়নি ওই চেক পেতে। একই গ্রামের রুমিচা খাতুন জানান, আমি বাড়িতে সংসারের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ করে কয়েকজন কর্মকর্তা আমার বাড়িতে আসেন এবং পরিচয় নিশ্চিত হয়ে টিপসই নিয়ে আমার হাতে পাঁচ লাখ ৫৯ হাজার টাকার চেক তুলে দেন।

ওই গ্রামের আরও বেশ কয়েজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে হতো। মাসের পর মাস ছুটতে হয়েছে সবাইকে। কিন্তু আজ বাড়ি বসেই ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে খুঁশি সবাই। বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান,‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুন্য সহিষ্ণুতানীতি তৃণমুল পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে চাই। সেবা প্রাপ্তির বিষয়ে জনগণকে সন্তুষ্টির জায়গায় নিতে চাই। এর অংশ হিসেবেই সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করা হচ্ছে।’

তিনি আরও জানান, আগামীতে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমির মালিকরা অনলাইনের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য আবেদন করতে পারবেন। প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে গণশুনানী করা হবে এবং ক্ষতিপূরণের টাকা অনলাইনের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা দেয়া হবে। শিগগিরই অনলাইনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের টাকা দেয়ার কাজ শুরু হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. কামরুল ইসলাম জানান,‘বাগেরহাট খানজাহান আলী বিমানবন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপুরণের টাকার চেক মানুষের বাড়িবাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিচ্ছি। এর ফলে দালালদের দৌরাত্ব কমবে। একইসাথে সরকারি সেবা সহজিকরণের বিষয়টি মানুষ বুঝতে পারবে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসবে। দেশে এই প্রথম ভূমি অধিগ্রহণের টাকার চেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে।’ বাগেরহাট জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য সরকারি ছুটির দিনেও আমরা কাজ করছি। জনগণ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের হাতে চেক তুলে দিয়েছি।

উল্লেখ্য, খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশে বাগেরহাট জেলার রামপালে খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রথম অধিগ্রহণ করা ভূমিতে আগেই মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে বিমানবন্দরের সীমানা নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে দ্বিতীয় দফায় অধিগ্রহণ করা ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া হচ্ছে। বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ বিভাগ জানায়, খানজাহান আলী বিমানবন্দরের জন্য প্রথম ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ৯৭ দশমিক ৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

দ্বিতীয় দফায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রামপাল উপজেলার ধলদাহ, ঝালবাড়ি, চাচুরী, গোবিন্দপুর, হোগলডাংগা, দেবীপুর, বামনডহর এবং বড় নবাবপুর গ্রামের ৫২৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এসব জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের জন্য জন্য মোট ১৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে এক হাজার ২৫০ জন ভূমি মালিককে ক্ষতিপুরণ হিসেবে ১০৯ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাস থেকে শুরু হয়েছে ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর। প্রথমে আনুষ্ঠানিকভাবে চেক দেয়া হলেও, বর্তমানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ বাবদ সর্বোচ্চ এক কোটি ৩০ লাখ টাকা পেয়েছেন একজন ভূমি মালিক। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান