ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ইতিহাস ও বাংলাদেশে পথচলা

শিল্প বিপ্লবের শুরু  থেকে  বিনিয়োগকারিরা নতুন নতুন ব্যবসা গ্রহণ এবং প্রাইভেট কোম্পানিতে বিকল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের সামগ্রিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি শুরু করে। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ ব্যক্তি এরকম করেই ফান্ড বিনিয়োগ করত। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে প্রাইভেট ইকুইটি কতিপয় ধনী ব্যক্তি ও পরিবারের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। আমেরিকান রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন-এআরডিসি এবং জে এইচ হুইটনি অ্যান্ড কোম্পানি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৪৬ সালে। ১৯৫৭ সালে প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এআরডিসি’র মাধ্যমে ৭০ হাজার ডলার বিনিয়োগ হয় আমেরিকান কোম্পানি ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট কর্পোরেশন-ডিইসিতে। এই ফান্ড ব্যাপক সাফল্য পায়। ১৯৬৮ সালে আইপিওতে এসে ফান্ডের আকার দাঁড়ায় ৩৫৫ মিলিয়ন ডলার। মাত্র দশ এগারো বছরে প্রায় ৫০০ গুন প্রবৃদ্ধি হয় বার্ষিক ১০১ শতাংশ হারে।

১৯৬০ এবং ৭০ দশকে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগের দৃষ্টি বা ফোকাস দেয় প্রাথমিকভাবে নতুন শুরু করতে যাওয়া এমন স্টার্টআপ কোম্পানি এবং ব্যবসায় সম্প্রসারণ করতে চায় এমন কোম্পানিগুলোর দিকে। বিশেষ করে ইলেক্টট্রিক্যাল, মেডিকেল এবং ডাটা-প্রসেসিং কোম্পানিগুলোর দিকে তারা ফোকাস দেয়। যার ফলে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এর বিনিয়োগ, প্রযুক্তি নির্ভর অর্থায়নের সমাথর্ক হয়ে উঠে।

১৯৮০ সালের দিকে প্রযুক্তি নির্ভর কোম্পানিগুলোর উন্নতির জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটাল খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। ফলে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করলো প্রযুক্তি নির্ভর কোম্পানিগুলোতে।

১৯৫৭ সালে ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট কর্পোরেশন-ডিইসি’কে কে ৭০ হাজার ডলার বিনিয়োগ দ্বারা ভেঞ্চার ক্যাপিটালে সাফল্য আসে। যা প্রায় ১১ বছর পর ১৯৬৮ সালে ৫০০ গুণ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ৩৫৫ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এছাড়াও ওয়েস্রে ক্যাপিটাল কর্পোরেশন-ডব্লিউসিসি একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এর মাধ্যমে গ্রিটিং কার্ডস প্রস্তুতকারক কোম্পানি গিবসন গ্রিটিংস কোম্পানিকে ৮০ মিলিয়ন ডলারে অধিগ্রহণ করে, যা ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি অর্থাৎ প্রকৃত অধিগ্রহণের ১৬ মাস পর ২৯০ মিলিয়ন ডলার আইপিও’র মাধ্যমে ব্যবসায় বিনিয়োগ করে।

১৯৯০ এর শেষের দিকে ছিল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলোর জন্য উত্থানের সময়। ইন্টারনেট সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও কম্পিউটার প্রযুক্তি নির্ভর কোম্পানিগুলোর ব্যবসার অতি আগ্রহের কারণে স্যান্ডহিল রোড ইন ম্যালনো পার্ক এবং সিলিকন ভ্যালি উপকৃত হয়। সেই সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রযুক্তি ও গ্রোথ কোম্পানিগুলো আইপিও-তে আসা শুরু করে। যার ফলে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলোর প্রচুর বিনিয়োগ হতে থাকে। এগুলোর মধ্যে অ্যামাজান ডটকম, আমেরিকা অনলাইন ডটকম, ই-বে, ইনটুইট, ম্যাক্রোমিডিয়া, নেটসক্যাপ, সান-মাইক্রো সিষ্টেম ও ইয়াহু উল্লেখযোগ্য।

২০০০ সালের মার্চ মাসে ‘ন্যাসড্যাক’ ক্রাশ এবং প্রযুক্তি খাতের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ইন্ডাস্ট্রির প্রাথমিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। দুই বছরের মধ্যে বেশির ভাগ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মই তাদের বিনিয়োগের বড় অংশই রাইট অফ করতে বাধ্য হয়। যার কারণে বেশির ভাগ ফান্ডের মূল্যই নিম্নমুখী হয়ে যায়। ২০০৩ সালের মাঝামাঝিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানির মূল্য ২০০১ সালের অর্ধেকে পরিণত হয়।

২০০৪-২০০৫ সালের দিকে পুনরায় ব্যবসায় অধিগ্রহণ প্রচলিত হয়ে উঠে এবং ফাইন্যান্সররা তাদের বিনিয়োগের ধরণ ও প্রকৃতি আবার পুন:স্থাপিত করায় বাজার পর্যক্ষেকরা স্তম্ভিত ও শক্্ড হয়ে যান। সে সময় ডল্লার‌্যামা ও টয়েস ইউএস ২০০৪-এ, দি হার্টজ কর্পোরেশন, মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার এবং সানগ্যার্ড ২০০৫-এ অধিগ্রহণ হয়।

ইতিহাসে প্রাইভেট ইক্যুইটি কোম্পানিগুলোর পথ চলা খুব বেশি দিনের নয়। মূলত কাঠামোগত দিক থেকে ১৯৮০ সালের দিকেই এর শুরু এবং খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এর উন্নতি সাধিত হয়। ইউএসএ-তে জন্ম লাভের পর থেকে প্রাইভেট ইকুইটি কোম্পানিগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রসার লাভ করা শুরু করে। যার মধ্যে ১৯৯০ সালে ইউরোপ, ২০০০ সালে এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকা। এই সময়ের ব্যবধানে প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্মগুলো ৬ টা থেকে শুরু করে ১০ বছরে ৫০০তে উঠে এলো, যারা কি না এক বিলিয়ন ডলার ফান্ড ব্যবস্থপনার সাথে যুক্ত থাকে।

১৮০ বিলিয়ন ডলারের কারলাইল গ্র“পের সহ প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড এম রুবেস্টিন, ইয়েলস জেফরি গার্টেন-এর সাথে আলাপচারিতায় বলেন প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্মগুলো তাদের অর্থায়ন ও বিনিয়োগের নতুন পথ খুঁজে বের করবে। বর্তমানে এই বৃহৎ গ্র“প তার সাতটি প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্ম যেমন: কারলাইল, টিপিজি, ব্ল্যাকস্টোন, কেকেআর, এ্যাপোলো, বেইন এবং অকট্রি এর মাধ্যমে ৭৫ মিলিয়ন ডলার ফান্ড ব্যবস্থপনার সাথে যুক্ত আছে। তিনি আরো বলেন, ইউএসএ-তে প্রতিষ্ঠিত এই সাতটি ফার্ম আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃতি লাভ করবে এবং তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে পরিচিতি লাভ করবে। যেমন করেছে গোল্ডম্যান স্যাক্স অথবা মরগ্যান স্ট্যানলি।

তিনি আরো বলেন, প্রগতিশীল অর্থনীতির কারণে আমেরিকা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না। চীন, ব্রাজিল, মধ্য এশিয় দেশসমূহ তাদের সরকারি সহযোগিতায় এ ধরনের ফান্ডের উদ্ভাবন করছে।

প্রাইভেট ইক্যুইটি কোম্পানিগুলো ২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সালে ৯০% বেশি বিনিয়োগ করেছে। সব মিলিয়ে ২০০৯ সালে প্রাইভেট ইক্যুইটি কোম্পানিগুলো ২২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০১০ সালের দিকে অর্ধেকের মত ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছিল উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকান কোম্পানিগুলোতে। ৩৫.৫% মার্কেট ক্যাপ নিয়ে ইউরোপ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর ১২% মার্কেট ক্যাপ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এশিয়া। আর প্রায় ৪০% মার্কেট ক্যাপ নিয়ে আমেরিকা প্রথম অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশে ২০১৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সিকুরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি’র অনুমোদিত আইনের দ্বারা অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট রুলস্্-২০১৫ গেজেট আকারে পাস হয়। যার দ্বারা বাংলাদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, প্রাইভেট ইকুইটি, ইমপ্যাক্ট ফান্ড ব্যবস্থাপনার দ্বার উন্মোচিত হয়। আইন অনুযায়ি প্রস্তাবিত ফান্ডটি একজন ফান্ড ম্যানেজারে  তত্ত্বাবধানেনে নিয়ন্ত্রিত হবে। এই ফান্ড ম্যানেজারকে অবশ্যই অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট রুলস্্-২০১৫ দ্বারা বাংলাদেশ সিকুরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি’র তালিকাভুক্ত হতে হবে।

ফান্ড ম্যানেজার ইউনিট ইস্যুর মাধ্যমে এলিজিবল ইনভেস্টরস থেকে অর্থ উত্তোলন করবে। উল্লিখিত ফান্ডের  একজন ট্রাস্টি নিয়োগ দেয়া হবে। যে কিনা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভুূমিকা পালন করবে। এই ফান্ড গঠনের উদ্দেশ্যে ট্রাস্টি বিনিয়োগকারীদের নিকট থেকে ইউনিট ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা করবে যা ট্রাষ্টি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এই ফান্ড-এর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

-ফান্ডে আকার সর্বনিম্ন ১০ কোটি হতে হবে।

-ফান্ড উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক চাঁদা দেয়ার পরিমাণ মোট ফান্ড আকারের ১০% কম হবে না।

প্রাথমিক পর্যায়ের কোম্পানিগুলোর উন্নয়নের স্বার্থে কমপক্ষে ৭৫% বিনিয়োগ হতে হবে লিস্টেড কোম্পানিগুলোতে।

ফান্ড ম্যানেজার প্রস্তাবিত ফান্ডে সর্বোচ্চ ২৫% পর্যন্ত লিস্টেড কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারবে।

প্রস্তাবিত ফান্ডে সময়কাল ৫ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত হতে পারবে।

তানিম এম শাহ্জাহান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

এ্যাথেনা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এ্যান্ড ইক্যুইটিজ লি.