রাস্ট্রায়ত্ব ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির এখনই উপযুক্ত সময়

পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা,ভবিষ্যত এবং অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আজকের বাজারের সাথে কথা বলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় মার্চেন্ট ব্যাংক লংকা বাংলা ইনভেস্টমেন্টস এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইওহাসান জাবেদ চৌধুরী । একই সাথে রাস্ট্রায়ত্ব ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত না হওয়ার কারনসহ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে চ্যালেঞ্জ নিয়েও কথা হয় আজকের বাজার প্রতিবেদক এস এম জাকির হোসাইন এর সাথে। আলোচনার চুম্বক অংশ তারই ভাষায় তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশের সামগ্রীক অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রথমেই বলতে হয় ১৬-১৭ অর্থবছরে আমাদের দেশের অর্থনীতি ৭.২৩ শতাংশ বেড়েছে।মুলত মানুষের ক্রমবর্ধমান আয় আর পাবলিক ইনভেস্টমেন্টের কারনে মুদ্রাস্ফীতিও স্বাভাবিক পর্যায়ে ছিল। তবে গতবছর বিশ্ববাজারে তেল ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকায় এটা সম্ভব ছিল।

এবছরের প্রথম তিন মাসে আমরা দেখেছি মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে, যা মুলত পন্য ও সেবা খাতের জন্য বেড়েছে। গতবছরের শেষের দিক থেকেই তারল্য সংকটের কারনে ব্যাংকিং সেক্টরে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। আমানতের উপর তুলনামুলক সুদের হার কম থাকার কারনে গত কয়েকবছর যাবত মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুতসাহিত হয়েছে।তাছাড়া সোস্যাল সিকিউরিটির নামে সঞ্চয়পত্রের উপর অযৌক্তিক উচ্চহারে সুদ দেওয়ার ফলে মানুষের তুলনামুলকভাবে সঞ্চয়পত্রের দিকে আগ্রহ বেশি দেখা যায়। ফলে দেশের মোট সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ কোন উতপাদনশীল খাতে বা ব্যাংকে যাচ্ছে না। এই বিনিয়োগটা যদি আমাদের পুঁজিবাজার বা অন্যান্য গুরুত্বপুর্ন খাতে হতে পারতো।

সঞ্চয়পত্রের উচ্চসুদের কারনে আরও একটা বড় ক্ষতি হচ্ছে আমাদের বন্ড মার্কেটের। সঞ্চয়পত্রের সুদ ঝুঁকিমুক্ত, কিন্তু বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে আমরা ১০-১১ শতাংশ সঞ্চয়পত্রের সুদের উপর যদি কর্পোরেট ইস্যুদের ক্রেডিট কোয়ালিটি বিবেচনায় ৩-৪ শতাংশ প্রিমিয়াম যোগ করি, তাহলে এই ১৪-১৫ শতাংশ রেট যা  কোনভাবেই ইস্যুয়ারদের জন্য ফিজিবল নয়।

এডিআর রেশিও নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন এডিআর রেশিং এর কারনেও ব্যাংকগুলো তাতক্ষনিকভাবে অসুবিধায় পড়ে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাস্তবায়নের সময়সীমা বাড়ালে পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়।

প্রাইভেট ক্রেডিট গ্রোথ ২০১৭ সালে ছিল ১৯ শতাংশ। যা তার আগের বছর ছিল ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারের ভিবিন্ন মেগা প্রজেক্টের কারনে পাবলিক ইনফ্রাস্টাকচারে ইনভেস্টমেন্ট চাহিদাও ছিল প্রচুর।

আমাদের রপ্তানির তুলনায় আমদানির প্রবৃদ্বি আশংকাজনক হারে বৃদ্বি পাওয়ায় বিগত এক বছরে বানিজ্য ঘাটতি প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে। যেখানে আমদানির প্রবৃদ্বি ২৪.৫ শতাংশ । আর রপ্তানি বেড়েছে ১০.৫৪ শতাংশ। তাছাড়াও খেলাপী ঋনের পরিমান ২০১৭ সালে দাঁড়ায় ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা যা আগের বছর ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা।

পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা এবং সামনে কি হতে যাচ্ছে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে ? জবাবে আমি  বলবো ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটের প্রভাব পুজিবাজারেও রয়েছে। এ বছরের শুরু থেকেই পুঁজিবাজারের সূচক নিম্নমূখী প্রভনতায় দেখা যায়।পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সংকট নিরসনে এপ্রিলের শুরুর দিকে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে ৫.৫ শতাংশ করায় ব্যাংকিং খাতে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার যোগান দেওয়া সম্ভব হয়। যার ইতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারেও আশা করা যায়। এছাড়াও এবছর জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করছে।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে কর্পোরেট টেক্স আড়াই শতাংশ কমিয়েছে যার কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়বে বলে আমি মনে করি। তবে পুঁজিবাজার উন্নয়নের ক্ষেত্রে মিউচুয়াল ফান্ড একটা বড় ভুমিকা রাখতে পারে। কারন মিউচুয়াল ফান্ড লংটার্ম ইনভেস্টমেন্ট টুলস হিসেবে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যাবে। তাই মিউচুয়াল ফান্ডের উপর আরও সুবিধা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

আমরা পুঁজিবাজারকে আরো স্থিতিশীল ও শক্তিশালী দেখতে চাই। যা পুঁজিবাজারের সাথে সম্পৃক্ত সকল স্টেক হোল্ডারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব।

লংকা বাংলা ইনভেস্টমেন্টস এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা(সিইও)হাসান জাবেদ চৌধুরী

তাছাড়া পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সাধারন বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা ও বিনিয়োগ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই বলে আমি বিশ্বাস করি। এই শিক্ষা শুধু পুঁজিবাজার বা নির্দিস্ট প্রোডাক্ট কেন্দ্রিক না হয়ে সামগ্রিক হওয়া উচিত। যাতে বিনিয়োগকারীরা নিজেদের প্রয়োজন বুঝে সঠিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়। তাই লংকা বাংলা ক্যাপিটাল মার্কেট অপারেশন বিএসইসি’র বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম এর সাথে একাত্ব হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

রাস্ট্রায়ত্ব এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার জন্য এখনই উপযুক্ত সময় কিনা? এই প্রশ্নের জবাবে আমি বলবো এখন পুঁজিবাজারের আগের চেয়ে অনেক স্বচ্চতা আর জবাবদিহিতা বেড়েছে। দক্ষতা ও জবাবদিহিতার জন্য উভয় স্টক এক্সচেঞ্জকেই ডিমিউচুয়ালাইজড করা হচ্ছে। অনেক নিয়ম নীতিও আপডেটেড করা হয়েছে, আইপিও প্রাইস নির্ধারন পদ্বতিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো বুক-বিল্ডিং এ (প্রিমিয়াম ইস্যু) গিয়ে যথাযথ মূল্য পেতে পারে। তাই রাস্ট্রায়ত্ব ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির এটাই উপযুক্ত সময়।

এছাড়াও পদ্মা সেতুর মত বৃহত অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাজারকে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি।তাছাড়া সরকার সহজেই পুঁজিবাজার থেকে প্রয়োজনীয় তহবিলের একটি গুরুত্বপুর্ন অংশের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারে ।নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলেই মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বাধ্যতামূলক তালিকাভুক্তির আইন প্রনয়ন করতে পারে।কারন এর আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু কোন ফলপ্রসু হয়নি। তাই এখন আইনের মাধ্যমে তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি।

আইপিও ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে ইস্যু ম্যানেজারদের কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে আমি বলতে চাই অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। প্রাইভেট থেকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা একটি কোম্পানির জীবনচক্রের একটি গুরুত্বপূর্ন এবং কিছুটা চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়। প্রাইভেট কোম্পানির মালিকরা, বিশেষ করে প্রথম প্রজম্মের উদ্যোক্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাব্লিক কোম্পানিতে যাওয়ার আগ্রহী থাকেন না। তাছাড়া আইপিও’র দীর্ঘপ্রক্রিয়াও ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের অন্যতম কারন হিসেবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বর্তমানে আইপিওতে আসার ক্ষেত্রে যে প্রনোদনা দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয় বলে আমি মনে করি।

ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে অন্যতম বাঁধা কাজ করে দীর্ঘসুত্রিতা।বর্তমানে আইপিওর প্রক্রিয়াকরনে এক বছরের বেশি সময় লাগে। যা বুক বিল্ডিং এ আরো বেশি সময় লাগে। নিম্ন টেক্স প্রনোদনা। কঠোর নিয়মকানুন মানতে হয় যে কারনে কোম্পানিগুলো মনে করে তালিকাভুক্ত হওয়া অনেক কঠিন কাজ। বর্তমানে আইন অনুযায়ী উত্তোলিত অর্থের ৩০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকরী লোন পরিশোধের জন্য অনুমোদিত। যার ফলে অনেক কোম্পানিই এটাকে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত মনে করেনা।

ডিরেক্ট লিস্টিং এর সুবিধা সুধুমাত্র রাস্ট্রায়ত্ব কোম্পানির জন্য সীমাবদ্ব। যার ফলে অনেকে ডিরেক্ট লিস্টিং এর আগ্রহ থাকলেও তারা সেই সুযোগ পাচ্ছেনা।এছাড়াও রেপুটেশনাল রিস্কও বড় কারন তালিকাভুক্ত না হওয়ার পেছনে। ক্যাপিটাল মার্কেটে কিছু এক্টিভিস্ট রয়েছে যারা নিজস্ব সুবিধার জন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিরুদ্বে কাজ করে। এক্ষেত্রে ইস্যুয়ারদের প্রোটেকশন দেওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

কোম্পানিগুলো আরও সুবিধা চায়, বিশেষ করে টেক্স সুবিধা বাড়ানো হলে আরও বেশি কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আমি মনে করি ক্যাপিটাল মার্কেট সম্পর্কিত ট্রেইনিং সুবিধাগুলো পর্যাপ্ত পরিমানে না থাকায় এই খাতে প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া নিয়ন্ত্রক স্পংস্থাগুলোর স্বল্প হিউম্যান রিসোর্সও কোন কোন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসে। ইস্যু ম্যানেজারদের সংযুক্ত প্রতিষ্টানগুলো আইপিওর বিডিং এ অংশগ্রহন করতে পারেনা । ফলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর আইপিও করার আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

এছাড়াও ইস্যু ম্যানেজমেন্ট ফিও খুব প্রতিযোগিতামূলক। এক্ষেত্রে যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাট অফ প্রাইস নির্ধারন হওয়ার পর মার্চেন্ট ব্যাংক অথবা ইস্যু ম্যানেজার এর সংযুক্ত প্রতিষ্টান বিডিং প্রসেস এ অংশ গ্রহনের সুযোগ দিলে এই সংকটের কিছুটা সমাধান হবে বলে আমি মনে করি। তাহলে ইস্যু ম্যানেজাররাও ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে কাজ  করতে পারবে।

/জাকির/