বৃষ্টি_নূপুর

-কেমন আছো মৌসুমি?
-কে?
-চিনতো পারছো না?
-তুমি!এতকাল পরে?

দুজনে চুপ
গভীর নিঃশ্বাস বলে দিলো একে অপরকে কিছু একটা।
-কেমন আছো বলবে না?
-শুনলে না?
-কখন?
-যখন নিঃশ্বাস ছড়াচ্ছিলাম বাতাসে তুমিও তো জবাবটা দিলে আমায় তোমার নিঃশ্বাসে?
-এই শোন?
-বলো?
-তোমার একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে।
-কোন জিনিস?
-তুমিই বলো?
-উউউউম আমার চুড়ি?
-বলো কী?মনে আছে তোমার?
-হুম।
-আর কী মনে আছে?
আবারও নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ মনে হচ্ছিল, এই আষাঢ় মাসে ভেজা দুপুরেও গরম হয়ে অনুভব হচ্ছিলো দুজনের কাছে।
-বলবো?
-বলো…?
-কোথায় তুমি?
-আছি শহরতলীর কোন এক প্রান্তে।
-ভীড় আছে?
-আছে তো?
-গাড়ীর শব্দ পাচ্ছি।মানুষের কন্ঠের আওয়াজও?
-হুম দেখোই না মৌসুমি,বৃষ্টিটা হয়ে আরও বাজে অবস্থা, ভ্যাপসা গরমটা দিয়ে দিলো।
-ওমা সেকী আমার এখানে তো ঝুম বৃষ্টি!
-তুমি ভিজছো?
-না, তবে এক্ষুণি ছাঁদে উঠে যেতাম আর ওমনি তুমি ফোন করলে…।
-কী পড়েছো?শাড়ী?
-হুম
-কী রঙ?
-কলাপাতা, জলপাই রঙ আর লাল পাড়।
-ওফহ্ আমি আসবো?
-আসবে?না থাক…।
-কেন?
-আসলেই তো অবাধ্য হয়ে যাও,ডানে বাঁয়ে কিছুই দেখো না।যা ইচ্ছে তাই করো…।
-আমার এই অবাধ্যতা তুমিও সমর্থন করেছো?করোনি?
-তুমি না শুনলে আমার দোষ?
-তাহলে আমার দোষ কেবল?
-ঝগড়া করবে আজকেও?
-নাহ্।
চুপ দুজন
-কী হলো কই তুমি?
-দরজা খোলো?
-ওমা সেকী?
মৌসুমী দৌঁড়ে গিয়ে ঘরের সদর দরজা খুলে দিল প্রায় সাথে সাথে,এ পাশ ওপাশ তাঁকিয়ে কাউকেই চোখে পড়লোনা।মনটা খুব অস্থির করে ওর।মোহনের মারাত্মক ঠান্ডার সমস্যা।একটু ভিজলেই সর্দি কাশি,আজকাল শ্বাসকষ্টও নাকি হচ্ছে ওর।
-মোহন… মোহন কোথায় তুমি?
ফ্ল্যাটের দারোয়ান উপরেই আসছিল,সিঁড়ি ঝাড়ু দেবার টাকা তুলছিল।
-আফা কাউরে খুঁজেন?
-হ্যাঁ একজন কবি এসেছিলেন দেখেছেন তাকে?
-হো দেখলাম তো দৌঁড়ায়া দৌঁড়ায়া উপরের দিকে গেলো আবার সাথে সাথে নাইমাও গেলো…।
-কোথায়? কখন?
-এই তো এই মাত্রই তো দেখলাম, হেরলেইগ্যাই তো আমিও উপরের দিকে উঠছি।
মৌসুমি বারান্দায় যাবার মুহুর্তে দারোয়ান বল্ল,
-আফা আপনের দরজার সামনে এইডা কী?
সাদামাটা গেরুয়া রঙের বড় খামে একটা প্যাকেট।
বৃষ্টিতে ভিজে ভেতরের একটা ভারী মোলাট দেখা যাচ্ছিলো।
প্যাকেটটা হাতে নিয়েই বুঝলো,মোহনের কাজ।
খামটা খুলেই দেখলো মাঝারি লম্বা সদৃশ একটা খাতা।এটা দেখেই বুঝে গিয়েছে কবিতার খাতা।তবে পুরো কবিতা লেখার কাজ বোধহয় শেষ হয়নি।ভেতরে একটা চিরকুট।সাথে সাথে বন্ধ করে দিলো মৌসুমি।
হেসে বল্ল,
-আরে আমারই একটা বই। (কারন কবিতার খাতা বল্লে দারোয়ান ওভাবে বুঝবেনা)
জানেন তো আমি বই পড়তে ভালোবাসি তাই দিয়ে চলে গেছে।
দারোয়ান কী বুঝলো, মৌসুমি বুঝলনা তবে সিঁড়ির টাকা পরে এসে নিয়ে যেতে বলে দরজা লাগিয়ে দিলো।
ফ্যান ছেড়ে শুকোতে দিলো খাতাটা সযতনে।
আবার ফোনটা বেজে উঠলো।
মৌসুমি যা ভাবছিল তাই হলো।
ওপাশ থেকে সমানে হাচ্চি দিয়েই চলেছে মোহন।
খুবই রেগে গেলো মৌসুমি,
-এইসব পাগলামি বন্ধ করবে কবে তুমি?
-কেন?
-কী কেন? এই অল্প সময়ের বৃষ্টিতে তাই কেমন ঠান্ডা লাগিয়েছো তুমি?ঘরেও এলে না, মাথাটা তো মুছে দিতে পারতাম আমি? তাই না?আবারো শাসন পুরনো দিনের মতো।
-পারোনি আমার কষ্ট হচ্ছে…।
-তাহলে আসলে না কেন ভেতরে?
-ইচ্ছে করেই আসিনি,এটাই শাস্তি।
-কার শাস্তি মোহন?তোমার না আমার?
-অবশ্যই আমার হলে তোমার!
পাল্টা জবাব মোহনের, রাগের শ্লেষে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো মৌসুমিকে।
– পাগলামি গেলো না তোমার?আর কত বলো?
– আমার লেখা কবিতাকে পাগলামি বলছো?
-না তা তো বলিনি?আমার বাসায় এসে ওমন করে চলে গেলে কেন? দেখা না করে?আবারও উদ্বিগ্ন হয় মৌসুমি।
-করতেই তো এসেছিলাম।তোমার বাসার পেট মোটা দারোয়ানই সব ভেস্তে দিলো।
-কী করেছে?
-কী করেনি বলো?আমার পেছন পেছন আসতে গেলো কেন? শালা মুখ ভরে জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছিলো গরুর মতো জাবর কেঁটে কেঁটে আমাকে ঢুকতে দেখলো!মনে হলো আগে দেখেনি! খুব ভালো কথা, ফলো করতে বল্ল কে তোকে?
-তুমিই বা ভয় পেলে কেন?বলে দিতে কিছু একটা?
-ভয় পাবো কেন?শোনো ওসব নিয়ে কথা বলতে ভাল্লাগছে না আমার লেখাগুলো আগে পড়ো।বানানগুলি, শব্দগুলি দেখে জানিও।
-হাহাহাহা!
-হাসছো কেন?
-একজন কবিতার পন্ডিত কিনা আমার মতো সাধারণ মানবীকে তার লেখা সমন্ধে জানাতে বলছে!
-জ্বী, জানাতে বলেছি।কারন তুমি মানবী তাই…।
-তাই?তাই কী?
-তোমাকে আজ খুবই আবেদনময়ী লাগছিলো?
-কী বল্লে? দেখেছো আমাকে?কখন?
আবারও চুপ
-ঐ যে বল্লে কলাপাতা রং এর শাড়ী…. একেবারে আমার মন ময়ূরী বেশে অনন্ত যৌবনা হয়ে এই ভরা বরষায় স্নান করতে চাইলে?
-তারপর?মুগ্ধ হয়ে কেবল শুনেই যাচ্ছে মৌসুমি।

পিনপতনের শব্দও যেন কানে বাজবে না যতটা সম্মোহন করে বলতে পারার দক্ষতা কেবল মোহন বাঁশির সুরে হয়।সে সুর কী এক মায়াবী বীণায় মন্ত্রমুগ্ধতায় বেজেই চলে আষাঢ়ের ভর দুপুরে…।

মৌসুমি আবারও চপল চঞ্চল পাখীর মতো ছটফট করে। মোহনের হেয়ালি ওর এই অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

আগামী বইমেলার জন্যে পান্ডুলিপি প্রস্তুত করছে মোহন। তাঁর প্রেয়সীকে অনুপ্রেরণা করেই লেখা প্রতিটি কথা কাব্য।

তাতে মনের সমস্ত জল রং ঢেলে সাজানো কথামালা, প্রজাপতি ডানার রং ছড়িয়ে স্বপ্ন গুলো সাজিয়ে বিছিয়ে একেকটা আর্তি,আকুলতা কখনো হাহাকার সেথায়।

মোহন আর মৌসুমির এমন বেখেয়ালি আকুলতা,পাগলামি একে অপরের জন্য প্রাণ তোলপাড় করা কথপোকথন এই শহরেরই একটা প্রেমকাহিনীর দৃশ্যপট।

তাদের আলাপচারিতায় বুকে দুরুদুরু ব্যাথা হবে,প্রাণ যায় যায় অস্থিরতায় লুকোচুরি থাকবে, তারপর ঐ দূর গগনে ক্লান্ত সূর্য যখন একটু ঝিমিয়ে হেলে পড়বে লগনে,
ঠিক তক্ষুনি কিছু একটা ঘটবে মিলনে। সেই মিলন তিথিতে বেলা অবেলার গল্প বল্লেই কী শেষ হবে?

জানালা খুলতেই প্রবল বাতাসে খোলা নোট বইয়ের কবিতা গুলোর এক একটা পংত্তি যেন প্রজ্জ্বলিত শিখার মতো মৌসুমির অন্তরটা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।আর তার সাথে ছন্দ তুলে কী সমধুর সুর ও মূর্ছনায় বৃষ্টি নূপুর যেন অবিরাম ছন্দ তোলে মেঘের গর্জনে…।সাথে বিজলীও আচমকা চমকে ওঠে খানিক সময়ে।

আবার দেখা হবার দিন ঘনিয়ে আসবে দুজনার, আবার জ্যোৎস্নার শীতল ধারায় শ্রাবন বৃষ্টিতে পেখম মেলবে দুটি মনের মোহনাতে। এই তো দিনের মঙ্গলসূচনায় কবিতার স্ফুলিঙ্গে ছেঁয়ে যায় একেকটা বাণী প্রেমময় তরঙ্গে।

হাসিনা সাঈদ মুক্তা