যেই ছেলেটি চোখে আঁকেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে সবার নজরে আসে হাতে আঁকা একটি চোখের ছবি। ছবিটিতে চোখের সূক্ষ্ম শিরাগুলোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ছবিটির স্রষ্টা খুঁজতে গিয়ে জানা যায় তিনি রাহুল সরকার। পড়ছেন চট্টগ্রামের পোর্টসিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগে।

শুরুটা ক্রিকেট মাঠে:
ছোটোবেলায় গ্রামের ক্রিকেট মাঠে কেউ রাহুলকে চাইতেন না। কারণ একটাই সুযোগ পেলেই খেলার মাঠে আঁকাআঁকি শুরু করেন। মাঠেই আঁকেন দলের সদস্যদের ছবি। এতে মাঠে নিজেকে অমনোযোগী আবিষ্কার করেন রাহুল। তার এসব কার্যকালাপের কারণে অ্যাম্পিয়ার নো বল কল করতেন! ফলে অন্যরা রেগে গিয়ে তাকে দলে নিতে চাইতেন না। আঁকাআঁকিটার শুরুটা সেই খেলার মাঠ থেকেই। ধীরে ধীরে চারপাশের প্রকৃতি আর প্রিয় মাতৃভূমির সৌন্দর্য মুগ্ধ করে রাহুলকে। তাই রাহুল চিন্তা করেন, আঁকাআঁকি যেহেতু এক-আধটু পারিই, তাহলে প্রিয় দেশটার সৌন্দর্য আর ইতিহাস ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা গেলে কেমন হয়!’ যেই ভাবা সেই কাজ, নেমে পড়লেন দেশের সৌন্দর্য আর ইতিহাস ক্যানভাস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায়। এভাবে ছবি আঁকাটা পরিণত হয় তার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে।

চলার পথে যত বাঁধা:

মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসাটা আরো বেড়ে যায়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বলতে গেলে ছবি আঁকা নিয়ে রাত-দিন কাটিয়েছেন। এতে পড়ালেখারও কিছুটা ক্ষতি হলো তার। জেএসসিতে মিস করলেন জিপিএ-৫। তবে তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু মা-বাবা আর শিক্ষকরা রেগে গেলেন, নবম-দশম শ্রেণির দুই বছরের ছবি আঁকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিলেন তার জন্য। এতে কষ্ট হলেও বাধ্য হয়ে পড়ায় মন দিতে হয় তাকে। তাছাড়া ছবি আঁকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতেও ঝামেলায় পড়তে হয়েছে তাকে। কারণ ছবি আঁকার বিভিন্ন রং ও অন্যান্য সামগ্রী কিনতে হতো টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কিংবা টিউশান করে। তবে এখন আর সে সমস্যা নেই খুব-একটা। ওদিকে এসএসসির পরপরই আবারও নেমে পড়েন কাজে। এসএসসি শেষ করে শহরে এসে জানতে পারেন শিল্পকলা একাডেমির কথা। অঙ্কন বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ পান শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানে সুযোগ পান হাতে-কলমে শেখার। আবারও ছবি আঁকা শুরু করেন নতুন উদ্যমে। আর তার পথচলার পুরো সময়টাতে ছিলো মায়ের সমর্থন।

চোখে আমার যুদ্ধ ভাসে:

ছোটো থেকেই রাহুলের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা যেন প্রিয় দেশ আর দেশের গৌরবময় ইতিহাসকে ঘিরে। তার মতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস জানার পর আমাদের চোখেও যুদ্ধ ভাসে। আমরা কল্পনার চোখ দিয়ে দেখি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় প্রতিটি ঘটনা। এই চিন্তা থেকেই এঁকে ফেললেন ‘চোখে আমার যুদ্ধ ভাসে’ ছবিটি। এই ছবিটি মূলত একটি চোখের। প্রথম দেখায় এটি একটি চোখের ছবি মনে হলেও রাহুল চোখের সূক্ষ্ম শিরাগুলোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাম থেকে প্রথমে দেখা যাবে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন, এর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, সর্বডানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিবাহিনীর বিজয়োৎসব এবং পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ। এই ছবিটি প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালিকায় স্থান পেয়েছিলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী হয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। মোটামুটি সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। রাহুলের আঁকা ছবিটির প্রশংসা করেছেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নুরুল আনোয়ার। এছাড়াও পোর্টসিটি ইন্টার্নেশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী কে এম এনামুল হক শামীম রাহুলের আঁকা ছবিটি নিজের অফিসে টাঙিয়ে রাখবেন বলে জানিয়েছেন।

মাটি দিয়েও শিল্পকর্ম তৈরি করেন রাহুল:

রাহুল শুধু ছবি আঁকেন তা নয়, মাটি দিয়ে তৈরি করেন নানান শিল্পকর্মও। শখ হিসেবে পোষেন বেশ কিছু পাখি। নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন ছোট্ট একটি ছাদ বাগান। আর ভবিষ্যতে গ্রামের বাড়ি পটিয়ায় একটি আর্ট স্কুল করতে চান তিনি। সূত্র – ডেইলি বাংলাদেশ।

আজকের বাজার/শারমিন আক্তার