বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর পৃথিবীব্যাপী বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। International Diabetes Fedaration (IDF) এর উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর  দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো  “নারী ও ডায়াবেটিস : স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ আমাদের অধিকার”। IDF- অতি বিচক্ষণতার সাথে প্রতিপাদ্যা বিষয়টি ঠিক করেছে, কেননা ডায়াবেটিস পৃথিবীব্যাপী একটি ব্যাপক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে সনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে মোট  ডায়াবেটিস রোগীর কমপক্ষে ১৬.২ শতাংশ শুধুমাত্র গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এ হার মোট ডায়াবেটিস রোগীর ২৩.৬ শতাংশ। বাংলাদেশে এর চেয়ে বেশিও হতে পারে। প্রায় ১৯৯ মিলিয়ন নারী ২০১৬ সালে ডায়াবেটিস আক্রান্ত ছিলেন। যা ২০৪০ সালে ৩১৩ মিলিয়নে উন্নীত হবে। অন্য দিকে প্রতি ৫ জনে ২ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলা প্রজনন সময়কালের মধ্যে আছেন। যা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন। প্রতি বছর ২.১ মিলিয়ন (২১ লক্ষ) মহিলা শুধু মাত্র ডায়াবেটিস এর কারণে মৃত্যু বরণ করেন। যেসব মহিলার ডায়াবেটিস আছে তাদের হার্ট অ্যাটাক ও এ ধরনের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি, যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের তুলনায় ১০ গুন বেশী। আর যাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস আছে তাদের গর্ভস্ত সস্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশী। প্রতি ৭ টি প্রসবের মধ্যে ১ টি মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত। এর অর্ধেকেরই বেশী ৩০ বছরের কম বয়সি প্রসূতিদের ক্ষেত্রে ঘটে। যাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে এদের অর্ধেকেরও বেশী টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হবেন, অধিকাংশ গর্ভকালীন  ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলার বসবাস অনুন্নত দেশগুলতে।
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে তো বটেই উন্নত দেশেও গর্ভবতীর ডায়াবেটিস তার নিজের ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য ব্যাপক ঝুঁকির কারণ। আর বাংলাদেশ-এর মত দেশগুলোতে উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের অন্যাতম বাধা হল জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও এর কারণে বর্ধিত মাতৃ মৃত্যু। তাই IDF- যতোটুকু উদ্যোগ নিয়েছে তার চেয়ে বহুগুন উদ্যোগ বাংলাদেশে অতি জরুরী ভিত্তিতে নেয়া উচিত।  এ বছর IDF- কিছু নির্দেশনা দিয়েছে  রাষ্টীয় চিকিৎসা সেবা ব্যাবস্থাপনার সর্বস্তরে নারীদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলাদেরও পর্যাপ্ত অত্যাবশ্বকীয় চিকিৎসা ব্যাবস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে চিকিৎসা উপাদান (ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি) ডায়াবেটিস চিকিৎসা বিষয়ক শিক্ষা এবং প্রয়োজনীয় ফলো-আপ ব্যাবস্থাপনা ।ক্স যারা ডায়াবেটিস নিয়ে সন্তান ধারন করতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য সকল পক্ষীয় (সন্তান প্রসব আকাঙ্খি নারী, সেবাদানকারী সংস্থা সমূহ এবং রাষ্টীয় চিকিৎসা কাঠামো) উদ্যোগ নিতে হবে যাতে গর্ভধারণের  আগে থেকেই গর্ভধারন ও গর্ভকালীন সময়ের জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিক ও যুগোপযুগী সিধ্যান্ত নিতে হবে।ক্স সকল বালিকা ও নারীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় শারীরিক শ্রম সম্পাদনের উৎসাহ দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ নীতিমালা ও পরিকল্পনায় নারীদের সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং প্রাক-গর্ভকালীন ও গর্ভকালীন এবং নবজাতকের ও শৈশবকালীন পুষ্টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। গর্ভকালীন সেবা আদর্শ মাত্রায় উন্নিত করার জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বিশেষকরে এতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সনাক্তকরন প্রক্রিয়া তাগিদ থাকতে হবে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সনাক্তকরন প্রক্রিয়ায় মহিলা ও প্রসুতি সেবাদানকারী সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবা দানকারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সনাক্তকরন ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে প্রেরনের শিক্ষা দিতে হবে।
সকল নারীর  গর্ভকালীন দ্রুত ডায়াবেটিস স্কিনিং, ডায়াবেটিস সংক্রান্ত শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যাবস্থাপনা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে নিশ্চিত করতে হবে।

মহিলা ও বালিকারাই আগামী দিনের সুস্বাস্থ্যময় জনগোষ্ঠী তৈরির প্রধানতম নিয়ামক । যেহেতু প্রায় ৭০ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিস যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিরোধ সম্ভব। প্রাপ্ত বয়স্কদের ৭০ শতাংশ মৃত্যু বয়ঃসন্ধি কালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জীবনযাপন সংক্রান্ত জটিলতা দ্বারা সৃষ্ট এবং নারী, মা হিসেবে এসেবে এসব রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তার ব্যাপক প্রভাব থাকবে। গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে এটি জানা গেছে যে, মা স¤পদের উপরে, খাদ্যের উপরে, শিশু বিকাশে পুষ্টির উপরে এবং তাদেরর শিক্ষার উপরে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাক্তি। অন্যভাবে বলা যায়, পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি ও জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণের প্রধান সঞ্চালক হলেন মা। সে জন্য তার (বালিকার, নারীর) সঠিক শিক্ষা ও স¤পদের সকল ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় অধিকারে মা এর কর্তৃত্ব স্থাপনের যথাযথ সুযোগ থাকতে হবে। বালিকা ও নারীর সুস্বাস্থ্য, স্বাভাবিক নীরোগ শারিরীক কাঠামো তৈরিতে উদ্যোগী হতে হবে।

“নারী ও ডায়াবেটিস, স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যত আমাদের অধিকার” এটি শুধু ডায়াবেটিস বিষয়ক কোনো চিন্তাা-ভাবনা নয়, বরং সামগ্রীক সু-স্বাস্থ্যর অধিকারী জনগোষ্ঠী তৈরীতে প্রাথমিক, ব্যাপক বিস্তারি এবং অনায়াসে পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব এমন একটি দিক নির্দেশনা।International Diabetes Fedaration (IDF) গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কে অন্য অসংক্রামক রোগগুলোর কাতারে ফেলতে নারাজ। কেননা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস গর্ভবতীকে আক্রান্ত করছে কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে গর্ভস্ত শিশুর, অর্থাৎ সরাসরি রোগটি সংক্রামক না হলেও এর সদূর প্রসারিত ক্ষতিকর প্রভাব আক্রান্ত করছে পরবর্তী প্রজন্মকে, শুধু তাই নয় এই শিশুটির ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস (টাইপ-২) হওয়ার সম্ভবনা তার সম সাময়িকদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। এটাকে মনে রেখেই স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী, বিশেষ করে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, নবজাতক ও শিশু-রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সর্বপরি রাষ্টীয় ব্যাপক উদ্যোগ আসু  কাম্য। এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসকে সামনে রেখে হলেও প্রচারে মাধ্যমগুলো (টিভি চ্যানেল, পত্রিকা) ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে পারে। সাধারন শিক্ষা ব্যাবস্থার বিভিন্ন স্তরে ডায়াবেটিস গর্ভধারন প্রক্রিয়া, গর্ভকালীন পরিচর্যা, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় বোধগম্যভাবে উপস্থাপনা করতে পারলে দীর্ঘস্থয়ী ফল পাওয়া যাবে।
ডাঃ শাহজাদা সেলিমএমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম), এফফএসিই (ইউএসএ)সহকারী অধ্যাপক এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ

কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার ১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা ফোন ঃ  ৮১২৪৯৯০, ৮১২৯৬৬৭, ০১৭৩১৯৫৬০৩৩, ০১৫৫২৪৬৮৩৭৭, ০১৯১৯০০০০২২ . Email: selimshahjada@gmail.com

আজকের বাজার : সালি / ১৫ নভেম্বর ২০১৭