ভাষা আন্দোলনের ভুলে যাওয়া নায়ক মোহাম্মদ সুলতান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের(ঢাবি)যে ১১ জন ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ক্যাম্পাসে প্রথম কালো পতাকা উত্তোলন করেছিল তিনি ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান। যদিও এরপরে প্রায় সাত দশক অতিবাহিত হয়েছে, ভাষা আন্দোলনের নায়ক মোহাম্মদ সুলতান এখনও জাতীয় স্বীকৃতি পাননি। তিনি স্থানীয়ভাবে কিছু স্বীকৃতি পেয়েছেন কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছরেও একুশে পদক পাননি। ১৯২৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর পঞ্চগড় জেলার(তৎকালীন দিনাজপুর জেলা)বোদা উপজেলার মাঝগ্রামে পুলিশ অফিসার মোহাম্মদ শমসের আলী এবং গুলজাননেসার আট সন্তানের মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান পঞ্চম।

সুলতান যশোর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী সরকারি কলেজে স্নাতক ডিগ্রী, এরপর ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০০৭ সালে কয়েকজন ভাষা সৈনিকের নামে ধানমন্ডির কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়। ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কটি এখন‘ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক’নামে পরিচিত। নতুন প্রজন্মের মানুষ যখন এই সড়ক অতিক্রম করবে, তখন কৌতূহলবশত যদি এই ভাষা সৈনিক সর্ম্পকে জানতে উৎসাহী হয়, তাহলে কোথায় খুঁজে পাবে তাঁর জীবনী? পঞ্চগড়ে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় না। সারা দেশে তো বটেই স্থানীয়ভাবে তাকে চেনার জন্য তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অনেকেই রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয়ভাবে জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন এবং মোহাম্মদ সুলতানের জীবনী পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে। অনেকেই জীবনে-মরণে একুশে পদক পেয়েছেন। কিন্তু সুলতানের বেলায় এখনো তেমনটা ঘটেনি।

ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর এবং দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছরেও ভাষা সৈনিক সুলতান পাননি একুশে পদক। পাননি মরণোত্তর কোন স্বীকৃতি। দুঃখজনক হলেও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা মোহাম্মদ সুলতানের জন্ম ও মৃত্যু কোন বার্ষিকীই পঞ্চগড় তথা দেশের কোথাও পালিত হয় না। ন্যূনতম আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয় না। নীরবে চলে যায় জন্ম ও মৃত্যুর দিনটি। শুধু পারিবারিকভাবে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের ইতিহাস, কর্মময় জীবন ও ভাষা আন্দোলনসহ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করা ও মরণোত্তর একুশে পদকসহ স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন মোহাম্মদ সুলতানের উত্তরসূরী পরিবারের সদস্যরা। ২০১৩ সালে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন কৃতি সন্তান মোহাম্মদ সুলতানকে মরনোত্তর সম্মাননা দেন। তৎকালীন জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক সম্মাননা স্মারক তুলে দেন তার দুই মেয়ে সুস্মিতা সুলতানা ও চন্দনা সুলতানার হাতে।

জেলা প্রশাসন পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বোদা-মাড়েয়া সড়ক ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের নামে নামকরণ করলেও মোহাম্মদ সুলতানের স্মৃতি ধরে রাখতে ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ঘোষণা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতি বছর আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবসে সপ্তাহব্যাপী বইমেলা মোহাম্মদ সুলতানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তার ম্যুরাল এখনও নির্মাণ করা হয়নি।

মোহাম্মদ সুলতানের ভাতিজা কামরুজ্জামান রুবেল জানান,‘আমার চাচা একজন নিবেদিতপ্রাণ ভাষা সৈনিক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারিতে বই বের করতে গিয়ে জেল হাজতে গিয়েছেন। তার যে কীর্তি ও অবদান তা বর্তমান প্রজন্ম তেমন জানেন না। ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর এবং দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি কোন পদক বা স্বীকৃতি পেলেন না কষ্ট এটুকুই। তার স্মরণে একটি ম্যুরাল বা ভাস্কর্ষ স্থাপন করা উচিত। ’ শিক্ষার্থী হালিমা আক্তার সম্পা জানান,‘আমি শুধু তার নামই শুনেছি। কিন্তু বিস্তারিত জানি না। তিনি একজন ভাষা সৈনিক এবং পঞ্চগড়ের গর্ব। তার সম্পর্কে আমাদের ভালোভাবে জানা উচিত। পাঠ্যপুস্তকে তার সম্পর্কে লেখা হলে আমরা বিস্তারিত জানতে পারব।’ জেলার বোদা উপজেলার মাঝগ্রামের গৃহিনী কহিনুর বেগম জানান,‘ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সম্পর্কে ছেলে মেয়েরা কিছুই জানে না। তার সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে যদি কোন কিছু লিখা হয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে। ’

জেলার বোদা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক সমাজসেবক এমরান আল আমিন জানান, বাংলা ভাষাকে নিয়ে সব সময় ষড়যন্ত্র হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য যে কজন মানুষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল তার মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান অন্যতম। তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা গণমানুষের কাছে কিংবা নতুন প্রজন্মের কাছে মোহাম্মদ সুলতান যে ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল তিনি যে আমাদের এলাকার ও দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তা আমরা সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। এক্ষেত্রে সরকার ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের নিয়ে পাঠ্যসূচিতে রাখতে পারেন আর স্থানীয়ভাবে তার জন্ম ও মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আলোচনা সভা, বই মেলা, ম্যুরাল সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য এবং বাংলাদেশ বুক পাবলিশার্স কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, ভাষা নায়ক ১৯৮৩ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাজধানীর জুড়াইন কবরস্থানে তার স্ত্রীর সমাধিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। অসাম্প্রদায়িক, নির্লোভ, বন্ধু বৎসল, নির্মোহ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও আত্মনিবেদিত প্রাণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে দীপ্ত আপোষহীন এক বিপ্লবী ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। মৃত্যুর পরেও সুলতান বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে তার অগণিত বন্ধুদের হৃদয়ে, বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে। পদক বা স্বীকৃতি পাক আর না পাক সবার প্রিয় সুলতান ভাই বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন এ প্রত্যাশা দেশের বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষের। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান