বৈশাখী মেলা যেন এক টুকরো গ্রাম-বাংলা

রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলছে বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) ও বাংলা একাডেমির যৌথ আয়োজনে এ মেলায় নিজেদের পণ্য নিয়ে অংশ নিয়েছেন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের  হস্ত ও কুটিরশিল্পীরা।

মেলার প্রায় শেষ দিকে এসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেলায় আসা এসব হস্ত ও কুটির শিল্প ব্যবসায়ীরা অনেকটাই হতাশ।

তাদের বক্তব্য,  বেচাকেনা তেমন একটা হচ্ছে না মেলায়।  ক্রেতার চেয়ে দর্শক সমাগম বেশি।

একাডেমি প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, বারোয়ারি মেলা বলতে যা বোঝায় তার ষোলো আনা আছে এবারের মেলায়। কুটির, হস্ত ও কারুশিল্পীদের হাতে তৈরি বাঁশ ও বেতের পণ্য,  শখের হাঁড়ি, পট চিত্র, শোলার পণ্য, পিতলের গয়না, দেশি-বিদেশি শো পিস, কাঠের শিল্প, পাটপণ্য, নকশিকাঁথা, মুখোশ, বিছানার চাদর, কুশন কভার, ল্যাম্প, শতরঞ্জি, বাঁশের বাঁশি, গয়না, রকমারি চুড়ি, পুঁতির মালা, ঝিনুকের পণ্য, জামদানি ও তাঁতের শাড়ি ইত্যাদির সমাহার এখানে। মেলার মূল আকর্ষণগুলোর মধ্যে আরো আছে নাগরদোলা,  চরকি, পুতুলনাচমেলায় আছে নানান রকমের খাদ্যসামগ্রী। মুরালি, মোয়া-মুড়ি, খই, কদমা-বাতাসা, মণ্ডা-মিঠাই, নানান রকমের আচার, ভর্তা, ঘরে তৈরি নানান রকমের খাবার স্থান পেয়েছে মেলায়।

এছাড়া মেলা মঞ্চে প্রতিদিন চলছে বাউলগান, পালাগান, জারিগানসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিবেশনা।

বাংলা একাডেমিতে ঢুকে হাতের ডান পাশে স্টলগুলোর দ্বিতীয় সারিতে ‘আবহমান বাংলা’র স্টল। স্টলটি গাইবান্ধা নূতন জীবন কমিউনিটি সোসাইটি পরিচালিত।

স্টলটির দায়িত্বে থাকা মো. বাদশাহ মিয়া অর্থসূচককে বলেন, বৈশাখী মেলায় এবারই প্রথম এসেছি। কিন্তু তেমন সাড়া পাচ্ছি না। মেলার আজ আটদিন পার হলেও তেমন বেচাকেনা নেই। ক্রেতার চেয়ে মেলায় দর্শকের সংখ্যাই বেশি।

তবে পণ্য ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভালো না হলেও বায়োস্কোপ, নাগরদোলাসহ পুতুল নাচওয়ালাদের ব্যবসা বেশ জমেছে।

এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমাতে পেরেছেন যিনি, তিনি আবদুল জলিল মণ্ডল। রাজশাহীর বাগমারা থেকে এসেছেন তিনি।

তার বায়োস্কোপ দেখতে ভিড় জমিয়েছেন নানা বয়সী মানুষ। ২০ টাকার বিনিময়ে তিনি দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, আগ্রার তাজমহল থেকে শুরু করে সৌদি আরবের মক্কা শরিফ পর্যন্ত।

এছাড়া মেলার স্টলগুলোতে মিলছে কাঠের তৈরি নানা বাদ্যযন্ত্র, মিলছে অন্দরসাজের নানা উপকরণ।

বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে একতারা, দোতারা, খঞ্জনি, ঢোল। বিভিন্ন সাইজের একতারার দাম পড়বে ১০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা, খঞ্জনি ১০০ টাকা, দোতারা ১৫০০ টাকা, ঢোল ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা।

অন্দরসাজের উপকরণের মধ্যে রয়েছে সিরামিকসের শোপিস, কার্পেট, সিকা, কাগজের ফুল ও পুতুল, শোলার তৈরি পাখি, মাটির ঘড়া, সরাচিত্র, লক্ষ্মীর ঝাঁপি, টেপা পুতুল, সৃষ্টিকর্তার নাম খোদাই করা তামার থালা ও ঘটিসহ নানা পণ্য।

সাজু ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানির উদ্যোক্তা লুতফর রহমান এনেছেন পাটের তৈরি বিভিন্ন ব্যাগ আর ওয়ালমেট।

তিনি বলেন মেলায় এসেছি পাটজাত পণ্যকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলতে। আমরা পাটপণ্যের উপর খুব গুরুত্ব দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ক্রমেই দেশের বাইরে পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। দেশের বাজারও ক্রমশ বড় হচ্ছে। সৌখিন ক্রেতাদের পাশাপাশি নিয়মিত ক্রেতাদের চোখও পাটজাত পণ্যের দিকে। সে  অনুযায়ী বেচাকেনা ভালো না হলেও মেলা পলিথিনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে।

এদিকে নজরুল মঞ্চের পেছনে আমতলায় বাঁশ ও বেতের ঝাপি, কুলা, হাতপাখাসহ নানা পণ্যের পসরা সাজিয়েছিলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ি থেকে আসা নির্মল চন্দ্র দাস ও তার পরিবার।

নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, শহরের জীবনে থাক আর না থাক, গ্রামে এসব পণ্যের চাহিদা এখনও আছে। প্লাস্টিকের পণ্য যতই আসুক, যারা ব্যবহার করে তারা ঠিকই খুঁজে নেয় এসব পণ্য। এখন সরকার যদি আমাদের দিকে একটু সুনজর দেয়, তবে আমাদের জীবিকা নির্বাহের পথ আরও সোজা হত।

মেলায় ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মামুনুর রশিদ বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাংলার এসব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবুও এমন উদ্যোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাক পরবর্তি প্রজন্মের কোটি প্রাণে।

ছেলে ইশমামকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বাবলু রহমান। তিনি বলেন, বৈশাখি মেলা আমাদের গর্ব ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্য। রাজধানীতে এমন আয়োজন আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পরবর্তি প্রজন্ম এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে।

আজকের বাজার: ডিএইচ ২১.৪.২০১৭