বিজয়ের চার দশক পেরিয়ে : অর্জনের ঝুলি আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো

স্বাধীনতার রূপকারেরা স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকল্পে অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছেন কিংবা দেখেছিলেন, তার কতটা বাস্তবে রূপ নিয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখার সময় এসেছে। চার দশক পর কী দেখতে চেয়েছিলাম, আমরা কী পেয়েছি, কী পাওয়ার যোগ্যতা আমাদের আছে এবং আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নপূরণের পথে বাধাসমূহ কী তা ব্যাখ্যা করার সময় বোধহয় এসেছে। তবে এ কথা জোরগলায় বলা যায়Ñআমাদের এই বাংলাদেশকে এখন আর কেউ “তলাবিহীন ঝুড়ি” বলার ঔদ্ধত্য দেখাবে না। কারণ, বাংলাদেশের ঝুড়িতে গত চার দশকে জমেছে অনেক কিছু, যেখান থেকে বাইরের জগতেরও ধার করতে হয়। তবে বিজয়ের মাসে আমাদের এক বিশ্বজিৎ যেভাবে চাপাতির কোপে নৃশংভাবে খুন হলেন, সেসব বিষয় সামনে আনলে আমাদের অনেক অর্জনই ফিকে মনে হবে। এই লেখায় অর্থনীতির সরাসরি বাইরের বিষয়গুলোকে না আনাই ঠিক হবে।

যখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা আজকের ষোল-সতের কোটির কয়েক ভাগের এক ভাগ ছিল, তখনও পাঠ্যবইতে পড়তে হতো ‘জনসংখ্যা সম্পদ না আপদ’। অথচ আজ এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্যে খাদ্যের জোগান দিচ্ছে এই দেশের কৃষক সমাজ। এখন আর মানুষ এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আপদ বিবেচনা করে না। বরং এই বিশাল জনগোষ্ঠী সম্পদ হিসেবে গণ্য হচ্ছে এ দেশের মানুষের কাছে ও বহির্বিশ্বে। একসময় আমার মাকে দেখেছি একথালা পান্তাভাত দিয়ে কাজের লোক রাখতেন আমাদের বাড়িতে। সেই একথালা পান্তা নিয়ে কত কাড়াকাড়ি। অথচ আজ গরম ভাত-তরকারি আর হাজার টাকা বেতন দিয়েও কাজের লোক পাওয়া যায় না গ্রামদেশে। তার মানে, মানুষের অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে গত চার দশকে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ লক্ষ্যে পৌঁছার কাছাকাছি। শিশুমৃত্যুহার, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু, সর্বজনীন শিক্ষা, শিক্ষায় নারী-পুর”ষ বৈষম্যÑএসব দিক দিয়ে বাংলাদেশ নিজের অবস্থানের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশী অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ আরও বেশি ভালো অবস্থানে রয়েছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু।

বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা বিদেশের উৎপাদনে অংশ নিয়ে তাঁদের ভাগ হিসেবে প্রতিবছর দেশে নিয়ে আসছেন বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা চৌদ্দ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার পথে এগোচ্ছে। তার সাথে যোগ হচ্ছে আমাদের পোশাক-শ্রমিকদের কর্মফলÑআরও আঠারো থেকে বিশ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। অর্জন-কৃতিত্বের দাবিদার আমাদের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা-সমাজও। এ হলো দেশের বাইরে থেকে ফি-বছর আমরা কী অর্জন করছি।

অন্যদিকে দেশের ভেতরে সামগ্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হার যা সত্তরের দশকে ছিল মাত্র এক শতাংশ। তা আশির দশকে সাড়ে তিন শতাংশ, নব্বইয়ের দশকে সাড়ে চার শতাংশ, তার পরের দশকে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে পাঁচ শতাংশে; বর্তমানে যা সাড়ে ছয় শতাংশ। এখন আমরা সাত থেকে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছি। খুব শিগগিরই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি ।

ফলে গত চার দশকে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের যে অর্জন, তাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তবে আমাদের প্রত্যাশার কতটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অথবা আমাদের পক্ষে এই চার দশকে আরও কতটা অর্জন করা সম্ভব ছিল তা-ও পর্যালোচনার দাবি রাখে। তবে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক থাকবেই। ফারাক কতটা বেশি, তা-ই আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে পর্যালোচনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে এক বিশাল ফারাক। আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি আমাদের সম্ভাবনার একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। প্রথমত, এই বিশাল জনগোষ্ঠী থেকে আমাদের বিশাল প্রাপ্তির এক সম্ভাবনা ছিল, যা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। যে সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

আমাদের জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ তরুণ। পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের জনসংখ্যার কর্মক্ষম অংশÑযারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয়Ñঅনেক বড়, আনুপাতিক হারে চিন্তা করলে। এই বিশাল কর্মক্ষম তারুণ্যকে আমরা প্রকৃত অর্থেই সম্পদে পরিণত করতে পারিনি। তাদের সম্পদে পরিণত করার জন্য প্রয়োজন তাদের মধ্যে দক্ষতার বীজ বপন করা। আর এ জন্য দরকার তাদের সুস্বাস্থ্য এবং সুশিক্ষা; দরকার কর্মমুখী শিক্ষা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় গুণাবলিসহ দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তাদের রূপান্তর করা হয়নি। তাই তাদের একটি বড় অংশ মূলত অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে দেশে-বিদেশে কর্মরত আছে। আজ বিদেশ থেকে যে প্রবাসী আয় দেশে আসছে, তা মূলত অদক্ষ শ্রমিকের দ্বারা অর্জিত। ফলে এ দেশের শ্রমশক্তির একটি বিরাট অংশ যারা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে নিচু স্তরের কাজগুলো করছে এবং সবচেয়ে কম মজুরি পাচ্ছে, তারা এই বাংলাদেশকে প্রবাসী আয় দ্বারা খুব বেশি সামনে এগিয়ে নিতে পারবে না। (শ্রমের মর্যাদার ক্ষেত্রে এই নিচু স্তরের আর উঁচুস্তরের ভেদাভেদকে বোঝাচ্ছি না।) অভিবাদন জানাই, যারা দূরপ্রবাস থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের।

এই অদক্ষ শ্রমিকদের দক্ষ করে পাঠাতে পারলে, এই শ্রমশক্তি দেশের জন্য আরও অনেক বড় অর্জনে সক্ষম হতো। অন্যদিকে, যাদের আমরা অপেক্ষাকৃত দক্ষ এবং মেধাবী মনে করছি, তাঁরা পাড়ি জমাচ্ছেন উন্নতবিশ্বের দিকে। এই দেশ থেকে ষোল বছরের শিক্ষা নিয়ে তাঁরা উন্নতবিশ্বের নাগরিক হিসেবে সেখানেই থেকে যাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়; তাঁরা বাংলাদেশে তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে অদক্ষ শ্রমিকদের প্রেরিত প্রবাসী আয়ের বড় একটা অংশ উন্নতবিশ্বের সেই সব দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা এভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের যুক্তি, দেশ তো যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দিতে পারছে না। এ কথা একেবারে অসত্যÑতা-ও বলা যাবে না। কারণ এই দক্ষ-অদক্ষ বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ কর্মসংস্থানের। তাঁদের কর্মসংস্থান হলে, তাঁদের উপার্জিত অর্থের একটা বড় অংশ সঞ্চয়ে পরিণত হয়ে বিনিয়োগ বাড়াবে। আর সেই ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধি বাড়াকে অর্থনীতির পরিভাষায় ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলা হয়। কিন্তু সেই সুবিধার বাস্তবায়ন আমরা ঘটাতে পারিনি প্রথম ধাপের বিনিয়োগের স্বল্পতা এবং অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে। এই ঘাটতি যতটা না ভৌত অবকাঠামোর, তারচেয়ে বেশি এনার্জি অবকাঠামোর।

দ্বিতীয়ত, এই বিশাল অদক্ষ শ্রমশক্তির জন্য যে অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ফলে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক সুবিধার ক্ষেত্রে যে আঞ্চলিক বৈষম্য বিরাজমান ছিলÑযা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির নিয়ামকগুলোর একটিÑসেই ধরনের বৈষম্য না থাকলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এক বিরাট অসমতা লক্ষণীয়। কারণ, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ঢাকার একচ্ছত্র আধিপত্য।  শহরমুখী বিশেষ করে, ঢাকামুখী হচ্ছে সারা দেশের বেকার-যুবকেরা। এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটারে বসবাসরত লোকজনের কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মাত্র পাঁচশ বর্গকিলোমিটার আয়তনের শহর, ঢাকা। ১৯৭৪ সালে ঢাকার আয়তন ছিল ২৮০ বর্গকিলোমিটার যেখানে বসবাস ছিল ষোল লাখ মানুষের। ২০০১ সালে ৩৫৩ বর্গকিলোমিটারে বাস ছিল চুরাশি লাখ মানুষের। তার এগার বছর পর ২০১২ সালে ৫০০ বর্গকিলোমিটারের এই শহরে বাস করছে দেড় কোটি মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের দিকে ঢাকার জনবসতি হবে পাঁচ থেকে ছয় কোটি। প্রশ্ন হলো, এই বিশাল আকারের জনপ্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে আবাসনসহ অন্যান্য নাগরিক-সুবিধা বেড়েছে কি না, কিংবা বাড়বে কি না। না বাড়লে মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে ঢাকা। ভূ-গর্ভস্থ বিভিন্ন স্তরের থেকে পানি উত্তোলনের ফলে ভূমিকম্পের আশংকা ছাড়াও ঝুঁকি বাড়বে ঢাকার ভূ-স্তর দেবে যাওয়ার।

গত এক যুগে ঢাকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও সেই হারে বাড়েনি অবকাঠামো আর বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। ঢাকার মূল শহরের রাস্তাঘাট যা ছিল, মোটামুটিভাবে তা-ই আছে। রাস্তাাঘাট কিছুটা বেড়েছে ঢাকার প্রান্তিক এলাকাগুলোতে। কিন্তু মূল ঢাকাতে তো চলার কথা প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ যানবাহন, এক যুগ আগের তুলনায়। আর্থিকভাবে সচ্ছল লোকজনের গাড়ির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বাড়ায় যানবাহনের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে মূল ঢাকার ট্রাফিক-ব্যবস্থার ওপরও বাড়ছে চাপ। মার্কেট আর ব্যবসা-বাণিজ্য একেক দিন একেক এলাকায় বন্ধ রেখে স্কুল-কলেজ আর অফিস-আদালত চলার সময় সমন্বয় করে এবং রোজার মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে করা হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ট্রাফিক-ব্যবস্থাপনা।

কিন্তু অন্যান্য সুবিধাÑযেমন পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা, আবাসন ইত্যাদি তো আর এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাপনার বিষয় নয়। ফলে রাজধানী শহর ঢাকার কোনো সমস্যার সমাধানই সম্ভব নয়, যদি দেড় কোটি লোকের এই মেগা শহরমুখী জনস্রোত থামানো না যায়। রাজধানী হিসেবে ঢাকার অন্য রকম গুরত্ব থাকবেই। তাই বলে এই শহর এককভাবে সফল অর্থনৈতিক ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্র হওয়া ভীষণ সমস্যার। এ সমস্যার সমাধানের জন্য যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ দরকার, তা সুদূরপরাহত। অন্যান্য শহরগুলো বরাবরের মতোই ব্যর্থ হচ্ছে অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করতে। ফলে ঢাকা কেন্দ্রিক এই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো এই উন্নয়ন টেকসই না হওয়ার সম্ভাবনা।

‘টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার পরিবেশগত সুরক্ষার, সামাজিক উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক অগ্রগতি’Ñএই তিনটি প্রয়োজন অবশ্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এই তিনটির প্রত্যেকটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সীমার অতিরিক্ত জনবসতির ফলে। এ কথা যেমন সত্য পুরো বাংলাদেশের জন্য, তেমনি সত্য ঢাকা শহরের জন্য। ঢাকাকে উদাহরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বর্তমানে ওয়াসা ঢাকার শহরের একশ ভাগ মানুষের পানির যে চাহিদা মেটায়, তার সাতাশি ভাগ আসে ভূ-গর্ভস্থ উৎস হতে। ওয়াসা চাচ্ছে, ভূ-উপরিভাগের বিভিন্ন উৎস থেকে এই পানির প্রয়োজন মেটাতে।

কারণ ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় উত্তোলনের ফলে শূন্যতার তৈরি হচ্ছে ভূ-গর্ভে। নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। এভাবে চলতে থাকলে দেবে যেতে পারে ঢাকা শহরÑমেক্স্রিকো সিটি বা পৃথিবীর অন্য আরও কয়েকটি শহরের মতো। কিন্তু সমস্যা হলো, ভূ-উপরিভাগের পানির মূল উৎস আশপাশের নদীগুলো অতিরিক্ত জনবসতির চাপে, বিভিন্ন দূষণের কারণে আর ব্যবহারযোগ্য নেই। ফলে ঢাকার শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার দূরের নদী থেকে আনতে হবে বিশুদ্ধ পানি। যার ব্যয় বহন করা এক রকম অসম্ভব আমাদের পক্ষে। তার মানে, আস্তে আস্তে পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ব্যর্থতার কারণে কিছু অনিবার্য সমস্যার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি, যা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে দার”ণভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

এ ধরনের পরিবেশগত সুরক্ষা বজায় রাখতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি সারাদেশ জুড়ে। আরও ব্যর্থ হচ্ছি ফসলি জমির বিকল্প ব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা করতে। মনে রাখতে হবে, আমাদের আছে এই বিশাল অদক্ষ জনগোষ্ঠী আর এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি। এই দুয়ের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের সেই অর্থে খনিজ সম্পদের কোনো প্রাচুর্য নেই। অতএব অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ না করতে পারলে আমরা আমাদের সীমিত এই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হব। যাতে দার”ণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি।

তবে এই অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটা বড় কারণ, বিশাল জনগোষ্ঠীÑএ কথা ভুলে গেলে চলবে না। যেহেতু আমাদের ভূ-সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তার ওপর বিশাল এক জনগোষ্ঠী নির্ভর করলে টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি, শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আর এখন টাকায় আধা ছটাক চালও পাওয়া যায় না। অবশ্য টাকায় আট মণ চালের নানাবিধ কারণ ইতিহাসবিদেরা বলে থাকেন। সেই বিতর্কে না গিয়ে যে প্রশ্নের অবতারণা করা যায়, তা হলো শায়েস্তা খাঁর আমলের তুলনায় অনেক গুণ বেশি জমিতে এখন ধানের চাষ হয়।

আর ফলন হয় সে সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। তার পরও চালের এত দাম কেন এখন? এ ক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রার সরবরাহ প্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তবে সেদিক বিবেচনায় না এনেও যে কথা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে বলা যায়, তা হলো যে হারে চালের মোট উৎপাদন বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক অনেক কম হারে মাথাপিছু উৎপাদন বেড়েছে জনসংখ্যার দ্র”ত প্রবৃদ্ধির কারণে। ফলে উৎপাদন যতই বাড়–ক, তা মানুষের জীবনমানের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবে তখনই, যখন জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

আবার এই বিশাল জনগোষ্ঠী আমাদের কৃষি-প্রবৃদ্ধিকেও বাধাগ্রস্ত করছে বিভিন্নভাবে। কারণ, প্রধান খাদ্য চাল-উৎপাদনের জন্য আমাদের উচ্চফলনশীল প্রজাতির ধান উৎপাদনে মনোযোগী হতে হচ্ছে, বাড়ছে কীটনাশক আর রাসায়নিক সারের অবাধ ব্যবহার। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ। ফলে, আবার ধানী জমির এক বিশাল অংশে করতে হচ্ছে মৎস্য চাষ। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলে পরিবেশের এই চক্রের মধ্যে আমাদের পড়তে হতো না। জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে দেড়ের চেয়েও কম। যাকে শূন্যের কাছাকাছি না আনতে পারলে আরো অনেক সমস্যার মধ্যে পরবো আমরা দীর্ঘমেয়াদে। তবে এই সমস্যার সমাধানে সরকারের দিক থেকে কোন কার্যকর পদক্ষেপ, আগের দশকে দেখলেও বর্তমানে দেখছি না।

অবশ্য সুশাসনের অভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ সঠিক পথে এগোচ্ছে না। সরকারি সম্পদের সদ্ব্যবহারও হচ্ছে না। সুশাসনের অভাবে বেসরকারি খাতÑবর্তমানে যা বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তিÑযে গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেভাবে পারছে না। সরকার, বেসরকারি খাতের জন্যে সহায়ক হিসেবে যেভাবে কাজ করার কথা তা করছে না। সুশাসন না থাকায় দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন খাতে। যে ব্যাংকব্যবস্থা ও পুঁজিবাজার ষোল কোটি মানুষের সঞ্চয়কে বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা, সেখানেও  গুরতর অনিয়ম। আস্থাহীনতায় ভুগছে সমগ্র আর্থিক খাত। সুশাসনের অভাবে আয়বৈষম্য কমছে না, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সরকারি সম্পদের লুটপাট চলছে।

কে জানে, অর্থনীতির গত চার দশকের অগ্রযাত্রার কারণেই হয়তোবা সুশাসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেট ছিল আনুমানিক ২৮০ কোটি টাকা।  রাজস্ব আর উন্নয়ন মিলে বর্তমান অর্থবছরে তা প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতি ধর্তব্যে আনলেও এ এক বিরাট উল্লম্ফন। এই বিশাল বাজেটের ছিটেফোঁটাও কারো হাতে আসলে তা এক বিশাল পরিমাণ। ফলে সরকারি নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া, তার বাস্তবায়ন ও সরকারি সম্পদের ব্যবস্থাপনায় যত কম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে তত বেশি সরকারি আয় ও সম্পদ সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের হস্তগত হবে। এই কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের ভিতর থেকেই বাধা আসবে এবং বাস্তবে তা আসছেও। সুশাসনের অভাব উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করবে বিধায় সরকারের বাইরে থেকে এর জন্যে চাপও বাড়তে থাকবে। বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার পক্ষ থেকে ক্রমাগত চাপ বাড়ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করার জন্যে আমাদের দরকার সুশাসন ও কার্যকর সরকারি প্রতিষ্ঠান। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যা ইতোমধ্যেই আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করছে। আমরা হারাতে চলেছি ভূ-সম্পদের একটা বড় অংশ। এ জন্য যারা দায়ী, উন্নত বিশ্বের সেসব দেশ থেকে আমাদের হিস্যা আদায় করতে দরকার সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকর উদ্যোগ এবং প্রাপ্ত বিদেশি সম্পদের সঠিক ব্যবহার। ভারতের সাথে পানি-সম্পদের হিস্যা নিয়েও আমাদের শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ দরকার। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হলেই আমরা পাব প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল। আমরা যখন অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছিÑচীন আর ভারতের সাথে বৈশ্বিক পর্যায়েÑআমাদের থাকতে হবে প্রতিপক্ষের আমলাদের সাথে কার্যকর দরকষাকষি করার মতো দক্ষ আমলাতন্ত্র। প্রবাসী আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রবাসীদের সমদক্ষতায় নিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশি শ্রমশক্তিকে। যোগাযোগ-প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে হবে ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের সমপর্যায়ে। এসবের জন্য দরকার দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তি।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দার”ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আমাদের অর্থনীতিকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দরকার রাজনীতিবিদদের জোরালো সদিচ্ছার। এনার্জি অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যে বাধাসমূহ রয়েছে, তা দূর করার জন্য দরকার রাজনীতিবিদদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত। বিদেশি কয়লার ওপর ভিত্তি করে আমাদের এনার্জি অবকাঠামোর ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা একেবারেই অসম্ভব। তা করতে গেলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা-ও ভেস্তে যাবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে মূল বাধা সম্পদের নয়, রাজনীতির; রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছার। এই সদিচ্ছা তাঁদের মধ্যে আমরা অচিরেই দেখবÑএটাই আমাদের প্রজšে§র প্রত্যাশা।

ড. মোহাম্মদ হেলাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও ইকোনোমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক।