মিরসরাইয়ে বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চল, চাকরি হবে পাঁচ লাখ

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে নির্মিতব্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল-বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী দুই বছরে এখানে ৩৫০টি কলকারখানায় ৫৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আশা করছে সরকার। আর কারখানাগুলো দুই বছরের মধ্যে চালু হবে এবং সেখানে পাঁচ লাখ নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।

মিরসরাইয়ের সংসদ সদস্য গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এই চাকরির ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দেয়ার দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জানান, সব অর্থনৈতিক অঞ্চলেই চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে স্থানীয়রা।

বিনিয়োগ আকর্ষণে বুধবার ২৪ জানুয়ারি রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বেপজার ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টর সামিট’ উদ্বোধনের আগে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বেপজার এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করেন।

মিরসরাই থেকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল-বেজার জন্য অধিগ্রহণ করা ৩০ হাজার ৭৯ একর জমির মধ্যে বেপজাকে ১১৫০ একর জমি দেয়া হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে এই জমিতে শিল্প স্থাপন হবে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘উন্নয়নের মাইলফলক চট্টগ্রামে রচনা করায়, চট্টগ্রামের সকল মানুষের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

সেখানে উপস্থিত গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘আমার আর কোনো কিছু দাবি নেই। আমার একটাই দাবি, শুধু আমার অঞ্চলের বেকার যুবকদের যেন কর্মসংস্থান হয় এখানে।’

পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাইছি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে, সাথে সাথে অর্থনৈতিক অগ্রগতি যেন হয়, সে লক্ষ্য সাধন করতে। আর সে কারণেই আজকে এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি সমস্ত এলাকাভিত্তিক।’

এরপর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দাঁড়িয়েই মিরসরাইয়ে বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চলের ফলক উন্মোচন করেন।

এ সময় গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, আমার চাকরিটা কই গেল, আমার চাকরি?

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবশ্যই চাকরি হবে। আমরা সমগ্র বাংলাদেশে ১০০টা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি, তার অর্থ হলো, প্রত্যেকটা এলাকায় যে অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, সে এলাকার ছেলে মেয়েরা অগ্রাধিকার পাবে।’

‘এ ছাড়া অঞ্চল বিশেষে যেসব পণ্য উৎপাদিত হবে, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তারও একটা সুযোগ ‍সৃষ্টি হবে।’

‘আমাদের কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। যত্রতত্র যেন শিল্প গড়ে না উঠে। এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, এটা আমাদের কৃষিজমির জন্য ক্ষতিকর।’

মিরসরাইয়ে যে জায়গায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, সেটি ছিল একটি চর এলাকা। মোশাররফ হোসেনই এই জমিটির কথা জানিয়েছিলেন প্রধানমনন্ত্রীকে। আর এ জন্য শেখ হাসিনা তাকে ধন্যবাদ জানান।

‘এটা এমন সুন্দর একটা জায়গা হবে, চট্টগ্রামের পুরো চেহারাটাই পাল্টে যাবে’। এরপর অনুষ্ঠানে বেপজার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়।

রপ্তানি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেপজার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। জানান, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালে বেপজায় বিনিয়োগ দ্বিগুণের বেশি এবং রপ্তানি আয় আড়াই গুণ বেড়েছে।

শেখ হাসিনা জানান, ইপিজেডে মোট ৪৬৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ায় ৫ লাখ মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং এদের ৬৪ শতাংশই নারী। আর গত ৯ বছরেই হয়েছে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৬২০টি নতুন চাকরি।

বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করা লাভবান হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা চট্টগ্রাম পোর্টের খুব কাছে, কাজেই এখান থেকে রপ্তানি করাও যেমন সুবিধা।’

‘আবার চট্টগ্রাম-ঢাকা যোগাযোগ ব্যবস্থাও এখন উন্নত হচ্ছে। সমস্ত বাংলাদেশেই আমরা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছি, যাতে পণ্য বাজারজাত করাও সহজ হবে।’

পরে প্রধানমন্ত্রী বেপজা ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টর সামিট উদ্বোধন করেন। এরপর তিনি সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশে বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। তিনি বিভিন্ন পণ্য হাতে নিয়ে দেখেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে তার সঙ্গে ছবিও তোলেন একটি প্রদর্শনী কেন্দ্রের একজন নারী।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান এ সময় বক্তব্য দেন।

অন্যদিকে মিরসরাইয়ে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ার‌ম্যান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা, ব্যবসায়ীরা।

বিনিয়োগের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা বাংলাদেশ

বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন শেষে বেপজার ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টর সামিট’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী।

চীন, জাপান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ৩৮টি দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদন করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের জন্য সরকার সব ধরনের সুযোগ ‍সুবিধা ‍সৃষ্টি করছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশ মূলধন ও মুনাফা প্রত্যাবাসন, ট্যাক্স হলি যে প্রদানসহ সমস্ত সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। …আমাদের রয়েছে তুলনামূলক, সস্তায় দক্ষ জনবল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত সমস্যারও আমরা সমাধান করছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু আমরা শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলছি আর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি, কাজেই সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। সেই কথা মাথায় রেখেই নতুন নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প আমরা পাস করে দিয়েছি। এখানেও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।’

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ১৬ হাজার ৪৫ মেগাওয়াট জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন আরও বাড়াতে কয়লাভিত্তিক ও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট আমদানি হচ্ছে, আরও ২০০ মেগাওয়াট আমদানির জন্য আলোচনা চলছে। ভুটান ও নেপালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেটাও দেশে আনার জন্য আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশে শিল্প করলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাজার ধরা যাবে বলেও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘নেপাল, ভারত, ভুটান, বাংলাদেশের মধ্যে আমরা চুক্তি সাক্ষর করেছি যোগাযোগ উন্মুক্ত করার জন্য। এখানেও আমরা যে কোনো পণ্য রপ্তানি বা আমদানি যেন হতে সহজভাবে হতে পারে, সে ব্যবস্থাও হচ্ছে।’

‘পাশাপাশি মিয়ানমার, চীন, ভারত এবং বাংলাদেশ মিলেও আমরা বিশেষ অঞ্চল গড়ে তুলছি পাশাপাশি এশিয়ান হাইওয়ে, এশিয়ান রেলওয়েতে বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে। সেই দিক থেকেও বাংলাদেশ একটা চমৎকার জায়গা, বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা যেখান থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য-সব জায়গায় যোগাযোগ করা যাবে এবং পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করা যাবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা বিনিয়োগ করতে চান, এত চমৎকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ পৃথিবীর আর কোনো দেশ দিতে পারবে না। আপনারা আসুন, বিনিয়োগ করুন, দেশি-বিদেশি সবাইকে আমরা সুযোগটা দিতে চাই।’

আজকের বাজার: এলকে/২৪ জানুয়ারি ২০১৮