শুরু হলো আয়কর মেলা; লক্ষ্য ১৫ লাখ করদাতা,দেয়া হবে ইনকাম ট্যাক্স কার্ড  

কাজী লুৎফুল কবীর: আজ পহেলা নভেম্বর বুধবার থেকে দেশব্যাপী শুরু হলো জাতীয় আয়কর মেলা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মাণাধীন এনবিআর ভবনে আয়োজিত ২০১৭ এর আয়কর মেলার উদ্বোধন করেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান। ঢাকাসহ আটটি বিভাগীয় শহরে সাত দিনব্যাপী চলবে এবারের আয়কর মেলা। আটটি বিভাগীয় শহর, ৫৬টি জেলা ও ৮৭টি উপজেলাসহ সারা দেশে মোট ১৫১টি জায়গায় অনুষ্ঠিত হবে এবারের আয়কর মেলা। আয়কর সম্পর্কে নাগরিকদের ধারণা দেয়া মেলার মূল উদ্দেশ্য হলেও, এর মাধ্যমে করজাল বৃদ্ধি ও বড় অংকের রাজস্ব আহরণের চিন্তা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড,এনবিআর। এবারের মেলায় ১৫ লাখ করদাতাকে সেবা দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রথমবারের মতো ঢাকা ও চট্টগ্রামে এবার করদাতাদের এ ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড ও স্টিকার প্রদান করা হবে।

এনবিআর জানিয়েছে, আয়কর খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা ও করদাতাদের উৎসাহ যোগাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। জেলা শহরে চলবে চারদিন, ৮৭ উপজেলায় দুদিন ও ৭১ উপজেলায় একদিন (ভ্রাম্যমাণ) করে চলবে এবারের মেলা। অন্যান্যবারের মতো এবারো মেলায় করদাতাদের সব ধরনের তথ্যসেবা দেবেন কর্মকর্তারা।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে প্রায় ১১ লাখ নতুন করদাতা যুক্ত হওয়ায় এবং সর্বশেষ আয়কর মেলার সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে এবার আরো বড় পরিসরে মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গত বছরের আয়কর মেলায় দুই লাখের মতো আয়কর রিটার্ন জমা পড়ে। এবার সংখ্যাটি পাঁচ লাখে উন্নীত হবে বলে আশা করছে এনবিআর। মেলায় অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর আহরণ হবে বলে ধারনা কর্মকর্তাদের।

মেলা সম্পর্কে এনবিআর সদস্য ও আয়কর মেলার সমন্বয়ক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মেলায় রাজস্ব আহরণে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি। মেলার মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন করদাতা বৃদ্ধি ও মানুষের মধ্যে কর সচেতনতা তৈরি করা। তবে আয়কর দাতাদের সেবা দেয়ার মাধ্যমে বড় অংকের রাজস্ব আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এখন পর্যন্ত ই-টিআইএন নিবন্ধন ৩০ লাখ ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। চলতি অর্থবছর তা ৩৫ লাখে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যা মেলার মাধ্যমে অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। এবারের মেলায় আগের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশিসংখ্যক করদাতার সমাগম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

‘ট্যাক্স আইডি কার্ড-স্টিকার’ দেয়া হবে করদাতাদের

‘আমরা স্বাবলম্বী হব-সকলে কর দেব’- প্রধানমন্ত্রীর এ স্লোগানকে সামনে রেখে করদাতাদের আগ্রহ জাগাতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে এবার সব গর্বিত করদাতাকে স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে রয়েছে-প্রথমবারের মতো ‘ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড’ ও ‘করদাতা স্টিকার’ প্রদান। জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো এ ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ডধারী করদাতারা সর্বক্ষেত্রে সম্মান পাবেন। ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড ব্যবহার করে সকল করদাতারা যাতে রাষ্ট্রীয় সুবিধা পান- সে বিষয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্তও নিয়েছে এনবিআর। এছাড়া গাড়ি ব্যবহারকারীদের ‘করদাতা স্টিকার’ দেয়া হবে। গাড়িতে লাগানো এ স্টিকার করদাতাদের আলাদা সম্মান বয়ে আনবে। তারা বিশেষ সুবিধাও পাবেন।

এনবিআরের তথ্যমতে, ট্যাক্স কার্ড দিতে এরই মধ্যে ১৪১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করেছে এনবিআরের ট্যাক্স কার্ড নির্ধারণী কমিটি। ৩৫টি ক্যাটাগরিতে এ ট্যাক্সকার্ড দেয়া হবে এবার। ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের মধ্যে বিশেষ শ্রেণীতে সিনিয়র সিটিজেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, নারী ও তরুণ করদাতাদের আলাদা ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার আয় ও ব্যবসার ভিত্তিতে বেতনভোগী, ডাক্তার, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, স্থপতি, হিসাববিদ, নতুন করদাতা, খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক, সাধারণ ব্যবসায়ী ও অন্যান্যসহ মোট ৭৬টি ট্যাক্স কার্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ১৪টি খাতের প্রত্যেকটি পৃথক ট্যাক্সকার্ডসহ অন্যান্য খাত মিলে মোট ৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্স কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন এনজিও, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে আটটি পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ট্যাক্স কার্ডের জন্য করদাতাদের চূড়ান্ত তালিকা করে, তা এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে এনবিআর। তবে সংখ্যাগত জটিলতায় কর বাহাদুর পরিবারের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে এনবিআর সূত্র।

এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. নজিবুর রহমান বলেন, করদাতাদের সঙ্গে এনবিআরের কর্মকর্তাদের সম্পর্ক বাড়াতেই কর মেলার আয়োজন। গত কয়েক বছর মেলায় করদাতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এনবিআরকে উৎসাহ জুগিয়েছে। মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশে করদাতারা সব সেবা পেয়ে থাকেন। এবার মেলার পরিধি আরো বড় করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ট্যাক্স কার্ডের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো কর বাহাদুর পরিবারকে সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। যেসব পরিবারের সব সদস্য কর দিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন, তাদের এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।

ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড ও করদাতা স্টিকার প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, করদাতাদের উৎসাহ প্রদান ও দেশে একটি কর সংস্কৃতি চালুর প্রয়াসে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এরই অংশ হিসেবে এবারের মেলায় প্রথমবারের মতো করদাতাদের ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড নামে একটি স্মার্ট কার্ড ও একটি করদাতা স্টিকার প্রদান করা হবে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, প্রধানমন্ত্রী রাজস্ববান্ধব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার কথা বাজেট অধিবেশনে উল্লেখ করেছিলেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এনবিআর বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। উদ্ভবন করা হয়েছে কর বাহাদুর পরিবারের পুরস্কার।

নজিবুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আয়কর মেলায় রিটার্ন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করদাতাদের একটি আধুনিক ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড দেওয়া হবে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সারাদেশের করদাতারা এ কার্ড পাবেন। যা করদাতাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানের প্রতীক হবে। সম্মানিত করদাতারা বিভিন্ন খাতে পরিচয় দেওয়ার জন্য এ কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। করদাতারা এ কার্ডের মাধ্যমে সব জায়গায় সেবা গ্রহণে অগ্রাধিকার পাবেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রিটার্ন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করদাতাদের ট্যাক্স পেয়ার বা করদাতা লেখা সম্বলিত একটি স্টিকারও দেওয়া হবে। এ স্টিকার করদাতারা গাড়িতে, অফিসে বা বাড়িতে লাগাতে পারবেন। স্টিকারে করবর্ষ লেখা থাকবে। কর প্রদানে সকলকে উৎসাহ যোগাতেই এরকম নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে হয়রানিমুক্ত পরিবেশে কর আহরণ করা হচ্ছে। নাগরিকরা মেলা বা কর অফিসে এসে উপযুক্ত সম্মান পাবেন।

নজিবুর রহমান বলেন, করসেবা প্রদানের ফলে আয়কর মেলা সার্থক হয়। সে জন্য করমেলায় বেশি বেশি সেবা প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এবারের আয়কর মেলায় জনগণ ও করদাতাদের কাছ থেকে অনেক বেশি সাড়া পাওয়া যাবে বলেও আশা করছেন এনবিআর চেয়ারম্যান।

‘ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড’ প্রদানের দায়িত্বে থাকা কর অঞ্চল-১ ঢাকার কমিশনার কানন কুমার রায় বলেন, এ আইডি কার্ডে করদাতার নাম, করবর্ষ, ই-টিআইএন নম্বর, কর সার্কেল, কর অঞ্চল লিখা থাকবে। কার্ডে একটি কিউআর কোড থাকবে- যাতে করদাতার সব তথ্য সে কোডে লুকায়িত থাকবে। তিনি জানান, ঢাকার মেলায় অন্তত ১ লাখের বেশি করদাতাকে এ কার্ড প্রদানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মেলায় ৩০ জনের একটি টিম থাকবে কার্ড প্রদান কার্যক্রমে।

আয়কর মেলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রতিটি বুথে রিটার্ন দেওয়ার পর একটি টোকেন দেওয়া হবে। সে টোকেন নিয়ে করদাতারা কার্ড বুথ থেকে কার্ড ও স্টিকার নিতে পারবেন। সূত্র আরও জানায়, সারাদেশ থেকে এবার ৫ লাখ নতুন করদাতা সংগ্রহ করবে এনবিআর। এবার ৩৭০ জন সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী, ১৪৭ জন দীর্ঘমেয়াদী আয়কর প্রদানকারীসহ মোট ৫১৭ জনকে সম্মাননা দেয়া হবে। ৮ নভেম্বর ঢাকায় কর বাহাদুর পরিবার ও করদাতাদের ট্যাক্স কার্ড প্রদান করা হবে।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে ৩০ অক্টোবর ২০১৭