মালিবাগ-মৌচাকে ‘ফ্লাইওভার যন্ত্রণার’ শেষ কবে

আউয়াল খাঁন
বৃষ্টিতে পথচারীদের ভোগান্তির কথা সবারই জানা। তবে নগরীর অন্য যে এলাকাতে যেমন ভোগান্তিই থাকুক না কেন, মালিবাগ, শান্তিনগর ও মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় যে ভোগান্তি হয়, তার সঙ্গে কোনো তুলনাই নেই। কী হেঁটে, কী গাড়িতে-বৃষ্টি হলে এই সড়ক ধরে চলা এক যন্ত্রণার নাম।

মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ হচ্ছে বলে এই সড়কটি গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ভাঙাচোরা। মূল সড়কটি সারা বছর ড্রেনের পানিতে তলিয়ে থাকে। আর বৃষ্টির মৌসুমে সেই জমে থাকা পানির পরিমাণ হয় হাঁটু সমান। একই সাথে ফুটপাত রয়েছে হকারদের দখলে।
‘ওই দাঁড়ায় রইসেন কে, সাইড দেন’। হাঁটার জন্য যতটুকু জায়গার রয়েছে তার কোথাও কোথাও ময়লার ভাগার অথবা ড্রেনের ভাঙা অংশ থেকে নির্গত নোংরা পানি। সাথে বহুতল ভবনের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ফুটপাতের রাস্তা দখল করার বিষয়টি তো আছেই।

তারপরও যারা ফুটপাতে কিছু সময়ের জন্য দাঁড়ান, আর এমন সময় মূল সড়কটি ধরে কোন পরিবহন যায়, ঠিক তখনই সড়কে জমে থাকা বৃষ্টিতে টইটুম্বুর পানির স্রোত ফুটপাতে উঠে গিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে।

যানজট নিরসনে মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ ও রামপুরা এলাকায় ২০১৩ সালে শুরু হয় উড়াল সেতুর নির্মাণকাজ। আর তিন বছরের মাথায় সাতরাস্তা থেকে রমনার হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত অংশ পরিবহন চলচলে খুলে দেয়া হয়। মোট আট দশমিক ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই উড়াল সড়কটির একটি অংশ বাংলামোটর থেকে মৌচাক হয়ে শান্তিনগর এবং মৌচাক হয়ে রামপুরার দিকে যাবে আরেকটি অংশ।
২০১৫ সালের মধ্যে গোটা উড়াল সড়কের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও বারবার নকশা পরিবর্তনসহ নানা জটিলতায় কাজ এগিয়ে নিতে বিলম্ব হচ্ছে।

মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই শান্তিনগর থেকে মৌচাক হয়ে মালিবাগ রেলগেটের ডিআইটি রোড পর্যন্ত সড়কটি মেরামত করা হয়নি। মাঝে মধ্যে সামন্য কিছু পাথর রাস্তার গর্তগুলোতে ফেলা হয়। কিন্তু ভারী যান চলাচলের কারণে একটা সময় সেই পাথরগুলো ভেঙে গুড়ো হয়ে ড্রেন থেকে নির্গত পানির সঙ্গে মিশে কাদায় পরিণত হয়।

এই সড়কটিতে এমন ভোগান্তি নিয়ে কত হাজার লাইন লেখা হয়েছে, ও সড়ক মেরামতে কতবার ফ্লাইওভার নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারকে তাগাদা দেয়া হয়েছে, সেটি গুনে বের করা কঠিন। কিন্তু নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের যেন কোনো হুঁশই নেই।

সম্প্রতি রাজধানীতে এক বৈঠকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বলেছেন, মগবাজার ফ্লাইওভারে হচ্ছেটা কী। আগামী নির্বাচনে এই ধরনের ভোগান্তির প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কায় তিনি।

সড়কের পাশে দোকানগুলো বিষয়টি নিয়ে আছে বিড়ম্বনায়। ইদানীং নগরীর অন্যান্য অংশে ফুটপাতে মোটরসাইকেল আরোহীদের তেমন একটা দেখা না গেলেও, পানি ও রাস্তার ভাঙার ঝাঁকুনি এড়িয়ে যেতে মৌচাক, শান্তিনগর, মালিবাগ কিংবা ডিআইটি এলাকার ফুটপাতে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিচ্ছে চালকরা। বাংলা বছরের গণনায় আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসে টানা বৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেনো ষড়-ঋতুর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেল দেশ থেকে। এইতো গেল মাঘ মাসে তীব্র শীতের কোন দেখা মিলেনি, তাই ‘বাঘ মামাকেও শীতে কাঁপতে হয়নি’। চৈত্র মাসের পর বৈশাখ আসার সাথে সাথেই বর্ষার বৃষ্টি ঝড়তে শুরু করল দেশ জুড়ে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার গ্রামাঞ্চলের কৃষি জমি ও হাওড় পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

শুধু গ্রাম নয়, সময়ের আগেই রাজধানীর সড়কগুলোতে হানা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বেশ কিছু রাস্তার ড্রেনেজ সিস্টেমের সংস্কার এখনো অসমাপ্ত। তার উপর সেই সড়কগুলো যদি হয় মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচের সড়কটি তবে তো কথাই নেই। পরিবহন চলাচলের ব্যস্ত সড়কগুলোতে হাঁটু সমান দেখতে দেখতে এই কয়েকদিনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এই পথের পথচারী ও যাত্রীরা।
‘স্কুলে যাব, সেই কখন থেকে বৃষ্টি পড়তাসে, তার উপর কোন গাড়িতে উঠতে পারছি না। রাস্তায় হাঁটু সমান পানি, যদি গাড়িতে উঠতে চাই তাইলে ইউনিফর্ম নষ্ট হবে। রাস্তায় এতো ভাঙা রিক্সায় যেতেও ভয় লাগে, যদি পড়ে যাই’ বলছিল স্কুলগামী নিশু সুলতানা।

আরিফ আহমেদ, সুলাইমান আজিজসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, বৃষ্টির সময় এই রাস্তাটায় আটকে যেতে হয় তাদের। একজন বলেন, ‘ফুটপাতেও দাঁড়াতে পারি না হকারদের জন্য, আবার ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামলেও হাঁটু সমান পানিতে হাঁটতে হয়। আমাদের জন্য একটু হাঁটার রাস্তাও নাই।’

‘বাজান লেহাপড়া শিহি নাই, পেডের টানে রিসকা চালাই। একঘন্টা রিসকা চালাইয়া যদদুর না হরান (ক্লান্ত) অই, এই রাস্তায় (শান্তিনগর) যাত্রি নিয়া রিসকাডা হাত দিয়া টাইনা হের থেইকাও বেশি হরান অই’। বৃষ্টিতে কাক ভেজা রিকশাচলক আবুল হাসেম হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বললেন।

হাঁটু পানি জমে থাক শান্তিনগরের ভাঙা সড়কটিতে হয়তো রিকশা টানাতে চাচ্ছেন না। তাই বৃষ্টির পানিতে তলিয়া যাওয়া ভাঙা সড়কে যাত্রীসহ প্রায় ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে ফিরতি পথেই চলে গেলেন রিকশা চালক আসলাম সিকদার।

মালিবাগ রেলগেইট থেকে রামপুরা যেতে ডিআইটি রোড পর্যন্ত ভাঙা সড়কে প্রচ- ঝাঁকুনিতে চলছে পরিবহন। বিভিন্ন গাড়ির ইঞ্জিনও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যখন তখন। একই চিত্র মৌচাক থেকে শান্তিনগর সড়কে। তিন ও দুই চাকার গাড়িগুলোই এই সড়কে বেশি ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এদিকে মোটর সাইকেলগুলোও ভাঙা রাস্তা এড়িয়ে যেতে ফুটপাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে।

উড়াল সেতুর নির্মাণকাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা ড্রেনেজ সিস্টেমের কাজের জন্য একের পর এক খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। তবে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষে সড়টির সঠিক মেরামত আর করা হয়নি। মেরামত না করায় এই ব্যস্ত ভাঙা সড়টি ধরে ভারী যানবাহন চলাচলের ফলে আরো ভাঙতে থাকে। মগবাজারের নিউ সার্কুলার রোড ও মালিবাগের ডিআইটি রোড থেকে মৌচাক-মালিবাগ ও শান্তিনগর সড়কটিতে এখন বড়সড় গর্ত তৈরি হয়েছে। ভাঙা সড়কে প্রচ- ঝাঁকুনিতে হেলে দুলে চলছে গাড়িগুলো।

পথচারীরা জানান, সড়কগুলোতে একই জায়গায় বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। আবার সেটি ভরাটও করা হয়। এই কাজে সরকারি বাজেট নষ্ট হচ্ছে। অথচ সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে মৌচাক ও সংলগ্ন সড়কগুলো অন্তত ভাঙা অংশগুলো মেরামত করে দেয়া যেত। তাহলে সাধারণ মানুষ শুষ্ক বা বর্ষা মৌসুমে ভোগান্তিতে পড়ত না।

বলাকা পরিবহনের একজন চালক বলেন, এমনিতেই গত চাইর-পাঁচ বছর ধইরা এই ভাঙা রাস্তা দিয়া গাড়ি চালাইয়া গাড়ির অনেক মেশিন নষ্ট হইসে। আর এহন বৃষ্টিতে যেই পানি জইমা আসে গাড়ি আর কয়দিন টিকব কইতে পারি না। গাতায় (গর্ত) চাকা পড়লে ঝাক্কি লাগে আবার মাজে মইধ্যে ইঞ্জিন বন্ধ হইয়া যায়। তাই গাড়ি আস্তে টানি, তয় মাজে মইধ্যে বড় গাতায় গাড়ি আটকায় যায়।

মালিবাগ ডিআইটি সড়কের ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেয়া এক চালক বলেন, ‘রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। এই পানির নিচে বড় বড় গর্ত আছে দেখা যায় না। এর আগে কয়েকবার হুন্ডা নিয়া পইরা গেসিলাম। তাই বাধ্য হইয়া এই ভাঙা অংশটায় ফুটপাত দিয়া পার হই।’

আজকের বাজার: আরআর/ ১৬ আগস্ট ২০১৭