ব্যাংক ও নন্ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ক্ষেত্র আলাদা হওয়া দরকার

নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে লিকুইডিটি ক্রাইসিস। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে লিকুইডিটির কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিদিনের নিয়মিত বিজনেস অপারেশন করতে পারছে না। লিকুইডিটি ক্রাইসিসের কারণে এনবিএফআইগুলোকে বিজনেস অপারেশন করতে প্রচ হিমশিম খেতে হচ্ছে। কয়েকটি ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশির ভাগ ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান ডে টু ডে ব্যাংকিং লোন পরিশোধ করার চিন্তা ভাবনা করছে এবং এখাতের বিজনেসটা কিন্তু সেভাবে গ্রোথ হচ্ছে না। তাই লিকুইডিটি ক্রাইসিসটা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্যাংকের সাথে এনবিএফআইয়ের অসম প্রতিযোগিতা। ব্যাংক যেমন সেভিংস অ্যাকাউন্ট, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন এসটিডি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে। ব্যাংকগুলো

ডে টু ডে টাকা সংগ্রহ করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ব্যাংকগুলো সেভিংস অ্যাকাউন্টে চারবার টাকা উঠালে ইন্টারেস্ট দেয় না, কারেন্ট অ্যাকাউন্টে দেয় না বা এসটিডিতে খুব কম ইন্টারেস্ট দেয়। ফলে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বা খরচ কম থাকে। কিন্তু লিজিং ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ডে টু ডে বিজনেস অপারেশনের কোন সিস্টেম নাই বা কাউন্টারে ক্যাশ লেনদেনের কোন সিস্টেম নাই। এখানে শুধু এফডিআর কালেকশন, তিন মাস, ছয় মাস বা এক বছরের এফডিআর কালেকশন ছাড়া আর কোন পথ নাই। ফান্ড সংগ্রহ করার জন্য ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা লায়াবেলিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থাকে। এ বিভাগের কর্মীরা ডোর টু ডোর গিয়ে টাকা কালেকশন করে।

আরেকটা পথ আছে সেটা হলো ব্যাংকের উপর নির্ভর করা। ব্যাংকের কাছ থেকে লোন নেয়া। এক্ষেত্রে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট অনেক হাই থাকে। ফলে কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যায় বা বেশি হয়। এখনে মার্কেট প্রতিযোগিতায় লিজিং এবং ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের মধ্যে একটা বড় ধরণের পার্থক্য তৈরি হয়। যে কারণে এনবিএফআইয়ের লাভের পরিমাণ কমে যায় বা ব্যাংকের তুলনায় কম লাভ করতে পারে। এটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

এখন ব্যাংকের উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য যদি লিজিং কোম্পানিগুলোকে লং টার্ম বন্ড ইস্যু করার সুযোগ দেয়া যায় তাহলে ভাল হয়। এই বন্ড যারা কিনবে বা যারা এই বন্ড হোল্ডার হবে, এনবিআর’র মাধ্যমে এই বন্ডের ইনকামের উপর ট্যাক্স যদি ফ্রী করে দেয়া যায়, সে ক্ষেত্রে এই বন্ড সার্টিফিকেট কিনতে অনকেই আগ্রহী হবে।

আমরা ব্যাংক থেকে যে ফাইন্যান্সটা নিচ্ছি সাধারণত সর্ট টার্ম, তিন, ছয় বা এক বছরের জন্য। এই টাকাটা আমরা বিভিন্ন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীকে লং টার্মে ফাইন্যান্স করছি। এখানে কিন্তু লংটার্ম ও সর্ট টার্ম একটা মিস ম্যাচ হচ্ছে। এটা চার বছর বা পাঁচ বছর মিস ম্যাচ হচ্ছে। এটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ হচ্ছে, আমরা বিভিন্ন এফডিআর কালেকশন করছি, আমাদের লায়াবেলিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছেলে মেয়েরা ডোর টু ডোর গিয়ে কালেকশন করে আনছে। এখানে খুব বেশি প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার কারণ হচ্ছে, আমরা তো ব্যাংকের মত পর্যাপ্ত পরিমান ফান্ড পাচ্ছি না। আবার একই রকমভাবে ব্যাংকও ফান্ড কালেকশন করছে। ফলে ব্যাংকের সাথেও এই প্রতিযোগিতাটা আমাদের করতে হচ্ছে। তাই ক্লায়েন্টদেরকে ইন্টারেস্ট রেটটা বাড়িয়ে দেয়া লাগে। এতে করে আমাদের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের তো ফান্ড কালেকশন করার অনেক স্কোপ আছে। কিন্তু আমাদের তো অতো ধরণের স্কোপ নাই। সরকার থেকে ব্যাংক অনেক রকরমের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না।

এটা একটা অসম প্রতিযোগিতা চলছে। আমি ব্যাংকের কাছ থেকে ফান্ড নিচ্ছি, আবার ক্লায়েন্টের পিছনে দৌড়াচ্ছি। আবার একই ক্লায়েন্টকে ব্যাংকও লোন দিচ্ছে। এখানে একটা মিস ম্যাচ হচ্ছে। একই ক্লায়েন্টকে ব্যাংক কিন্তু আমার চেয়ে কমে ফাইন্যান্স করছে। কারণ ব্যাংকের কাছ থেকে ফান্ড নিয়ে আমাকে একটু বেশিতে ফাইন্যান্স করতে হয়। এখানে আমাদের টিকে থাকাটা খুব চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।

যদি আমরা ডে টু ডে কাউন্টার ক্যাশে অপারেশনটা করতে পারি তাহলে আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহজ হয়। আর যদি দীর্ঘ মেয়াদে বন্ড ইস্যু করা যায় এবং বন্ড হোল্ডারকে যদি ট্যাক্স ফ্রি করা যায় তাহলেও আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহজ হয়ে যাবে।

এনবিএফআইগুলোকে বাঁচানোর জন্য বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করা খুবই জরুরী। যেমন, আমিতো দশ বছর বন্ডহোল্ডারদেরকে শুধু ডেভিডেনড দিয়ে যাব এবং আমি যদি চার বা পাঁচ বছরের জন্য লং টার্ম ফাইন্যান্স করি, তাহলে তখন চার বা পাঁচ বছরের কোন মিস ম্যাচ হবে না। শেষ তিন বছরে প্রিনসিপাল রিপে করে দিব। তাহলে ব্যাংকের উপর নির্ভরতা কমে যাবে।

আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের প্রোডাক্টই, যদি ব্যাংক করে তাহলে আমি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারব না। ব্যাংকের প্রোডাক্ট আলাদা থাকবে, আমার প্রোডাক্ট আলাদা থাকবে। দুজনের প্রোডাক্ট আলাদা থাকলে প্রতিযোগিতাও থাকবে না। যে যার প্রোডাক্টে ভালো ব্যবসা করতে পারবে। যেমন ব্যাংক এলসি খোলে, আমি এলসি খুলতে পারছি না। ব্যাংক গ্যারান্টি দিচ্ছে, আমরা দিতে পারছি না। ব্যাংক বিগ বন্ড দিচ্ছে, আমরা দিতে পারছি না। আমরা হউজিং-এ লং টার্ম ফাইন্যান্স করছি, ডিফাইন থাকলে ব্যাংক এগুলো করতে পারবে না। সুতরাং ব্যাংক আর নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের প্রডাক্ট ডিফাইন করে দিতে হবে, প্রত্যেকের প্রডাক্ট আলাদা হতে হবে।

এই দেশে ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক অবদান আছে, আরও করা সম্ভব। যথাযথ সুযোগ পেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই দেশেকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। গুটি কয়েক ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান দিয়ে শুরু হয়েছিলো। বাংলাদেশে এখন ৩৫-৩৬ এনবিএফআই হয়েছে এবং এরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছা করলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রিফাইন্যান্স স্কিম এবং স্বল্প সুদে ঋণ দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এরকম ফান্ড আছে। এসএমই ফাইন্যান্স, রিফাইন্যান্স স্কিম আছে, ওরা দিচ্ছে। তারপরও ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্য ফান্ড থেকে কিছু কিছু স্কিম দিলে আমাদের অনেক সুবিধা হয়। আমদের সরকারি যে ফান্ড প্রত্যেকটা ব্যাংকই নিতে পারে, কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মাত্র চৌদ্দটা নিতে পারে। অন্যরা পারে না। যদি প্রত্যেকটা ব্যাংকই পাবলিক ফান্ড নিতে পারে, তাহলে প্রত্যেকটি ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানই কেন এই সুযোগ পাবে না? আমি মনে করি, সবাইকে এই সুবিধা দেয়া উচিৎ। ফান্ড যিনি রাখবেন, এটা তার উপরই নির্ভর করবে, কোথায় কার কাছে রাখবে কি রাখবে না। সবাই যেন সরকার থেকে ফান্ড কালেকশন করতে পারে। ব্যাংকগুলো যেমন সরকার থেকে আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও সমভাবে কিছু কিছু সুবিধা দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

ব্যাংকগুলোকে আলাদা ডিফাইন করে দিতে হবে কে কি কাজ করবে। বন্ড ইস্যুর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভেনিউ-এনবিআর’র সহায়ক সহযোগিতা করতে হবে।

এখাতের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই করা যেতে পারে। যেমন ধরুন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং ইন্সটিটিউট স্থাপন করা দরকার। কর্মীদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরী। ব্যাংকিং ডিপ্লোমার মত এনবিএফআইয়ের জন্য একটা ডিপ্লোমা কোর্সও শুরু করা উচিৎ। সরকারি সহযোগিতায় এ ধরণের প্রতিষ্ঠান শুরু করা উচিৎ।

আমদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা ওনার্স এসোশিয়েশন আছে ফিফা, এটাকে আরও শক্তিশালি করা দরকার। ফিফাকে আরও লাইম লাইটে আনতে হবে। বিএবি যেমন লাইম লাইটে এসেছে, এটাকেও লাইম লাইটে আনতে হবে। ওনাররাই মুভ করবেন সরকারি লেভেলে, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী মহলে। ওনাররা মুভ করে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নয়ন এবং বাঁচানোর জন্য অনেক অবদান রাখতে পারেন।

মো. আহসান কবীর খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
প্রাইম ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড