মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও সরঞ্জামের অভাব দুর্বল করে দিচ্ছে করোনা প্রতিরোধ

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সরকার একে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করলেও প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও সরঞ্জামের অভাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও বলছেন, পর্যাপ্ত ভাইরোলজিস্ট এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরীক্ষণে অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। সেই সাথে সংগ্রহ করা নমুনাগুলোর গুণগতমানও পরীক্ষার ফলে মাঝে মাঝে প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি যশোর ও কুষ্টিয়ায় ৩০টি নমুনা পরীক্ষার ফল পজেটিভ আসার পর সেগুলো আবার ঢাকার ল্যাবে পরীক্ষা করে নেগেটিভ পাওয়া যায়। ফলে জেলা পর্যায়ের ল্যাবগুলোতে করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না হওয়ায় ঢাকার বাইরে স্থাপন করা বিভিন্ন ল্যাবে আধা-দক্ষ টেকনোলজিস্ট দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার জরুরি ভিত্তিতে দুই হাজারের বেশি চিকিৎসক এবং পাঁচ হাজারের বেশি নার্স নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্টও নিয়োগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালা অনুসারে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য যে পরিমাণ চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দরকার, বাংলাদেশ তা থেকে অনেক দূরে। সংস্থাটির মতে, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে অন্তত তিনজন নার্স এবং পাঁচজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। সরকারি তথ্যানুসারে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার ৬১৫ জন চিকিৎসক এবং ৫ হাজার ১৮৪ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কাজ করছেন। তাদের মধ্যে আবার মাত্র ১ হাজার ৪১৭ জন টেকনোলজিস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে কাজ করছেন। কিন্তু ডব্লিউএইচও’র মতে দেশে ১ লাখ ২৮ হাজার ৭৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকার কথা ছিল। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, করোনা পরীক্ষার জন্য যে ল্যাবগুলো নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেখানে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং দক্ষ ও পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাব রয়েছে।

‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে গত এক দশকে কোনো মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হয়নি। দেশে কেবলমাত্র কয়েকজন ভাইরোলজিস্ট রয়েছেন এবং তারা বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্য চিকিৎসকদের (ভাইরোলজিস্ট নন) সহায়তায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন,’ যোগ করেন তিনি। ডা. শাহানা বলেন, দক্ষ ভাইরোলজিস্ট তৈরিতে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে দ্রুত এ বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালুর জন্য নীতিনির্ধারকদের এখনই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। ‘যখনই কোনো ভাইরাস দেশে আসে, নীতিনির্ধারকরা তখনই কেবল ভাইরোলজিস্টদের গুরুত্ব অনুভব করেন, তবে দুর্ভাগ্যক্রমে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের পরে তারা এটিকে ভুলে যান,’ যোগ করেন তিনি। ডা. শাহানা আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাস হয়তো আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দূর হয়ে যাবে। কিন্তু ভবিষ্যতে আবারও কোনো নতুন ভাইরাস আসতে পারে। ‘আমাদের এটি মনে রাখা উচিত এবং পর্যাপ্ত ভাইরোলজিস্ট এবং তাদের জন্য পদ তৈরি করে তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হওয়া দরকার, কারণ আমরা জানি যে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই ভালো।’

তিনি জানান, দেশের ভাইরোলজিস্টদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও বিশেষজ্ঞ তৈরিতে ঢামেকে ভাইরোলজি (রেসিডেন্সি) স্নাতকোত্তর কোর্স এমডি চালুর অনুমতি পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার জন্য এখন আরও বেশি ভাইরোলজিস্ট এবং টেকনোলজিস্টের প্রয়োজন উল্লেখ করে ডা. শাহানা বলেন, তাদের তিনজন টেকনোলজিস্ট গত সপ্তাহে গাজীপুরে স্থানান্তরিত হওয়ায় পরীক্ষাগারে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ভাইরোলজিস্ট শাহানা আরও বলেন, ‘ঢামেকের ভাইরোজি ল্যাবে মাত্র একটি রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিন স্থাপন করা হয়েছে, যা দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ ১৮৮টি নমুনা টেস্ট করা যায়। কিন্তু রোগীর এতই চাপ যে আমরা প্রতিদিন তিন শতাধিক নমুনা সংগ্রহ করছি।’ ‘প্রথমত আমাদের কাছে ভালোভাবে এত নমুনা সংগ্রহের সক্ষমতা নেই। দ্বিতীয়ত এ নমুনাগুলো মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। আমাদের কাছে সংরক্ষণের জন্য এমন আধুনিক রেফ্রিজারেটর নেই। ফলে নমুনার গুণগত মান খারাপ হতে পারে যা ফলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে,’ যোগ করেন তিনি।

একই নমুনার একবার পজেটিভ ও আরেকবার নেগেটিভ ফল আসার ব্যাপারে ভাইরোলজিস্ট শাহানা বলেন, ‘যথাযথ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নাক এবং গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করি। নমুনা সংগ্রহের জন্য আমাদের দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। নমুনাগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না হলে আপনি একই নমুনার পজেটিভ ও নেগেটিভ ফল পেতে পারেন।’ জনবল ও সরঞ্জাম উভয়ের অভাবে দায়িত্ব পালনে সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত কর্মীদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে আমাদের ভালো মানের পিপিই এবং এন৯৫ মাস্ক প্রয়োজন।’ যোগাযোগ করা হলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর বলেন, আইনি জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ‘তবে দক্ষ ল্যাব টেকনোলজিস্টদের ঘাটতি হ্রাসে সরকার খুব শিগগিরই ৩৫০ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে,’ যোগ করেন তিনি। ড. আলমগীর বলেন, কোভিড-১৯ পরীক্ষার চাপ সামলাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। ‘আমাদের খুব কম ভাইরোলজিস্ট রয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাইক্রোবায়োলজিস্টরা এখন আমাদের পরীক্ষাগারে কাজ করছেন।’  সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান