মর্জিনা, জীবনযুদ্ধে বিজয়ী এক নারীর নাম

পরিবারের অভাব অনটন ঘোচাতে প্রিয় সন্তান আর সংসার ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর প্রবাসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে। ভিনদেশি ভাষা আর ভিনদেশি সংস্কৃতির বেড়াজালে বেমানান হলেও শুধু আর্থিক দৈন্যতা তাকে এমন দুঃসাহসী কাজে উৎসাহিত করেছিল। কিন্তু বিধিবাম। প্রতিশ্রুত কাজ জোটেনি ভাগ্যে, বরং জুটেছে নির্যাতন আর লাঞ্ছনা। কিন্তু ফেরার পথও ছিল বন্ধ। কোথায় পাবে এতোগুলো টাকা, ফিরে এসেই বা সন্তানের মুখে কি দেবেন সকাল সন্ধ্যা? নতুন করে যুদ্ধ শুরু, যার নাম জীবন যুদ্ধ। কতবার পরাজয়, তবু উঠে দাঁড়ানো। অবশেষে উঠেই দাঁড়িয়েছেন মর্জিনা বেগম।

যশোরের মনিরামপূর উপজেলার মহনপূর গ্রামে তার বাড়ি। পরিবারের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ভালো কাজ আর সচ্ছলতার আশায় ২০১০ সালে পাড়ি জমান স্বপ্নের দেশ সৌদি আরবে। কিন্তু ভাগ্য তার পক্ষে ছিল না। কোম্পানির চাকরি পাওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কাজ জোটে বাসাবাড়ির কাজ। কিন্তু খারাপ মানুষ যে পৃথিবী সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তা জানত না মর্জিনা। এক বছর একটি বাসায় কাজ করে মাত্র তিন মাসের বেতন দেওয়া হয় তাকে। সাথে মিলত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন।

কিন্তু ফেরার পথও খোলা ছিল না মর্জিনার। সিদ্ধান্ত নিলেন অন্য কোথাও কাজ করবেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের পাশে বাংলাদেশি প্রবাসী একটি বাসায় আশ্রয় গ্রহণ নেন। পরে ওই বাড়ির লোকজন পাশের একটি হাসপাতালে ক্লিনারের চাকরি দেন মর্জিনাকে। সেখানেও ছয় মাস চাকরি করে দুই মাসের বেতন পান মর্জিনা। আবারো প্রতারণার শিকার হলেন তিনি। বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন।

এবার নতুন করে জীবন যুদ্ধ শুরু। জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের পাশে অনেককে পানি বিক্রি করতে দেখে তার মনেও কৌতূহল জাগে নতুন কিছু করার। সেখানে যে বাসায় থাকত সে বাসার গৃহকত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন পশরা বসিয়ে পান ও পানি বিক্রয়ের। কিন্তু কোথায় পাবে পুঁজি।

অবশেষে সেই বাঙালি প্রবাসী পরিবারটি তার সহায় হয়। তারা মর্জিনাকে ১শ রিয়েল সাহায্য করেন। সেই অর্থ বিনিয়োগ করে মর্জিনা জেদ্দা কনস্যুলেটের পাশে একটি চায়ের দোকানের সামনে ছোট্ট একটা পানের পশরা দেন ২০১৩ সালে। এখন পর্যন্ত সেই পানের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তবে পুলিশি ঝামেলা রয়েছে সেখানেও। মাঝে মাঝে পুলিশ চেক করতে আসলে দোকান থেকে পালিয়ে যান মর্জিনা। পুলিশ চলে গেলে পুনরায় বেচা কেনা শুরু করেন। এভাবেই নিজেকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল মর্জিনা।

ইতোমধ্যে মর্জিনার ইকামা (কাজের ভিসা) শেষ হয়ে যায়। কিছুদিন লুকিয়ে রাখেন নিজেকে। পরে ২০১৩ সালে সৌদি সরকার অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিলে সেই সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি। আবারো বৈধতা পান মর্জিনা।

এতো সংগ্রামের পর মর্জিনা গর্ব করে বলতেই পারেন ‘কে বলে মেয়েরা পারেনা তা আমি করে দেখিয়েছি। এই পানের ব্যবসা করে ৪৫ হাজার রিয়াল বিনিময়ে ভিসা বানিয়েছি। এই পানের ব্যবসা করে আমি সফলতা অর্জন করেছি।’

জীবন যুদ্ধের কিছু কাহিনী এভাবে বর্ণনা করলেন মর্জিনা, ‘‘ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার কারণে তিন বছর ধরে সৌদিতে অবৈধ ছিলাম। আমার কাছে ছিল না কোনো পাসপোর্ট, ছিলনা ইকামা। তারপরও, ১৫০ রিয়াল (প্রায় তিন হাজার টাকা) আয় হতো প্রতিদিন।’

‘কনস্যুলেট খোলা থাকলে বেচাকেনা হয় বেশি। শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় ব্যবসা থাকে না, আমিও আর বসি না, এভাবে তার মাসিক আয় ৯০ হাজার থেকে ৯৫ হাজার টাকা ছিল।’

বর্তমানে কেমন বেচাকেন হয়?এমন প্রশ্নের উত্তরে মর্জিনা বলেন, ‘‘আগে অনেক ছিল কিন্তু এখন আর সেই রকম নেই। তারপরও মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়।’’

যেহেতু পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। তাই শুধু পান বিক্রিতে থেমে থাকেননি মর্জিনা। পান বিক্রির পাশাপাশি দুইটা বাংলাদেশি প্রবাসীর বাড়িতে কাজ করেন।

‘‘সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটা, কোনো কোনো সময় একটা বাজে চলে যাই। আর এর পাশাপাশি আমি দুইটি বাংলাদেশি ফ্যামিলিতে কাজ করি। সেই খানেও মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করি।’’

‘‘আমি এই পানের ব্যবসা করে সফলতা অর্জন করেছি, বাড়িতে জমি কিনেছি, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছি। পাশাপাশি মসজিদ মাদ্রাসা ও এতিম খানায় প্রতিবছর দান করি। আমার বড় মেয়ে কলেজে পড়ে আর ছেলে এইবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। আলহামদুলিল্লাহ আমি এখন দারিদ্র্যতাকে হার মানিয় নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি।’’

তবে আর কতদিন বিদেশ বিভূঁইয়ে? মর্জিনার উত্তর ‘‘এভাবে আরো কিছুদিন ব্যবসা করে দেশে ফিরতে চাই। মাত্র ১শ রিয়েল পুঁজি দিয়ে শুরু করা এই পানের ব্যবসা এখন অনেক লাভজনক। আর এই লাভজনক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরতে চাই না এখনই। পরিবার আর নিজের ভবিষ্যতের জন্য আরো ভালো কিছু করতে চাই।’’

সূত্র:দিপ্রবাসী

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭