বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রযুক্তি ও পরিবর্তনের ছোঁয়া

রনি রেজা:
প্রযুক্তির ধাক্কায় বিলুপ্তপ্রায় অবস্থা হাজার বছর লালিত ঐতিহ্য বাঙালী সংস্কৃতির। খাবার-দাবার, পোশাক-আশাক, খেলাধুলা, আচার-অনুষ্ঠান, জীবন-যাপন, বিনোদনের মাধ্যম থেকে শুরু করে কৃষি ব্যবস্থা পর্যন্ত প্রত্যক জায়গায়ই লেগেছে পরিবর্তন কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। এটা অবশ্যই সুখের সংবাদ। তবে একই সাথে আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পরিচয়ের জায়গা, আমাদের গর্বের জায়গা হারিয়ে ফেলার কষ্টও কম নয়। সংস্কৃতির জন্য আমাদের ত্যাগও যে বেশি।

যুগ থেকে যুগান্তর চলছে পরিবর্তনের মহড়া। চারিদিকে হু হু করে ঘটছে পরিবর্তন। সময়ের তালে দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে প্রযুক্তি। সহজ থেকে সহজতর হয়েছে জনজীবন। এতে প্রাপ্তি যেমন অনেক,ত্যাগও কম নয়। এসব প্রযুক্তির ধাক্কায় বিলুপ্তপ্রায় অবস্থা আমাদের লালিত ঐতিহ্য। ভুলতে বসেছি হাজার বছর ধরে আগলে রাখা বাঙালী সংস্কৃতি। অচেনা হয়ে পড়ছে অতিপরিচিত বাঙালী সংস্কৃতি।

সংস্কৃতি এমন একটি বিষয় যাকে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সংস্কৃতির পরিধি অনেক বড়। তবে সাধারণত কোনো জাতির সামগ্রিক পরিচয়কে সংস্কৃতি বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, মানুষের জীবনচর্চা ও চর্যার বৈচিত্র্যময় সমন্বিত রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি। মানুষের জীবনযাপনের ধরন, ঐতিহ্য, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, নীতি-নৈতিকতা, এগুলো সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ। একটি জাতির জাতিগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সংস্কৃতি। বাঙালী, ইংরেজ, আরবীয়, জাপানিজ সবাই আলাদা জাতি। আর একেকটা জাতির রয়েছে আলাদা সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য।
একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালীরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। যার সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির মিল নেই। বাঙালী ভাত-মাছ খায়, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে, জারি-সারি-ভাটিয়ালি শোনে, এগুলো বাঙালী সংস্কৃতির উপাদান। এ রকম সহ¯্রাধিক উপাদান রয়েছে, যেগুলো বাঙালিত্বের পরিচয় বহন করে। এ সংস্কৃতিগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি। একটু একটু করে চর্চার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিশ্বের বুকে। আজ প্রযুক্তির চাপে তা বিলুপ্তির পথে।
পৃথিবীর বুকে এমন জাতির সংখ্যা খুবই কম, যারা সংস্কৃতির জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। বাঙালী দিয়েছে। ভাষা সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি আমাদের এই সাংস্কৃতিক অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। বাঙালী তা মানেনি। মানেনি বলেই রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার বিসর্জন দিলেন তাদের জীবন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ সেখানেও পরিবর্তন ঘটেছে। পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিই সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। বাঙালী সংস্কৃতিও এর বাইরে নয়। শত বছর আগের বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের বাঙালী সংস্কৃতির বহু অমিল খুঁজে পাওয়া যাবে। যদি খাদ্যাভ্যাসের দিকে লক্ষ্য করি দেখা যাবে, ধান চাষ ও চাল উৎপাদন বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। ধনী-গরিব সবার প্রধান খাবার ছিল ভাত এবং মাছ। ঘি মেশানো গরম ভাত খাওয়ার কদর ছিল প্রাচীনকালে। অতীতে শাক ও অন্যান্য ব্যঞ্জন সহকারে ভাত খাওয়ার নিয়ম প্রচলিত ছিল। তরকারির মধ্যে বেগুন, কুমড়া, ঝিঙা, করল্লা, কচু ইত্যাদি ছিল প্রিয় খাবারের তালিকায়। বিভিন্ন তরকারির সঙ্গে টক দই ব্যবহারের প্রচলন তখন থেকেই। ফলের মধ্যে কলা, তাল, আম, কাঁঠাল, বেল, নারিকেল ইত্যাদি বাঙালীর প্রাচীন খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। আপেল, আঙুর, নাসপাতি, বেদানা ইত্যাদি আসত বাইরে থেকে। চাল দিয়ে তৈরি হতো মুড়ি, চিড়া, খই, নাড়ু এবং তেলমুক্ত নানা রকমের পিঠা। আজকের দিনে ওইসবের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিদেশি পিৎজা, স্যান্ডউইচ, বার্গার, নামি দামি, বিস্কিট।

এসেছে হালিম, কাবাব আরও কত কিছু। অতিথি আপ্যায়নেও এসেছে পরিবর্তন। আগে বড় বড় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো মাটিতে চাটাই পেতে কলাপাতায়। তারপর এল মাটির সানকি বা বাসন। এরপর এল চিনামাটি, কাচ, স্টিলের থালাবাসন। অতিথিদের এখন চেয়ার-টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবারের পর আগের মতো সেই মিষ্টান্নের সমাহার চোখে পড়ে না। বহুজাতিক কোম্পানির বিভিন্ন পানীয় পরিবেশন করা হয়।

পরিবর্তন এসেছে বাঙালীর পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার সংস্কৃতি বিষয়েও। সেলাইবিহীন একবস্ত্র ছিল বাঙালীর পোশাকের আদি রীতি। তখন বাঙালী পুরুষেরা ধুতি আর মেয়েরা শাড়ি পরত। পরে সেলাই করে জামা-কাপড় উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে আমদানি হলো। ৭ম ও ৮ম শতকের দিকে কাপড়ে ফুল, লতাপাতা ইত্যাদির নকশার প্রচলন হয়। নর্তকীরা কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আঁটসাঁট পাজামা, আর গলায় বড় একটা ওড়না ব্যবহার করত। সাধু-সন্ন্যাসী ও দরিদ্র শ্রমিকেরা পরত নেংটি। সৈন্য ও মল্লবীররা পরত হাঁটু পর্যন্ত আঁট-পাজামা। শিশুরা পরত হাঁটু পর্যন্ত ধুতি নয়ত আঁট-পাজামা। সৈন্য ও প্রহরীরা ফিতাবিহীন পায়ের কণ্ঠা পর্যন্ত ঢাকা চামড়ার জুতা পরত। সাধারণ লোকেরা জুতা ব্যবহার করত না। ধনীরা কাঠের পাদুকা ব্যবহার করত। বিবাহিত নারীরা কপালে কাজলের টিপ, সিঁথিতে ও ঠোঁটে সিঁদুর, পায়ে লাক্ষারস, দেহ ও মুখে চন্দনের গুঁড়া ও চন্দন বাটা এবং জাফরান ব্যবহার করত। পুরুষেরা হাতের নখ বড় রাখত এবং নখে রং লাগাত। বিলাসিনীরা ঠোঁটে লাক্ষারস ও খোঁপায় ফুল গুঁজে দিত। গ্রাম ও শহরের মেয়েদের সাজসজ্জায় পর্থক্য তখনই ছিল। গ্রামের পুরুষেরা মাঠে আর মেয়েরা সংসারের হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে সব কাজ করত। সূক্ষ্ম কার্পাস ও রেশম কাপড়ের জন্য বাংলাদেশ ছিল বিখ্যাত। তবে এসব ছিল উচ্চবিত্তের জন্য। সাধারণ দরিদ্রের কপালে জুটত মোটা ছিন্ন ও জীর্ণ কার্পাস কাপড়।

সময়ের ব্যবধানে বাঙালীর পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার সংস্কৃতিরও বহু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন কেউ সেলাইবিহীন বস্ত্র পরে না। তার বদলে স্থান করে নিল লুঙ্গি। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে লুঙ্গির পাশাপাশি বাঙালী প্যান্ট পরতে শুরু করল। অভিজাতরা পরতে শুরু করল প্যান্ট-স্যুট-টাই। নারীদের শাড়ির পরিবর্তে এলো সালোয়ার-কামিজ, কাঠের খড়মের বদলে চামড়া ও প্লাস্টিকের জুতো। জমিদার আমলে সাধারণ মানুষ জুতা পরলেও জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় জুতা খুলে যেতে হতো। সূক্ষ্ম কার্পাস ও রেশম কাপড় উধাও হয়ে এখন প্রচলিত হয়েছে নানা ধরনের কাপড়। এখন মেহেদি গাছ থেকে মেহেদি পাতা সংগ্রহ করে কষ্ট করে বেটে হাতে লাগাতে হয় না। বিভিন্ন কোম্পানি বাজারে এনেছে প্যাকেটজাত মেহেদি।

বাঙালীর প্রাচীন খেলা হাডুডু বা কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নৌকাবাইচ, এলাটিং বেলাটিং, ঘুড়ি ওড়ানো, বলীখেলা, কড়ি, মার্বেল, ষোলো ঘুঁটি, লাটিম, ডাংগুলি বা ডা-াগুলি, এচিং বিচিং, ওপেন্টি বাইস্কোপ, কুতকুত, ফুল টোকা, পুতুল খেলা, নুনতা, পানি ঝুপ্পা, কানামাছি, গাইগোদানী, টোপাভাতি, লুডু তো এখন দেখাই যায় না। এসবের বদলে ধীরে ধীরে প্রচলন ঘটতে শুরু করল ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলা।
সংস্কৃতির পরিবর্তনও চোখে পড়ার মত। একসময় যাত্রাপালার প্রচলন ছিল। এখন সেই স্থান দখল করেছে থিয়েটার, সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন। এসেছে ব্যাটারিচালিত নানা খেলনা গাড়ি, প্লাস্টিকের পুতুল, পশু-পাখিসহ কত কি। এখন আগের মতো আর কবিগানেরও প্রচলন নেই। পুঁথিপাঠও তেমন দেখা যায় না।

আগে যেখানে ধর্মীয় দু’চারটা উৎসবই পালন হতো এখন সেখানে যোগ হয়েছে থার্টি ফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ যুগে দিবসগুলো তো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণস্থান দখল করে আছে।

বাঙালীর ভাষার পরিবর্তনও লক্ষণীয়। চলতি পথে, রাস্তায় ফুটপাথে, বাস, ট্রেনে, টেলিভিশনের নাটক, টকশো এবং রেডিওতে কান পাতলেই এখন প্রকৃত বাংলা ভাষার ব্যবহার শোনা যায় না। মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এবং যোগাযোগের মাত্রাভেদের ওপর ভাষার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, হচ্ছে।

এরকম বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। একটু খেয়াল করলেই পরিবর্তনগুলো দেখা যায়।

এই পরিবর্তনে আনন্দ যেমন আছে, বেদনাও কম নয়। সংস্কৃতির পরিবর্তন যদি আনন্দদায়ক হয় বেশি সুবিধার হয় তাহলে গ্রহণ করতে ক্ষতি নেই। তবে স্ব-অস্তিত্ব ভুলে গেলেও তো চলবে না। নিজ সংস্কৃতি ধ্বংস করে আনন্দিত হওয়ার কারণ নেই। সংস্কৃতির এমন কিছু উপাদান আছে, যেগুলোর পরিবর্তন ঘটলে জাতিগত সঙ্কট সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু পরিবর্তনকে স্বাগত জানানো যায়। কিন্তু সব পরিবর্তনকে মেনে নিলে জাতিগত সঙ্কট যে তৈরি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭