বয়লার বিস্ফোরণে সাত মাসে নিহত ৪৩: পরিদর্শক মাত্র ৮

মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প কারখানাগুলোতে বয়লার বিস্ফোরণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে প্রাণ- হানির সংখ্যাও বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই মারা গেছেন ৪৩ জন। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্নমান ও মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার ব্যবহারের কারণেই ঘটছে এসব দুর্ঘটনা।

কারাখানার বয়লার দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করা বয়লার অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের তিন হাজার কারখানার সাড়ে পাঁচ হাজার নিবন্ধিত বয়লার পরিদর্শনের জন্য পরিদর্শক পদে কাজ করছেন মাত্র আট জন। তাই সহসা এই সংকট উত্তরণের পথ দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। সামনের দিনগুলোতে দুর্ঘটনা আরও বাড়তে পারে বলেই তাদের ধারণা।

বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে বয়লার বিস্ফোরণের ৩৩টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ জন। আর ২০১৭ সালের প্রথমার্ধেই পাঁচটি ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন শ্রমিক। সেই হিসাবে গত সাড়ে পাঁচ বছরে নিহতের সংখ্যা ৮৪। সর্বশেষ, গত সোমবার (৩ জুলাই) গাজীপুরের কোনাবাড়ী নয়াপড়া এলাকায় মাল্টিফ্যাব লিমিটেড পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫০ জনেরও বেশি। তাদের মধ্যে কয়েকজন গুরুতর আহত হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস পৃথক দুইটি কমিটি গঠন করেছে। দায়ের করা হয়েছে মামলা।

এদিকে বিলসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে সারাদেশে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন আট জন শ্রমিক, আহত হয়েছেন ৩৫ জন। এ ছাড়া, ২০১৩ সালে বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ছয় জন, আহত ২৫ জন; ২০১৪ সালে নিহত হয়েছেন পাঁচ জন, আহত ৮১ জন; ২০১৫ সালে নিহত হয়েছেন ছয় জন, আহত ৮৩ জন এবং ২০১৬ সালে সাতটি বয়লার বিস্ফোরণে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ১৬ জন, আহত ১৩ জন। সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছরে ৩৩টি বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন মোট ৪১ জন শ্রমিক, আহত হয়েছেন ২৩৭ জন। আহতদের অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে।

বিলসের তথ্য সমন্বয়কারী ইউসুফ আলী মামুন বলেন, ‘আমরা দেশের গণমাধ্যম থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে থাকি। এসব দুর্ঘটনার নেপথ্যে বয়লারের মেয়দোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে।’ সঠিকভাবে দেখাশোনা করা হলে এমন ঘটনা কখনই ঘটত না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলোতে প্রধানত শক্তি উৎপাদনের জন্য বয়লার ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় পানিকে বাষ্পে পরিণত করার মাধ্যমে। রাইস মিল, ডায়িং মিল, পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহৃত হয় বয়লার। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর থেকে এসব বয়লারের অনুমোদন দেওয়া হয়। বয়লারের জন্য আলাদা পরিদর্শন অধিদফতরও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় তিন হাজার কারখানায় ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত বয়লারের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার। এর বাইরে অনিবন্ধিত বয়লারও রয়েছে।

অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, সাড়ে পাঁচ হাজার নিবন্ধিত বয়লারের জন্য পরিদর্শন অধিদফতরের জনবল মাত্র আট জন। এদের মধ্যে একজন প্রধান পরিদর্শক, দুই জন উপ-প্রধান পরিদর্শক এবং বাকি পাঁচ জন পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। শিল্প এলাকাগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন এই পাঁচ জন পরিদর্শক।

বয়লার পরিদর্শক শরাফত আলী বলেন, ‘আমরা এখনও পাঁচ জন পরিদর্শকই আছি। পাঁচ জন মিলেই কাজ করছি। আমরা জনবল চেয়ে অর্গানোগ্রাম তৈরি করে পাঠিয়েছি। তা এখনও প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আমরা বয়লারের পাশাপাশি অপারেটরদের সনদ দিই। কিন্তু এত বড় পরিসরে কাজ করতে যে পরিমাণ জনবল দরকার তা কখনও আমাদের ছিল না এবং এখনও নেই।’

বয়লার অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি বয়লার বছরে যদি একবারও পরীক্ষা করা হয়, তাহলেও একেকজন পরিদর্শককে বছরে এক হাজারেরও বেশি বয়লার পরীক্ষা করতে হবে। ওই পরিদর্শক বছরের প্রতিটি দিন কাজ করলেও তাকে দিনে তিনটি করে বয়লার পরীক্ষা করতে হবে। বয়লারগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় বাস্তবে এই স্বল্প জনবল দিয়ে বছরে একবারও প্রতিটি বয়লার পরীক্ষা করা সম্ভব নয়।
এই হিসাব কেবল নিবন্ধিত বয়লারের। অধিদফতরের অনুমোদনহীন বয়লারকে হিসাবে নিলে এই চিত্রটি আরও করুণ।

মেয়াদোত্তীর্ণ বয়রারের সংখ্যা ৫৯৬
বয়লার অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৫৯৬টি বয়লার মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় আছে। এসব বয়লারের ১৬১টি গাজীপুরে, ৭১টি চট্টগ্রামে, ৭১টি রাজশাহীতে, ৯৫টি ঢাকা-হবিগঞ্জ-সিলেটে, ১০৭টি নারায়ণঞ্জে।

আজকের বাজার: এএন/ডিএইচ/এলকে ৬ জুলাই ২০১৭