বীমা প্রসঙ্গ: রি-ইন্স্যুরেন্স

রিইন্স্যুরেন্স (বা পুনঃবীমা) হল বীমা কোম্পানি কর্তৃক কোন বীমা কোম্পানির বীমা ঝুঁকি (জীবন বা সম্পত্তি) পুনরায় বীমাকৃত করা অর্থাৎ একটি বীমা কোম্পানি নিজ স্বার্থে বীমা ঝুঁকির অতিরিক্ত ঝুঁকি অন্য কোন এক বা একাধিক কোম্পানি বা বীমা কোম্পানির নিকট হন্তান্তর করে নিজের দায় সীমিত রাখার প্রক্রিয়া, বা বীমা কোম্পানি অন্য কোন বীমা কোম্পানির আংশিক বা পূর্ণ বীমাদাবির দায় সহ বীমা কিনে নেওয়া। সুতরাং কোন বীমা কোম্পানি যে সমস্ত বীমা ঝুঁকি গ্রহণ বা বহন করে থাকে তার কিছু অংশ (রিটেনশন লিমিট পর্যন্ত) নিজস্ব খাতে রেখে বাকী অংশ অন্য কোন পুনঃবীমা কোম্পানির নিকট অর্পণ বা হস্তান্তর করাকেই পুনঃবীমা বলে। যে বীমা কোম্পানি তার অতিরিক্ত বীমা ঝুঁকি হস্তান্তর করে তাকে ‘সিডিং কোম্পানি’ এবং যে কোম্পানি বা বীমা কোম্পানি ঐ বীমা ঝুঁকি গ্রহণ করে তাকে ‘রিইন্স্যুরার বা পুনঃবীমাকারী বা পুনঃবীমা কোম্পানি’ বলে। পুনঃবীমা করতে হলে সিডিং কোম্পানিকে পুনঃবীমা সেবা প্রদানকারী কোম্পানিকে পুনঃবীমা প্রিমিয়াম প্রদান করতে হয়। রিইন্স্যুরেন্স (বা পুনঃবীমা) ব্যবসা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। পুনঃবীমা বলতে এমন চুক্তিকে বুঝাবে যেখানে বীমা কোম্পানি নিজ স্বার্থে বীমাকৃত অতিরিক্ত ঝুঁকি অন্য কোন এক বা একাধিক পুনঃবীমা কোম্পানি অথবা অন্য কোন বীমা কোম্পানির নিকট হস্তান্তর করে নিজের কাছে দায় সীমিত রাখে (বীমা আইন ২০১০ এর ২ (২০) ধারা)

আমরা জানি, বীমা কোম্পানি বীমাকৃত বীমা ঝুঁকি বহন করে, কিন্তু কখনো কখনো বীমা কোম্পানি সব ঝুঁকি একা বহন করে না। বীমা কোম্পানি তার সক্ষমতার উপর ভিত্তিতে যতটুকু ঝুঁকি বহন করা সম্ভব ততটুকু ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে এবং অতিরিক্ত ঝুঁকি অন্য কোন কোম্পানি বা পুনঃবীমা কোম্পানির নিকট হস্তান্তর করে নিজের বীমা ঝুঁকি দায় সীমিত রাখতে পারে। বীমা কোম্পানি পলিসির বিপরীতে সকল গ্রাহকের বীমাদাবি কিংবা নির্দিষ্ট পলিসি হতে উদ্ভূত দায় পরিশোধে সক্ষম নাও হতে পারে কিংবা বীমাদাবির সময় নগদ বা তরল অর্থ নাও থাকতে পারে। তাই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বীমা কোম্পানি তার বীমা সমূহ অন্য বীমা কোম্পানির কাছে বিক্রয় করে দিতে পারে কিংবা বীমাদাবির দায় ও ঝুঁকি বিনিময় করতে পারে। পুনঃবীমা কোম্পানি সিডিং কোম্পানির বীমাদাবির পূর্ণ বা আংশিক অংশ প্রদান করার জন্য বীমা কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে।

পুনঃবীমা সাধারণত দুই প্রকার, ১। ঐচ্ছিক পুনঃবীমা একটি বীমা কোম্পানি তার অধীনে প্রত্যেকটি বীমা আলাদা আলাদা ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির কাছে পুনঃবীমা করার অধিকার রাখে। এভাবে বীমা কোম্পানি আলাদাভাবে প্রত্যেকটি বীমার চিহ্নিতকরণ এবং পুনঃবীমার প্রক্রিয়াকে ঐচ্ছিক পুনঃবীমা বা প্রক্রিয়াগত বীমা বলা হয়। এবং ২। চুক্তিগত পুনঃবীমা যদি কোন বীমা কোম্পানি তার অধীনে একজাতীয় প্রত্যেকটি বীমা অন্য একটি বীমা কোম্পানির কাছে পূর্ণাঙ্গভাবে পুনঃবীমা করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় তাহলে তাকে চুক্তিগত পুনঃবীমা বলা হয়।

পুনঃবীমা করার সুবিধা প্রায় প্রত্যেকটি বীমা কোম্পানিরই পুনঃবীমার প্রোগ্রাম থাকে। পুনঃবীমার উদ্দেশ্য হল বীমা কোম্পানির ঝুঁকি কমিয়ে অন্য একটি বীমা কোম্পানিতে ঝুঁকি স্থানান্তরিত বা হস্তান্তর করে নিজের কাছে দায় সীমিত রাখা। এই পুনঃবীমা প্রক্রিয়াটি একক কিংবা দলগত উভয়ভাবে করা যায়। বীমা কোম্পানি কর্তৃক পলিসির বা বীমাকৃত বীমা ঝুঁকির মধ্যে শতকরা কত অংশ পুনঃবীমা করা যাবে তা সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক নির্ধরিত হয়। পুনঃবীমার কিছু প্রক্রিয়াগত সুবিধা রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো ঝুঁকি স্থানান্তর বা হস্তান্তরবীমা কোম্পানি তার পলিসিগুলোর পুনঃবীমা করালে তার অনুমোদিত সীমার চেয়ে বেশি পলিসি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। পুনঃবীমার ফলে সম্ভাব্য ঝুঁকির কিছু অংশ পুনঃবীমা কোম্পানির কাছে স্থানান্তরিত হয়ে যায় এবং এতে করে সম্ভাব্য বীমা ঝুঁকির ক্ষতিপূরণের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অংশ পুনঃবীমা কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া যায়।

বীমা কোম্পানির ব্যবসা শুরুর প্রাক্কালে তার সম্পদ সীমিত থাকে, তথাপি বীমা কোম্পানিকে তার সীমিত সম্পদের মধ্যেও সীমাহীন ঝুঁকি বহন করতে হয়। পুনঃবীমার মাধ্যমে বীমা কোম্পানি কেবল এই সীমাহীন ঝুঁকি বহন করার সক্ষমতা অর্জন করে। বীমা কোম্পানি তার বীমা গ্রাহকের সংখ্যা, বীমা বাজারে তার ব্যবসায়িক অবস্থান বা ফান্ড যাই হোক না কেন, অধিকাংশ বীমা কোম্পানি পুনঃবীমা সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। পুনঃবীমা করার কিছু সুবিধা রয়েছে, যেমন

. পুনঃবীমা বীমা কোম্পানি তার নিজ দায় সীমিত রাখতে সহায়তা করে।

. পুনঃবীমা বীমা কোম্পানির আর্থিক ক্ষতিকে তার সামর্থ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে সহায়তা করে।

. পুনঃবীমা বীমা কোম্পানিকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি পরিচালনায় অভিজ্ঞতা অর্জনও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

. পুনঃবীমা বীমা কোম্পানিকে বীমা ব্যবসা স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে।

. পুনঃবীমা ছোট বীমা কোম্পানিকে বৃহত্তর বীমা বাজারে প্রবেশ এবং প্রতিযোগিতায় সহায়তা করে।

পুনঃবীমা ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ২০১০ সালের বীমা আইনের ৪ () ধারানুযায়ী বাংলাদেশে যেসব কোম্পানি বা সমিতিসমূহ পুনঃবীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে () ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের অধীন কোন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি; () বীমা আইন ২০১০ কার্যকর হবার অব্যবহিত পূর্বে সমবায় সমিতি আইন, ২০০১এর অধীন নিবন্ধিত যে সকল সমবায় সমিতি; () Insurance Act, 1938 এর অধীন বীমা কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত; এবং () বাংলাদেশের বাহিরে কোন দেশের আইনের অধীন সংবিধিবদ্ধ এমন কোন বীমা সংস্থা, যা কোন প্রাইভেট কোম্পানি নয় অথবা প্রাইভেট কোম্পানির সাবসিডিয়ারী নয়।

বিদেশে পুনঃবীমা সংক্রান্ত বিধানাবলী প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে কোন বীমা কোম্পানি বীমা পলিসি গ্রাহক এবং বীমা কোম্পানির স্বার্থ নিশ্চিত হয় এরূপ সম্পাদিত ও কার্যকর চুক্তি বা বীমা পলিসি হতে উদ্ভূত বাংলাদেশে বা বাংলাদেশের বাহিরে যে কোন দায় অন্য বীমা কোম্পানির সাথে পুনঃবীমা করতে পারবে। (২০১০ সালের বীমা আইনের ২০ () ধারা)

পুনঃবীমা শর্তাদি লাইফ ইন্সুরেন্স পুনঃবীমা (শর্তাদি নির্ধারণ) প্রবিধানমালা, ২০১৫ এর বিধি ৩ অনুযায়ীকোন বীমা কোম্পানিকে, বীমা আইনের ধারা ২০ এর অধীন, বীমা পলিসি গ্রাহক ও উহার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বা বীমা পলিসি হতে উদ্ভূত লাইফ ইন্স্যুরেন্সের যে কোন দায় পুনঃবীমা করার ক্ষেত্রে যে সকল শর্তাদি প্রতিপালন করতে হবে তা নিম্নরূপ, যথা:-

() পুনঃবীমা কোম্পানির সাথে পুনঃবীমার লক্ষ্যে পুনঃবীমা সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পুনঃবীমা ব্যবসা পরিচালনায় ইচ্ছুক বীমা কোম্পানির, উহার একচ্যুয়ারি/গণিতজ্ঞ কর্তৃক প্রত্যায়িত এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত, সুনির্দিষ্ট পলিসি থাকতে হবে, এবং পুনঃবীমা কোম্পানির, কোন আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সির সমপর্যায়ের রেটিং এজেন্সি কর্তৃক স্বীকৃত, অন্যূন B+ রেটিং থাকতে হবে;

() পুনঃবীমা সংক্রান্ত চুক্তির একটি অনুলিপি চুক্তি স্বাক্ষরের অনধিক ১ (এক) মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করতে হবে। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পরে চুক্তিতে কোন সংশোধন করা হলে, যথাশীঘ্র সম্ভব, উক্ত সংশোধনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে এবং সংশোধিত চুক্তির অনুলিপি কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করতে হবে;

() পুনঃবীমা সংক্রান্ত চুক্তির সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান বাৎসরিক হিসাবের সাথে কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করতে হবে;

() কর্তৃপক্ষ কর্তৃক, সময় সময়, যাচিত পুনঃবীমা সংক্রান্ত যে কোন তথ্য কর্তৃপক্ষের দাখিল করতে হবে এবং

() সম্পদ ও দায়ের ভিত্তিতে নির্ণয়কৃত ধারণ ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশে অর্জিত সর্বাধিক প্রিমিয়াম সংরক্ষণ করতে হবে।

মোঃ মাসুম বিল্লাহ্
এলএল.বি (অনার্স), এলএল.এম
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।