মধ্যরাতের ডাকপিয়ন ও একটি ইতিহাসের শুরু

সাখাওয়াৎ লিটন:
১৯৪৭ সালের দেশভাগের মাধ্যমে অভ্যুদয় হয় ভারত ও পাকিস্তানের… তারপর সময়ের আবর্তে পকিস্তান আবার পূর্ব ও পশ্চিম এ দু’ভাগে বিভক্ত হয়। এভাবে কালের বিবর্তনে এক একটি ইতিহাসের সৃষ্টি আর এগিয়ে চলা আরো নতুন ইতিহাসের জন্মের পথে…

আমরা, যারা সেই জলন্ত সময়ের পরবর্তী প্রজন্ম, ইতিহাস জেনেছি বইয়ের পাতা উল্টে আর বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের গল্প-কাহিনী থেকে। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সত্য-মিথ্যার ভিড়ে এখন খুঁজে ফিরি আসলে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। ভবিষ্যতে আদৌ এর ব্যবচ্ছেদে পিষ্ট হয়ে আসল ইতিহাস থাকবে কি না তাও জানি না। তবে এটুকু জানি ইতিহাস সত্যকে বার বার ফিরিয়ে আনে এবং আনতে বাধ্য করে। আর তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসটা চাইলেও মুছে ফেলা যাবে না কখনও। কারণ এর মাঝেই আমরা বারবার হাতড়ে খুঁজি আমাদের অস্তিত্ব।

’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সাধারণ নির্বাচন ও ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন। তারপর ১৯৬২-র শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন, ছাত্র সমাজের সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি, ’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন আর ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলশ্রুতি ’৬৯ এর গণ আন্দোলন। আর অবশেষে ’৭০ এর নির্বাচন এবং কঠিন বাস্তবতায় শোষন আর অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। এই ইতিহাস গর্বের হলেও এখনও আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে কালক্ষেপণ করে তৈরি হলো বাঙালী নিধনের নীল নকশা, অপারেশন সার্চলাইট।

২৪ বছরের শাসন-শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ বাঙালীকে সমূলে ধ্বংস করতে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের উপর লেলিয়ে দেয়া হলো সুসজ্জিত সেনাবাহিনী। ইতিহাসের বর্বরোচিত ঘটনা ২৫ মার্চের গণহত্যা…

মাঝরাতে গ্রেফতার হবার আগে জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, বাংলার স্বাধীন মানচিত্রের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৌশলে দিয়ে গেলেন তার শেষ নির্দেশ, যুদ্ধে যাবার নির্দেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। এর পর গর্জে ওঠার আহ্বানে বেজে উঠলো ইথারের তারে একটা কণ্ঠ। মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে পাঠ করলেন ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা।
তার পর বাঙালী আর ঘরে বসে থাকতে পারে নি, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় আর কি। পাকিস্তানিদের কপালে যা ঘটার তাই ঘটলো। এই একটি ঘোষণা যেন পুরো বাংলায় আগুন লাগিয়ে দিল। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঙালী। তারপর সে যুদ্ধ চললো নয় মাস। আর এর ফলে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল নতুন একটি মানচিত্র, একটি নতুন দেশ, বাংলাদেশ।

মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রয়েছে হাজারো খণ্ড খণ্ড ইতিহাস। যার সাথে জড়িয়ে আছে সেই সময়, স্থান কিংবা আড়ালে থেকে যাওয়া অজস্র ঘটনা। তেমনই একটি ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আর তার সাথে জড়িয়ে থাকা সাইক্লোস্টাইল মেশিন।

২০১২ সালের অক্টোবরের একটি ঝলমলে দিন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার আনোয়ারা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। জানতে পারলাম স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র ছাপানোর সেই মেশিন নাকি এখানেই আছে। এ কথা শোনার পর আর বসে থাকতে পারি নি। নিজের অদৃশ্য এক দায়বদ্ধতাই আমায় টেনে নিয়ে গেল সেখানে।

স্বাধীনতার এতো বছর পরও চোখের সামনে সেই মেশিনটি দেখতে পেয়ে মূহুর্তেই যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আনমনেই কল্পনায় ভেসে ওঠে সেই জ্বালাময়ী ভাষণ “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব…” ঝাপসা চোখে কল্পনায় ভাসতে থাকে নয় মাসের রক্ত গরম করা প্রতিটা মুহুর্ত আর বাঙালীর অধিকার আদায়ের এক একটি ধারাবাহিক পটভূমি, ’৪৭ থেকে ’৭১। এক মুহুর্তেই চলে যাই অতীতে।

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আটক হবার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পৌঁছে যায় চট্টগ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে। নেতারা এই পত্রটি সারা শহরে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর জুপিটার হাউজের বাসায় সারা রাত ধরে এই সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ঘোষণাপত্রটি ছাপানো হয়। সকাল হলে ছাপানো পত্রগুলো চট্টগ্রাম শহরের আনাচে কানাচে বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করা হয়। যার চুড়ান্ত ধাপ কালুরঘাট বেতারের ভেসে আসা স্বাধীনতার ঘোষণা। যুদ্ধের পর কোন এক সময় এই ঐতিহাসিক মেশিনটির ঠাঁই হয় আনোয়ারা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে।

আজ স্বাধীনতার এতো বছর পর আমরা বুক ফুলিয়ে চলতে পারছি এদেশে। কিন্তু ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ ঐতিহাসিক এই নিদর্শনের অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জা পেলাম। ভাবলাম আসলে আমরাই পারি এমন যত্নের সাথে একটা জলজ্যান্ত স্মারককে নষ্ট করে ফেলতে। জং ধরা এই সাক্লোস্টাইল মেশিনটি বর্তমানে অ্যান্টিক হিসেবেই ইতিহাসের ভার বয়ে যাচ্ছে। শুরুর দিকে কলেজের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার হলেও এখন তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ক্ষয়ে গেছে এর অংশ বিশেষ। অথচ এই মেশিনের মাধ্যমেই আমাদের অস্তিত্বের প্রথম প্রহর রচিত হয়েছিল। এর এক একটা অক্ষরের সাথে মিশে আছে আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদের তাজা প্রাণের প্রতিচ্ছবি। যার পরিণাম একটি স্বাধীন দেশ, পুরো একটা মানচিত্র বললেও ভুল হবে না। কিন্তু আমরা কি পারছি এর সঠিক মূল্যায়ন করতে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই দলিল এখন লাল কাপড়ের ঢাকা পরে থেকে দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। চার দশকের ব্যবধানে আমরা ভুলে যাই ’৫২ কি…? বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের অর্থ খুঁজতে এখন আমাদের বইয়ের পাতা উল্টাতে হয়। আর আমরা যারা গণমাধ্যম কর্মী, সুযোগ পেয়ে এই ঐতিহাসিক দলিলটিকে ২৫ ফ্রেমে বন্দী করে নিয়ে আসি এক্সক্লুসিভ একটি প্রতিবেদনের আশায়। আর পান্ডুলিপির শেষ লাইনে নির্লজ্জের মতো “সকলের দাবী এই অমূল্য সম্পদকে ভবিষ্যতের জন্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন” এই বলেই আমাদের দায় সারি।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭