রমনার বটমূলে সুরের মূর্ছনায় বর্ষবরণ

ভোরের মিহি আলোয় রমনার বটমূলে ছড়িয়েছে সুরের মূর্ছনা। রাগ ভৈরবীর আলাপ যেন ভোরের আলোয় নতুন কিছুর আহ্বান। সরোদের সুর ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি করেছে অন্যরকম দ্যোতনা। গান, পাঠাবৃত্তির মধ্য দিয়ে ভোর ৬টা ১০ মিনিটে শুরু হয় ছায়ানটের আয়োজনে বর্ষবরণ ১৪২৪।

‘আনন্দ, বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও অসাম্প্রদায়িকতা’ এ প্রতিপাদ্যে এবার বর্ষবরণের আয়োজন সাজিয়েছে ছায়ানট। গান আর পাঠাবৃত্তির মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বঙ্গাব্দ ১৪২৪-কে।

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো এ বছর। এই বিশেষ আয়োজনে অংশ নিয়েছেন ছায়ানটের ১১১ জন শিল্পী-শিক্ষার্থী। রাজরূপা চৌধুরী সরোদবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ আয়োজন।

এর পর সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয় ‘আলোকের এই ঝর্ণা ধারায়’ গানটি। ১৯৬৭ সালে এ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়েই রমনা বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখী আয়োজন শুরু হয়েছিল। সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ বর্ষবরণ আয়োজনেও এ গানটি গীত হয়।

২০০১ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ন্যক্কারজনক বোমা হামলা হয়েছিল। তখন মঞ্চে শিল্পীরা গাইছিলেন ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’। এবার বর্ষবরণে গীত হয় ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’ গানটি।

ছায়ানট কর্তৃপক্ষ জানায়, এ গানটি গাওয়ার সময়ই বোমা হামলা হয়। ষোল বছর পর আবার গানটি বিশেষভাবে গাওয়া হলো। সেদিন গানটি অসম্পূর্ণ ছিল আজ সেটি সম্পন্ন হলো।

ছায়ানট সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন বলেন, ‘এবারের আয়োজনটি আমাদের কাছে বিশেষ আনন্দের। রমনার বটমূলে এই আয়োজনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৬১ থেকে শুরু করে ১৯৬৭ হয়ে এ পর্যন্ত আমরা বাঙালি সংস্কৃতি লালন এবং বিকাশে কাজ করছি। আমাদের চেষ্টা আমরা দেশের মানুষের কাছে যাবো। মিছিল নয়, স্লোগাণ নয়। আমরা চাই নানাভাবে মানুষের কাছে যেতে।’

বিশ্বায়নের এই সময়ে আমরা কেন পিছিয়ে আছি? প্রশ্নের সুরে ছায়ানট সভাপতি বলেন, ‘বিশ্বায়নের এই সময়ে আমরা কেন আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ইন্টারনেটের মাধ্যমের বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারছি না? আমাদের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে।’

সনজীদা খাতুন বলেন, ‘আমাদেরকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হবে। আমরা কিছু কথা বলতে চাই। সব সময় কথা দিয়ে মানুষের প্রাণকে টানা যায় না। তাই আমাদের কথাগুলো গান দিয়ে, আবৃত্তি দিয়ে তুলে ধরতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালিত্বের বোধ এবং সত্য ধর্মের পরিচয় সবার কাছে তুলে ধরতে চাই।’

‘পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা, ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে সেগুলোকে ভেঙে ফেলবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মুক্তির জন্য কিছু কাজ করবার আছে।’ বললেন সনজীদা খাতুন।

তিনি বলেন, ‘শুধু ছায়ানট নয়, অন্য সব সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্কৃতিকর্মীদেরকে তাদের ভালো কাজগুলো নিয়ে আরও বেশি মানুষের কাছে যেতে হবে। প্রত্যন্ত মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। মানুষের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছতে চাই। এটাই আমাদের চাওয়া।’

এবারের আয়োজনে ছিল ৮টি সম্মেলক গান, ১৩টি একক গানের পরিবেশনা। সম্মেলক কণ্ঠে গীত হওয়া গানগুলোর মধ্যে ছিল-‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’, ‘ওরে বিষম দরিয়ার ঢেউ’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘ভোরের হাওযায় এলে ঘুম ভাঙাতে’, ‘উদয়শিখরে জাগে মাভৈ মাভৈ’, ‘তোমার আনন্দ ওই এলো দ্বারে’, ‘আনন্দেরই সাগর হতে’, ‘আপন কাজে অচল হলে’, ‘আজি রক্ত নিশি ভোরে’, ‘আমাদের নানান মতে’, ‘আমি টাকডুম টাকুডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’।

আয়োজনে ছিল ৪টি পাঠাবৃত্তি। এতে অংশ নেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও আসাদুজ্জামান নূর। একক কণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ইফ্‌ফাত আরা দেওয়ান, মহিউজ্জামান চৌধুরী, শাহীন সামাদ, সুমন মজুমদার, মো. সিফায়েত উল্লাহ, খায়রুল আনাম শাকিল, শারমিন সাথী ইসলাম, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, লাইসা আহমদ লিসা, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, ফারহানা আক্তার শার্লি, চন্দনা মজুমদার ও বিমান চন্দ্র বিশ্বাস।

ছায়ানট সভাপতি ড. সনজীদা খাতুনের বক্তব্য, সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসার ঘোষণা পাঠ এবং জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম পর্বের পরিবেশনা। এর পর নেত্রকোণার দিলু বয়াতি ও তাঁর দলের ‘দেওয়ানা মদিনা’ লোকপালা পরিবেশনার মধ্য দিয়ে প্রভাতী আয়োজন শেষ হয়।