যে কারণে চামড়া পাচার হয় ভারতে

কোরবানী ঈদ পরবর্তী চামড়া বিকিকিনি যেন আলাদা এক উৎসবের জন্ম দেয়। আলাদা উৎসাহ-উৎকণ্ঠা থাকে চামে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তবে দিনে দিনে উৎসাহ শব্দটি ফিকে হয়ে যাচ্ছে। চেপে ধরছে উৎকণ্ঠা। প্রতিবছরই কোরবানির পশুর চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যায়। পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মতে, নগদ ও অতিরিক্ত মূল্য পাওয়ার কারণেই ভারতে পাচার হয় কোরবানির পশুর চামড়া। চোরাকারবারিদের সারা বছরের অন্যান্য চোরাই ব্যবসা ঠিক রাখতেও চামড়া পাচার হয়। তবে এবার চামড়া পাচার বন্ধে দেশের সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদ মৌসুমে নগদ টাকায় চামড়া কিনতে হয় তাদের। কিন্তু সেগুলো বড় ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে মাসের পর মাস ও টাকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। হয়রানি হতে হয় নানা ক্ষেত্রে। অন্যদিকে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করলে বেশি লাভ এবং নগদে টাকা পাওয়া যায়। যে কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে সীমান্তে চামড়া পাচার হয়ে যায়। এছাড়া বাংলাদেশে কোরবানির একদিনে যত গরু জবাই হয়, ভারতের সীমান্ত এলাকায় কয়েক বছরেও এত গরু জবাই হয় না। সে কারণেও সেখানকার চামড়া ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশের ভালো মানের চামড়া সংগ্রহ করতে।

সাতক্ষীরা জেলার ভোমরা স্থলবন্দরের মেসার্স বিএম করপোরেশনের মালিক আবদুল গফুর বলেন, ভারতে গরু জবাই করা নিষিদ্ধ। জবাই হলেও খুবই সামান্য। এছাড়া বাংলাদেশের গরুর চামড়ার মান ভালো থাকে। মূল্যও বেশি পাওয়া যায়। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে চামড়া পাচার করেন।
একই এলাকার ব্যবসায়ী আশিক এন্টারপ্রাইজ ও ভোমরা বন্দর আমদানি-রফতানিকারক সমিতির সহ-সভাপতি আল ফেরদাউস আলফা বলেন, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে চামড়ার মূল্য বেশি হওয়ায় চোরকারারিরা চামড়া পাচার করে।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জের ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ী মৃণাল কান্তি ও আবদুস আলী বলেন, ভারতে চামড়া পাচার হওয়ার প্রধান কারণ, নগদ মূল্য ও মুনাফা বেশি। এছাড়া নগদে চামড়া কিনে বাংলাদেশের ট্যানারি মালিকদের কাছে বাকিতে চামড়া বিক্রি করতে হয়। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও ঠিকমতো টাকা আদায় করা যায় না। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী ভারতে চামড়া পাচার করে দেন।

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী আসাদ বিহারী ও আমান ম-ল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারতে গরু জবাই কম হওয়ায় ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের চামড়ার অপেক্ষায় থাকে। তারা অনেক ক্ষেত্রে অগ্রিম টাকাও দিয়ে দেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। তারা নগদ মূল্যে চামড়া কিনে থাকেন। এ কারণেই ঈদ মৌসুমে ভারতে চামড়া পাচার বেশি হয়।

ভারতে কোরবানির চামড়া পাচার হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ভারতে চামড়া পাচার হওয়ার মূল কারণ অর্থ সংকট। এই মৌসুমে দেড় দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। সেক্ষেত্রে ট্যানারি মালিকদের তো এত টাকা নেই। আর এতটাকা ঋণও পাওয়া যায় না। ব্যাংক সাধারণত দুই তিন শ কোটি টাকা আমাদের ঋণ দেয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তখন দেখা যায় যে, মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সঠিক সময়ে ট্যানারি মালিকরা চামড়াটা কিনতে পারেন না। এ কারণে সীমান্ত দিয়ে চামড়াগুলো ভারতে পাচার হয়ে যায়। এছাড়া মৌসুমি চামড়াটা ভালো হওয়ায় ভারতের বড় ব্যবসায়ীরা এ সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।

শাহীন আহমেদ বলেন, চামড়া যেন পাচার হতে না পারে, সে জন্য বিজিবিসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছেই ট্যানারি ব্যবসায়ীরা আবেদন জানিয়েছেন। সাতক্ষীরা ও যশোরসহ যেসব এলাকা দিয়ে চামড়া পাচার হয়, সেসব এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

৩৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আমিন বলেন, অবৈধ কোনও পণ্য যেন পাচার হতে না পারে, সে বিষয়ে আমরা সতর্ক থাকি। তবে কোরবানির চামড়া যেন ভারতে পাচার না হতে পারে, সে জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, চামড়া যেন পাচার না হয়, সে জন্য জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। চামড়া পাচার রোধে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়া ঈদের পরে চামড়া পাচার রোধে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটও মাঠে থাকবেন। চামড়া পাচারের তথ্য পাওয়া মাত্র প্রশাসনকে জানানোর জন্য সীমান্তবর্তী এলাকার চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে।

দেশের সীমান্তবর্তী জেলা ফেনীর পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। পৌরসভা, জেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আশা করি, আমরা ঠেকাতে পারব।

কী কারণে ভারতে চামড়া পাচার হয়এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনীর পুলিশ সুপার বলেন, প্রধান কারণ আর্থিক। ব্যবসায়ীরা যেখানে তারা লাভবান হন, সেখানেই ব্যবসা করেন। সীমান্ত এলাকায় তাদের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয়, চামড়ার বাইরেও তাদের সঙ্গে অন্য ধরনের ব্যবসার সম্পর্ক থাকে। যে কারণে তারা একদিকের লাভের হিসাব করেন না। সারা বছরের লাভের হিসাব করেন। বন্ধুত্ব তো আর একদিনের নয়। এবার আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, যেন আমাদের সম্পদ আমাদের দেশের মধ্যে থাকে।
সিলেট জেলা পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, চামড়া পাচার যেন না হয়, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হবে। চামড়া পাচার রোধে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারিও থাকবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে কোরবানির ঈদ উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা বৈঠক শেষে গত ২০ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, চামড়া পাচাররোধ ও চামড়া নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর প্রবেশ ও বাইর হওয়ার পয়েন্টগুলোয় নিরাপত্তা ও তল্লাশি চৌকি বসানো হবে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে যেন চামড়া পাচার না হতে পারে, সে জন্য অতিরিক্ত নজরদারি করা হবে।
সূত্র: বাংলাট্রিবিউন

আজকের বাজার: আরআর/ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭